শ্রমিক কল্যাণে ৭০০ কোটি টাকার তহবিল

সব অর্থ সরকারি ব্যাংকে রাখার পরামর্শ সংসদীয় কমিটির

জেসমিন মলি

দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের সহায়তার জন্য দুটি তহবিল রয়েছে। একটি শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল, অন্যটি বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন। এখন পর্যন্ত দুটি তহবিলে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এসব অর্থ দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যাংকে সঞ্চয় হিসেবে রাখা আছে। তবে জমাকৃত এসব অর্থ তুলে সরকারি ব্যাংকে রাখার পরামর্শ দিয়েছে শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বেসরকারি ব্যাংকে অর্থ রাখা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে কমিটির সাম্প্রতিক এক বৈঠক থেকে পরামর্শ দেয়া হয়।

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলের ২৭৫ কোটি টাকা বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসেবে রাখা আছে। আর বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে রাখা আছে ১৬৮ কোটি টাকা। এফডিআরের বাইরেও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিল হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংকে জমা আছে ১৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর কেন্দ্রীয় তহবিলের ১০৬ কোটি টাকার একটি বড় অংশই বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে রাখা আছে।

সংসদীয় কমিটির বৈঠকের আলোচনায় কমিটির সদস্য মাদারীপুর- আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খান জানান, শতকরা হারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকারি ব্যাংকে জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। সময় তিনি বর্তমানে সরকারি বেসরকারি ব্যাংকে জমার হার কত সেটি জানতে চান। এর উত্তরে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জানান, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ৫০ শতাংশ অর্থ সরকারি ব্যাংকে ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু দুই বছর আগে তিনি দেখেন ৩৪ শতাংশ অর্থ সরকারি ব্যাংকে রয়েছে। অবশিষ্ট অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রয়েছে। এজন্য তিনি সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এনে ৫০ শতাংশ সরকারি ব্যাংকে রাখার নির্দেশনা দেন।

বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম-১৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছান এলাহী, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেছা করিম প্রমুখ।

বৈঠকে কমিটির সদস্যরা তাদের মতামত তুলে ধরে বলেন, নন-শিডিউল ব্যাংকে টাকা জমা রাখা বর্তমানে অনেক ঝুঁকির বিষয়। এজন্য বেসরকারি ব্যাংক থেকে জমাকৃত টাকা জরুরি ভিত্তিতে তুলে আনার পরামর্শ তাদের।

সরকারি ব্যাংকে টাকা রাখার পক্ষে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও। তারা  বলছেন, সব বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সরকারি ব্যাংকে জমা রাখা হচ্ছে। শুধু কিছু ব্যাংকে জমাকৃত টাকার মেয়াদ পূূর্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করা হচ্ছে। তবে অনেক ব্যাংকে জমাকৃত টাকার মেয়াদ শেষ হয়নি। ফলে তা এখন তুললে অনেক টাকা কম পাওয়া যাবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে অডিটের সম্মুখীন হতে হবে। তাই মেয়াদ শেষ হলে তা তুলে এনে সরকারি ব্যাংকে রাখা হবে।

আইন অনুযায়ী দেশে সক্রিয় ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফার শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করতে হয়। আর লভ্যাংশের একটি নির্দিষ্ট অংশ সরকারের বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে জমা দিতে হয়। কেন্দ্রীয় তহবিলের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বা পেশাগত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে বা পেশাগত কারণে কাজ করতে অক্ষম হয়ে গেলে সুবিধাভোগী কল্যাণ তহবিল থেকে তার পরিবারকে লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। একই পরিমাণ অর্থ পান কেউ চাকরিরত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে বা দুর্ঘটনায় মারা গেলে বা অক্ষম হলে। এছাড়া অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসায়, পরিবারের মেধাবী সন্তানদের শিক্ষার জন্য বৃত্তি দিতেও তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা হয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন, ২০০৬ অনুযায়ী তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি, যৌথ বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, চিকিৎসায় সহায়তা, কোনো শ্রমিক মারা গেলে দাফন বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য সহায়তা, অক্ষম শ্রমিককে সহায়তা, দুর্ঘটনায় মৃত শ্রমিকের পরিবারকে সাহায্য করা মাতৃত্ব কল্যাণ খাতে সহায়তা করা হয়।

বাংলাদেশের শ্রম আইন-২০০৬- শ্রমিক কল্যাণে প্রতিষ্ঠানের মুনাফার শতাংশ অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা ছিল। তবে তা বাস্তবায়নে সরকারি নজরদারির সুনির্দিষ্ট কোনো ধারা ছিল না। এছাড়া আইন বাস্তবায়নে বিধিমালা না থাকায় তা কার্যকরের বিষয়ে কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। ২০১৩ সালে আইন সংশোধনের পর সরকারি তহবিলে অর্থ জমা দেয়াসহ আইন প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। আর বিধিমালা হওয়ার পর তত্পরতা আরো বেড়ে যায়। সরকারের তত্পরতা আইন সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় তহবিলের আকার ক্রমেই বাড়তে থাকে।

এছাড়া বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আইন সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় তহবিলে নিয়মিত অর্থ জমা পড়ছে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও আইন অনুসরণ করে নিয়মিত না হলেও তহবিলে অর্থ জমা দিচ্ছে। ধারাবাহিকতায় তহবিলটির বর্তমান স্থিতি ৬১১ কোটি টাকা। আর কেন্দ্রীয় তহবিলের বর্তমান স্থিতি ১০৬ কোটি টাকা। এসব তহবিলের অর্থ আবেদনের ভিত্তিতে শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করা হচ্ছে, দেয়া হচ্ছে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণও। এখন পর্যন্ত হাজার ৮২৩ জন শ্রমিককে ১৩ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়ার উদ্যোগের কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ১০০ টাকা মুনাফার বিপরীতে টাকা শ্রমিক কল্যাণে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা ছিল। অর্থাৎ শ্রম কল্যাণে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ তহবিলে টাকার ৮০ শতাংশ ( টাকা) শ্রমিকদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার পর বাকি ২০ শতাংশ ( টাকা) শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা রাখার কথা। তবে সংশোধিত ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী টাকার ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণ তহবিলে দেয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশ (দশমিক ৫০ টাকা) বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে বাকি ১০ শতাংশ (দশমিক ৫০ টাকা) কল্যাণ তহবিলে রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে সংশোধিত আইনে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন