টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে সরকার

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকি কমাতে ‘থ্রি আর’ নীতি বাস্তবায়ন হোক

বাংলাদেশ একই সঙ্গে উন্নয়নশীল জনবহুল দেশ। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে টেকসই উন্নয়ন দেশের প্রধান লক্ষ্য। টেকসই উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়ত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যার মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে প্লাস্টিক বর্জ্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্লাস্টিক অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। শহরে জলাবদ্ধতা থেকে শুরু করে নদীদূষণেও প্লাস্টিক বড় ভূমিকা রাখছে। এমন প্রেক্ষাপটে পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। থ্রি আর (রিডিউস, রি-ইউস রিসাইকেল) পলিসি কার্যকর করে প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে উদ্যোগ। এক্ষেত্রে শুধু পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেই হবে না, এর কার্যকর বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের দেশে উন্নত বিশ্বের মতো পচনশীল-অপচনশীল দ্রব্য আলাদাকরণের ব্যবস্থা নেই। এর সঙ্গে নাগরিক অসচেতনতা পরিস্থিতিকে আরো বিপজ্জনক করে তুলছে। মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশব্যাপী ওয়ান টাইম প্লাস্টিক চায়ের কাপ ব্যবহার শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে ঝুঁকি বেড়েছে জনস্বাস্থ্য পরিবেশের। বাংলাদেশ পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধকারী প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের বিধান করা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও নেই বিকল্প পণ্য। পাটের ব্যাগকে জনপ্রিয় করতে পারেনি সরকার। প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ ঠেকাতে পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করাটা অপরিহার্য। পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে বহু অবৈধ কারখানা গড়ে উঠেছে, যেখানে ফেলে দেয়া প্লাস্টিক থেকে নতুন পণ্য উৎপাদন করা হয়। কিন্তু প্লাস্টিক শিল্প ঘিরে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। পাট থেকে পলিব্যাগ, ফেলে দেয়া বোতল থেকে ফ্লেক্স কিংবা পলিব্যাগ পুড়িয়ে জ্বালানি তেল উদ্ভাবনের মতো বিষয়গুলোকে খুব একটা আমলে নেয়নি সরকার। এমনকি নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণারও উদ্যোগ নেই। বাস্তবতা হলো যেহেতু বাংলাদেশে পলিথিন প্লাস্টিক পণ্যের প্রচুর চাহিদা, তাই এটা বন্ধ করা যাবে না। বরং এর রিসাইক্লিং কিংবা বিকল্প নিয়ে ভাবতে হবে। তাতে খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে। ব্যক্তি, পারিবারিক পর্যায়ে ব্যবহূত প্লাস্টিকজাত পণ্যের বিকল্প সামগ্রীর মূল্য কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে মানুষ বিকল্প পণ্যগুলো ব্যবহারে আগ্রহী হবে।

প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা যায় এবং উদ্ধার করা উপকরণগুলোকে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণে পদ্ধতিটি পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। প্লাস্টিক রিসাইকেল ব্যবস্থা এক প্রকার অর্থনীতি এবং অর্থনীতির মূলে রয়েছে কার্যকর সংগ্রহ ব্যবস্থা। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ, যেমন জার্মানি কার্যকরভাবেই ব্যবস্থা চালু করে প্লাস্টিক বর্জ্যকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রিসাইকেল ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছে। পাশাপাশি বোতল জমা দেয়ার ব্যবস্থা, রিসাইকেল মেশিন প্লান্ট সহজলভ্য করতে হবে। একবার প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা রিসাইকেলের অর্থনীতি চালু করতে পারলে বেসরকারি খাতও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। আবার ভারতের মেঘালয়ের মতো রিসাইকেল করা প্লাস্টিক দিয়ে রাস্তার পিচ ঢালাই বা অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যায়। 

প্লাস্টিক বায়োগ্রেডেবল নয়, পরিবেশে মিশে যায় এবং ভেঙে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় পরিণত হয়। সেজন্য মোটামুটি সব দেশই প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। গড়ে তুলেছে এর চক্রাকার অর্থনীতি। অর্থাৎ পণ্য তৈরি, ব্যবহার, বর্জ্য সংগ্রহ এবং পুনরায় এর ব্যবহার। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছে। কিছু দেশ প্লাস্টিক পণ্য সংগ্রহ ডিপো এবং ফেলার স্থান নির্দিষ্ট রাখার জন্য ভোক্তাদের অর্থ প্রদানেরও ব্যবস্থা করেছে। যাতে ব্যবহার শেষে পণ্যগুলো যথাস্থানে ফেরত দিতে ভোক্তারা উৎসাহিত হয়। যেহেতু আমাদের দেশের মানুষ অসচেতন, সেহেতু ধরনের কিছু উৎসাহমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে শাস্তির ব্যবস্থাও থাকতে হবে। সর্বোপরি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাড়াতে হবে সক্ষমতা। জাপানে শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার শেষে নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইকেল করা হয়। অনেক দেশে জৈব উপাদান ব্যবহার করে পচনশীল প্লাস্টিক তৈরির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আমাদেরও ধরনের উদ্যোগে শামিল হতে হবে।

পলিথিন ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই আইন রয়েছে। আইনটি যুগোপযোগী করে প্রয়োগ করতে পারলে পলিথিনের উপদ্রব যেমন কমবে, তেমনি দেশীয় পাটজাত শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। কিছুদিন আগে পাট দিয়ে পচনশীল পলিথিন আবিষ্কারের মতো যুগান্তকারী ঘটনার কথা আমরা জানতে পেরেছি এবং সরকারের প্রণোদনায় এখনই যথাসম্ভব দ্রুত বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের মহামারী রোধে বাংলাদেশের আবিষ্কার একটি মাইলফলক হতে পারে, সেজন্য ত্বরিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে আমাদের সরকার ২০১০ সালে জুট প্যাকেজিং আইন পাস করেছে। এরই মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যের ট্রান্সবাউন্ডারি মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণে একটি আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা, আইন মানার তাগিদ সৃষ্টি না হলে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কোনো কার্যক্রমই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। সরকারের শুভ উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যে বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, তার মধ্যে জৈব অজৈব বর্জ্য আলাদা করে সংরক্ষণ অন্যতম। প্রাথমিক স্তর থেকে বর্জ্য আলাদা করা নিয়ে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিরোধ করতে সরকারের সঙ্গে প্রত্যেক স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। সেই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে প্লাস্টিক বর্জ্য সম্পদে রূপান্তর করার প্রকল্প হাতে নিতে হবে। বাস্তবতা হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের অবকাঠামো জনবলগত ঘাটতি আছে। সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। তার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে চলা ওয়ানটাইম প্লাস্টিক উপকরণের ব্যবহার তাদের কাজ আরো কঠিন করে তুলছে। প্রেক্ষাপটে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো জনবল তো বাড়াতে হবেই, এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে নীতিগত কিছু হস্তক্ষেপের বিষয়েও ভাবনাচিন্তা জরুরি। প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হলেও এখন পর্যন্ত দেশে কোনো প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করা হয়নি। এটি এখন সময়ের দাবি।

প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে নানা সরকারি, না বেসরকারি উদ্যোগে; না সামাজিক স্তরে। সরকারের পক্ষ থেকে শুধু কয়েকটি নীতি ঘোষণা করলেই হবে না। ছোট মাঝারি মাপের শিল্প প্রকল্প তৈরি করে তাতে বেকারদের যুক্ত করার রাস্তা সরকারকেই প্রাথমিকভাবে তৈরি করে দিতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তারাও আরো বেশি করে এগিয়ে আসুক প্লাস্টিক বর্জ্যভিত্তিক শিল্প তৈরিতে। পরিবেশ নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করে, তারা যে প্লাস্টিকের বিপদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বহুদিন ধরেই আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, তা সবাই জানে। কিন্তু সেভাবে সাড়া মিলছে না। মানুষ সাড়া দিচ্ছে না কেন? পরিবেশদূষণের বিপদ সম্পর্কে অবগত হয়েও বিকল্পের অভাবে এবং বিকল্পগুলোর চেয়ে প্লাস্টিক বা পলিথিন অনেক বেশি বহনবান্ধব হওয়ায় মানুষ তা ত্যাগ করতে পারছে না। প্লাস্টিক বর্জ্য শুধুই বর্জ্য নয়, যে বর্জ্যে যুগপৎ লুকিয়ে রয়েছে পরিবেশদূষণের মারাত্মক উপাদান। প্রয়োজন সুপরিকল্পনার। যে পরিকল্পনার হাত ধরে পরিবেশের অন্যতম ক্ষতিকর প্লাস্টিক বর্জ্য রূপান্তর হতে পারে সম্পদে। একুশ শতকে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা কতটা সম্ভব জানি না। সে চেষ্টা আমাদের চালাতেই হবে। পাশাপাশি প্লাস্টিককে শুধু বর্জ্য হিসেবে না দেখে শতাব্দীর এক শিল্প উপাদান হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন