অভিমত

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং

মো. তানজিল হোসেন

একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন আবিষ্কার গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আজকের যে করোনাভাইরাস মহামারী, তার টিকা আবিষ্কারে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অগ্রণী। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশে প্রতি বছরই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু নতুন আবিষ্কার গুণগত গবেষণার পরিমাণ বাড়ছে না। তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে? একসময় বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা আবিষ্কারে এগিয়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণগত গবেষণা আবিষ্কার কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে স্থান পাচ্ছে না; এর অনেক কারণ রয়েছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য প্রার্থী এমনকি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া প্রার্থীকে বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষকদের ছেলে, মেয়ে, বউ, স্বামী আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের স্বজনপ্রীতির বিষয়টি জাতির সামনে আসে সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক ভিসি প্রফেসর আব্দুস সোবহানের মেয়াদ পূর্তির আগের দিন ১৪১ জন শিক্ষক কমকর্তা কর্মচারীকে অ্যাডহকে নিয়োগের মাধ্যমে। প্রফেসর আব্দুস সোবহান ১৪১ জনের মধ্যে নয়জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, তার মধ্যে ছয়জনই বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকের ছেলে, মেয়ে   স্ত্রী। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গুণগত গবেষণা নির্ভর করে যোগ্য শিক্ষকের ওপর শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি না করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী নিয়োগ দিলে তারা ভালো শিক্ষা গুণগত গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে নিয়ে আসতে পারত।

অধ্যাপক সোবহান তার আগে যে ৩৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, তার মধ্যে যোগ্যতা কমিয়ে তার মেয়ে জামাইকে নিয়োগ দিয়েছেন; যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি অবৈধ ঘোষণা করে বাতিলের সুপারিশ করেছে। স্বজনপ্রীতির কারণে একই বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক বিব্রত বোধ করেন। কিন্তু প্রতিবাদ করলে সম্পর্ক কাজের পরিবেশ নষ্ট হবে তাই তারাও কিছু বলে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভালো অনেক নৈতিক শিক্ষক আছেন কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকদের ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, স্বামী নিয়োগ দেয়ার উদাহরণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। তথ্য নিয়ে দেখা যায়, একই পরিবারের বাবা ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী একই বিভাগের শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতির কারণে একসময়ের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি দেশে সুনাম হারিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হারিয়েছে অবস্থান।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য (২১ ডিসেম্বর, ২০২১, খুলনা গেজেট) অনুসারে, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং/সম্মান (নবম গ্রেড) পদের নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, স্থগিত হওয়া পদগুলোয় খুকৃবির উপচার্যের স্ত্রী, মেয়ে ছেলে আবেদন করেছিলেন। তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও প্রায় চূড়ান্ত ছিল। বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনার মুখে গত ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে তিনটি পদেই নিয়োগ কার্যক্রম নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। পথচলার শুরুতেই নিয়োগ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর . মো. শহীদুর রহমান খান।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও স্বজনপ্রীতির উদাহরণ চোখে পড়ে। এগুলোয় দেখা যায়, শিক্ষকরা তাদের ছেলে, মেয়ে, বউ অথবা স্বামীকে বিভিন্ন কৌশলে নিয়োগ দিচ্ছেন। ফলে যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠান ভালো শিক্ষক গবেষক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেকটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থী জাতি নতুন নতুন আবিষ্কার গবেষণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা একটি জাতির উন্নতির জন্য প্রধান অন্তরায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য এর সমাধান এখনই আমাদের ভাবতে হবে।

স্বজনপ্রীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হারাচ্ছে যোগ্য শিক্ষক, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে র‍্যাংকিংয়ে না থাকার কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিদেশে বৃত্তি চাকরি পেতে প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশের র‍্যাংকিংয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিছিয়ে পড়ছে।

একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নৈতিকভাবে ছিলেন শক্তিশালী; স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ আর্থিক অনিয়মের ঊর্ধ্বে। তাদের সমাজে অনুকরণীয় ব্যক্তি মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে অনেক শিক্ষক স্বজনপ্রীতি দলীয়করণ আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যোগ্য শিক্ষক গবেষকরা নিয়োগ পাচ্ছেন না। অনেক মেধাবী দেশে নিয়োগ না পেয়ে উন্নত দেশে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। ফলে দেশ যোগ্য সন্তানদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এসব স্বজনপ্রীতি রোধে এমন একটি আইন করা প্রয়োজন, যাতে কোনো শিক্ষক যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, স্বামী চাকরি করতে পারবেন না; কিন্তু অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে পারবেন। তাহলে শিক্ষকদের স্বজনপ্রীতি অনেকটা কমবে। স্বজনপ্রীতি রোধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষক গবেষক নিয়োগে অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় উপকমিটিকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষক গবেষক নিয়োগ হবে; নতুন নতুন আবিষ্কার গবেষণা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক অবস্থান ফিরে পাবে।

 

মো. তানজিল হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

কার্যনির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন