মহান মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড লাখ লাখ বাঙালির অশ্রুভেজা রোড। এই রোড সন্তানহারা মাকে দেখেছে, স্বামীহারা স্ত্রীকে দেখেছে, তাদের চোখের জলে প্রতিনিয়ত স্নান করেছে, এই রোড সম্ভ্রমহারা নারীকে মুখ লুকিয়ে চলতে দেখেছে। শুধু তা-ই নয়, এই যশোর রোড লাখো শরণার্থীকে বিজয়ের মিছিল নিয়ে নিজ ভূখণ্ডে ফিরতে দেখেছে।
যুদ্ধকালে যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র রং-তুলির ছোঁয়ায় তুলে ধরেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড’
শিরোনামে আর্ট ক্যাম্পের ৫০ জন দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী। গতকাল দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সেই অধ্যায়ের গল্প নিয়ে যশোর পৌরপার্কে আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করে জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপনের অংশ হিসেবে যুদ্ধকালে যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা-যুদ্ধচিত্র রং-তুলির প্রাণবন্ত এবং মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা দেখে অনেকের চোখ ছলছল করে ওঠে।
প্রদর্শনীতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের শরণার্থীরা এ রাস্তা ধরে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছিল, তখন এ রাস্তাটিই ছিল তাদের শুধু বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণের পথ। তাদের অনেকেই পথ চলার ক্লান্তি সহ্য করতে না পেরে ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে। এ রাস্তার প্রতিটি ধূলিকণাও যেন সেই হাজারো শরণার্থীদের ক্লান্তি, দুর্ভোগ ও বয়ে বেড়ানো স্বপ্নের সাক্ষী। বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তারা পাড়ি দিচ্ছেন যশোর রোড। পথের দুধারের খড়ের চালার ঘর, অগুনতি নিরাশ্রীয় জনতার দখলকৃত বাংলাদেশ থেকে ভারতমুখী পথচলা। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ। তার মধ্যে কাদামাটি রাস্তায় দলবেঁধে ভারতের দিকে হাঁটছে শত শত নারী-পুরুষ। কারো হাতে রং-তুলিতে বিজয় মিছিল করতে করতে যশোর রোড দিয়ে ওপার বাংলা থেকে এই বাংলার ফেরার দৃশ্য ফুটে উঠেছে।
আয়োজকরা জানান, বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপনে যশোরে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ও জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে জেলাজুড়ে ২১ দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসব। সাংস্কৃতিক উৎসবের ধারাবাহিকতায় ঐতিহাসিক যশোর রোডকে উপজীব্য করে ‘মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড’
শিরোনামে আর্ট ক্যাম্পে ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ উৎসব। আর্ট ক্যাম্পে যশোরসহ ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক এবং বর্তমান শিল্পীরা অংশ নেন। তারা এ আর্টক্যাম্পে অ্যাক্রেলিক রঙের ক্যানভাসে যশোর রোডের শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র মুহূর্ত অবলম্বনে চিত্রাঙ্কন করেছেন।
আর্ট ক্যাম্পে অংশ নেয়া দেবব্রত দাস জানান, ‘এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তরুণ বাঙালি প্রজন্মকে ’৭১-এর যশোর রোডের যে দুঃখ-দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র কিছুটা আঁচ করতে পারবে। যশোর রোড নিয়ে আর্ট ক্যাম্পে এ ধরনের চিত্রকর্ম তুলে ধরেছি আমি এটাই প্রথম।
এ আয়োজন সম্পর্কে বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন পরিষদ-২১ ভাইস চেয়ারম্যান ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল জানান, বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন আমাদের জীবনে এক অনন্যপ্রাপ্তি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা এবং বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত করার লক্ষ্য নিয়ে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ যশোর রোড নিয়ে আর্ট ক্যাম্পটির মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুনভাবে জানছি, যা আমাদের স্মৃতিকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়।’