র‍্যালি ব্রাদার্সকে আজও স্মরণ করে নারায়ণগঞ্জ

সাইফ বাপ্পী ও আল ফাতাহ মামুন

চারশ বছরেরও পুরনো নগরী ঢাকা এক সময় ছিল উপমহাদেশের বৃহৎ এক বাণিজ্য কেন্দ্র। ঢাকা তথা বাংলার ঐশ্বর্যের টানে এখানে ব্যবসা করতে এসেছেন অনেক বিদেশী। আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসও করেছেন কেউ কেউ। ঢাকায় এখন আর সেসব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা যায় না। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সে বণিক সম্প্রদায়গুলোকে নিয়ে ধারাবাহিক পর্ব-

এক সময় নারায়ণগঞ্জ বন্দর হয়ে উঠেছিল দেশের পাট বাণিজ্যের প্রধানতম কেন্দ্র। বন্দরটিতে পাট বাণিজ্য শুরু করা প্রথম কোম্পানি ছিল গ্রিক বণিকদের প্রতিষ্ঠান র‍্যালি ব্রাদার্স। নারায়ণগঞ্জে কাঁচা পাট প্রক্রিয়া করে তা যুক্তরাজ্যে রফতানি করত প্রতিষ্ঠানটি। নারায়ণগঞ্জের পাটের ব্যবসা দিয়ে শুরু করে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, খুলনা, কলকাতা বোম্বে পর্যন্ত নিজেদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছিল র‍্যালি ব্রাদার্স।

ঈজিয়ান সাগরের কিওস দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসা র‍্যালি পরিবারের সদস্যদের হাতে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছিল সমসাময়িক বিশ্বের কৃষিপণ্য বাণিজ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। ঊনবিংশ শতকের মধ্যেই র‍্যালি ব্রাদার্সের ব্যবসার পরিধি উপমহাদেশ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল নিউইয়র্ক, জাপান, রাশিয়া যুক্তরাজ্যে।

র‍্যালি ব্রাদার্সের পাটের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি সমৃদ্ধ করেছিল নারায়ণগঞ্জকেও। পাট বাণিজ্যে বন্দরটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় বড় ভূমিকা ছিল প্রতিষ্ঠানটির।

ঔপনিবেশিক আমলে অঞ্চলে ব্যবসা করেছে ইউরোপ থেকে আসা অনেক বণিক সম্প্রদায়। তাদের হাতে গড়ে ওঠা পরিবারভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে সফলগুলোর অন্যতম ছিল র‍্যালি ব্রাদার্স। উপমহাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৫২ সালে কলকাতায়। এর পর অঞ্চলে শতাধিক বছর ব্যবসা চালিয়েছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা এখানকার ব্রিটিশ শাসকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বরাবরই সখ্য বজায় রেখেছে। সামাজিকভাবেও তারা মিশে গিয়েছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে।

র‍্যালি ব্রাদার্সের ক্ষয় শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধের পর। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় তুরস্কের বৈরী হয়ে উঠেছিল গ্রিস। তাতে সমর্থন দিয়েছিল গ্রিক বণিকরা। উপমহাদেশে খিলাফত আন্দোলনের সময়ে কারণে ব্রিটিশদের পাশাপাশি গ্রিক বণিকদেরও বয়কটের ঘোষণা দেয়া হয়। সে সময়ের ধাক্কা সামলে নিলেও র‍্যালি ব্রাদার্সের জন্য সবচেয়ে বাজে সময় হয়ে আসে তিরিশের দশক। বৈশ্বিক মহামন্দার কালে সংকুচিত হয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা। দেশভাগের সময়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া বা এখান থেকে গুটিয়ে নেয়া নিয়ে দোটানায় ভুগতে থাকেন পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা। এক সময়ের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে প্রতাপশালী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান র‍্যালি ব্রাদার্স রূপ নেয় আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানে। তবে এত কিছুর মধ্যেও নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটি।

বিভিন্ন উৎসে পাওয়া তথ্য বলছে, র‍্যালি পরিবারের সর্বশেষ সদস্যকে ঢাকায় দেখা গিয়েছে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। র‍্যালি পরিবারের শেষ পুরুষ উত্তরাধিকার স্ত্রাতিস র‍্যালিস ওই সময় ঢাকা ভ্রমণে এসেছিলেন। তবে এখানে র‍্যালি ব্রাদার্সের কার্যক্রম শেষ হয় আরো পরে। কোম্পানির শেষ প্রেসিডেন্ট মি. ভ্লাস্তিস ছিলেন র‍্যালি পরিবারের জামাতা। ১৯৬৪ সালে কোম্পানি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর তাদের জন্য এখানে কার্যক্রম চালানো আরো কঠিন হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে তাদের ভারতের ব্যবসাও অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল টাটা গ্রুপ। তত্কালীন পূর্ববঙ্গে তাদের কার্যক্রম চালু ছিল ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত।

গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের সর্বশেষ সদস্য হিসেবে ঢাকা ত্যাগ করেছিল র‍্যালিরাই। তবে গ্রিক বণিকদের প্রস্থান শুরু হয়েছিল আরো অনেক আগে। ঐতিহাসিকরা বলছেন, অঞ্চলে গ্রিক বণিকদের বিকাশ ঘটেছিল প্রধানত কলকাতাকে ঘিরে। ঢাকায় অবস্থান করেছে গুটিকয়েক। তাদের মধ্যে উন্নতি করতে পেরেছে খুবই কম সংখ্যক ব্যবসায়ী। এখানে তাদের উপস্থিতির নিদর্শনও তেমন একটা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ঢোকার পর পরই মাঠের এক প্রান্তে চোখে পড়ে শতাব্দীপ্রাচীন এক স্থাপনা। ডোরিক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত স্থাপনাটি প্রকৃতপক্ষে এক সমাধিসৌধ। ঢাকায় অবস্থানকারী গ্রিক বণিকদের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে রয়েছে সমাধিসৌধটি। গোটা ঢাকায় সমাধিসৌধটি ছাড়া গ্রিক উপস্থিতির আর কোনো নিশানাই খুঁজে পাওয়া যায় না এখন। সমাধিসৌধটিও গড়ে উঠেছিল র‍্যালি ব্রাদার্স মঙ্গোস নামে আরেকটি বণিক পরিবারের আর্থিক সহায়তায়।

ইতিহাসবিদ শরিফ উদ্দীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রিক বণিকদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বর্তমানে টিএসসির সমাধিসৌধটিই অবশিষ্ট আছে। তবে তাদের বাণিজ্য বরিশাল, নারায়ণগঞ্জসহ অনেক অঞ্চলেই ছড়িয়ে ছিল। ফলে আরো কোথাও গ্রিকদের স্মৃতিচিহ্ন থাকা অস্বাভাবিক নয়। 

ঔপনিবেশিক আমলের ঢাকার গ্রিক বণিকরা ছিল খুবই ছোট একটি সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিল র‍্যালি ব্রাদার্স। এছাড়া শুরুর দিকে হাতে গোনা দুই-একজন ছাড়া ঢাকার গ্রিক বণিকদের মধ্যে আর কারো ব্যবসায়ে উন্নতির তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কথিত রয়েছে, এখানকার পরিবেশের সঙ্গেও খুব একটা খাপ খাইয়ে নিতে পারছিল না তারা।

গ্রিক বণিকরা ঢাকায় প্রথম পা রাখে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে। শুরুর দিকের গ্রিক বণিকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পানিয়াটিরা। তারা ছাড়া তাদের সমসাময়িক অন্য গ্রিকরা এখানে ব্যবসা করে উন্নতি করতে পেরেছে সামান্যই। লবণ, বস্ত্র চুনের ব্যবসায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অন্য বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। পরের দিকে এখানকার গ্রিকরাই এখানকার ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম ছিল শুধু র‍্যালি ব্রাদার্স। এছাড়া গ্রিকদের পক্ষে এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেয়াও ছিল বেশ কঠিন। সার্বিক ব্যবসায়িক পরিবেশ আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কারণে তারা ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ঢাকা ত্যাগ করা শুরু করে।

শুরুর দিকের গ্রিক ব্যবসায়ীরা লগ্নি করেছিলেন বস্ত্রের কারবারে। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লবণ চুনের ব্যবসায়ে ঝুঁকে পড়েন তারা। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম বরিশাল থেকে লবণ এনে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের আড়তে বিক্রি করতেন তারা। 

উপমহাদেশের গ্রিক বণিক সম্প্রদায়ের প্রথম প্রধান ছিলেন অ্যালেক্সিওস অ্যারগাইরি প্যানাসিওটিসটিস। কলকাতা থেকে ঢাকায় ব্যবসা স্থানান্তর করেছিলেন তিনি। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে তার উদ্যোগে ঢাকা কলকাতায় দুটি গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে কলকাতার আমড়াতলা স্ট্রিটে স্থাপিত চার্চ ভবনটি এখনো টিকে রয়েছে। ঢাকার চার্চটি ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়। সেটি আর পুনর্নির্মাণ করার মতো আর্থিক সংগতি ঢাকার ওই সময়ের ক্ষয়িষ্ণু ক্রমহ্রাসমান গ্রিকদের ছিল না। অ্যালেক্সিওস অ্যারগাইরির ছেলে আলেক্সান্ডার পানিয়াটিও লবণ চুনাপাথরের ব্যবসা করে বেশ লাভবান হয়েছিলেন।

ঢাকায় ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে গ্রিকদেরই আগমন হয়েছিল সবার পরে। তাদের মধ্যে সে সময় ঢাকা বা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কলকাতায়ই আগ্রহ ছিল বেশি। হাতে গোনা সংখ্যক হওয়ায় এখানে তেমন একটা প্রভাবশালী হয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি তারা। পরের দিকে র‍্যালি পরিবার সমৃদ্ধি অর্জন করলেও সামাজিক প্রভাবের চেয়ে ব্যবসায়ই বেশি আগ্রহ ছিল তাদের।

ইতিহাস বলছে, উনিশ শতকের মধ্যভাগেও প্রচুরসংখ্যক ইউরোপীয় বণিক ঢাকায় অবস্থান করে ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে গ্রিক পরিবার ছিল মাত্র ১২টি। সমসাময়িক বিবরণও বলছে, সতেরো থেকে আঠারো শতকের মধ্যে ঢাকায় অবস্থানকারী গ্রিকের সংখ্যা ছিল সব মিলিয়ে ২০০। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ব্যবসায়ী।

পর্ব-১ : কলকাতা-করাচিতে থাকলেও ঢাকায় নেই আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন