পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

একাডেমিক কার্যক্রম স্থবির হলেও থেমে নেই অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনার আগেও প্রাণচাঞ্চল্যপূর্ণ ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাঙ্গণ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় দিন-রাত মুখরিত থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা। কিন্তু ক্লাস-পরীক্ষা আবাসিক হল বন্ধ থাকায় সেসব প্রাঙ্গণ এখন পুরোপুরি নিষ্প্রাণ। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা নামমাত্র। স্থবিরতা এক বছরের বেশি সময় পেরোলেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এখনো করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারেনি। যদিও করোনার মধ্যেই নিয়োগে অস্বচ্ছতা দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আলোচনায় এসেছে বারবার। নিয়োগে অস্বচ্ছতাউন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ লোপাটসহ নানা প্রশাসনিক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য কর্তাব্যক্তিদের নামই উঠে এসেছে বারবার।

করোনাকালে আলোচনা-সমালোচনায় শীর্ষে থাকা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ঘিরে সৃষ্ট বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছেন সদ্যসাবেক উপাচার্য আবদুস সোবহান। তার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে নিজের কন্যা জামাতাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) তদন্তে অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পায় কমিটি। নিয়ে কমিটির প্রতিবেদনে উপাচার্যকে দায়ী করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ আনা হয়। সুপারিশটি আমলে নিয়ে রাবি উপাচার্য বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, উপাচার্যের ধরনের স্বজনপ্রীতি অনিয়মের কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

চিঠিতে অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া নিয়োগ কেন বাতিল করা হবে না সে বিষয়ে সাত কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

এছাড়া রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি নিয়মবহির্ভূতভাবে দখলে রাখার অভিযোগেরও প্রমাণ পায় ইউজিসির তদন্ত দল। অভিযোগটি আমলে নিয়ে ওই বাড়ির ভাড়া বাবদ লাখ ৬১ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে উপাচার্যকে। অভিযুক্ত উপাচার্যের বিরুদ্ধে গৃহীত কার্যক্রম ব্যাখ্যা চাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

সুযোগে উপাচার্য পদে মেয়াদের শেষ দিন ১৪১ জন শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে যান আবদুস সোবহান। নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে উপাচার্যের শেষ কর্মদিবসে দেয়া নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে।

অনিয়ম নিয়ে আলোচনায় থাকলেও করোনাকালে শিক্ষার দিক থেকে বেশ পিছিয়ে রয়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ বিভাগ ইনস্টিটিউটেই অনলাইনেও কোনো ক্লাস নেয়া হচ্ছে না। এছাড়া পরীক্ষা না নেয়ার কারণে জটে পড়েছেন বেশকিছু বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল যে কাজ, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেখান থেকে অনেক দূরে রয়েছে। দেশের করোনা শনাক্ত হওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় ধরে কার্যত অচল হয়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কার্যক্রম। সেটি নিয়ে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়কে খুব বেশি চিন্তিত বলেও মনে হচ্ছে না। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। বরং নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের সামনে আসছে। আসলে ইউজিসি তো কোনো তদন্ত সংস্থা নয়। এখন তদন্তের ভারে আমাদের পক্ষে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়ছে।

অনিয়মের অভিযোগে বারবার আলোচিত হয়েছে আরেক উপাচার্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবিঅধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্বক্ষণিক অবস্থানের শর্তে নিয়োগ পেলেও যোগদানের পর থেকে বেশির ভাগ কর্মদিবসেই ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। করোনাকালে চালানো ইউজিসির এক তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মে উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ কার্যক্রমে অনিয়ম স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ইউজিসির আরেকটি তদন্ত কার্যক্রম চলছে। গত কয়েক মাসে দফায় দফায় চিঠি দিয়েও অনিয়ম বিষয়ে উপাচার্যের কাছ থেকে কোনো জবাব পাননি ইউজিসির তদন্তকারীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ১০ জুন বেরোবি উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হবে। এজন্য নানা উপায়ে কালক্ষেপণের চেষ্টা করছেন তিনি। এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেরোবিতেও উপাচার্য মেয়াদের শেষদিকে অবৈধভাবে নিয়োগ-পদোন্নতির ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, উপাচার্য সম্প্রতি সিন্ডিকেট সভা ডেকে কিছু অবৈধ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিন্ডিকেট সদস্যদের বাধায় সেটি সম্ভব হয়নি। এখন তিনি মেয়াদের শেষদিকে এসে সিন্ডিকেট পুনর্গঠন করে কিছু অবৈধ নিয়োগ পদোন্নতি দেয়ার পাঁয়তারা করছেন।

আর্থিক প্রশাসনিক অনিয়ম নিয়ে সরব থাকলেও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের অবস্থা একদমই নাজুক। বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় বড় সেশনজটের কবলে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।

করোনাকালে আলোচনায় থাকা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে পাবনা বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও (পাবিপ্রবি) বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য এম রোস্তম আলীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলে করোনার মধ্যেই রাস্তায় নামেন সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তার বিরুদ্ধেও তদন্ত চালিয়ে কয়েকটি অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি।

বিষয়ে তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, পাবনা বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি উপাচার্য বাংলোকে গেস্ট হাউজ হিসেবে ব্যবহার করছেন, এটা অনিয়ম। বাড়ি ভাড়া হিসেবে প্রদেয় অর্থ পরিশোধ না করতেই তিনি এমনটি করেছেন। উপাচার্য পদাধিকারবলে একটি গাড়ি সুবিধা পাবেন। যদিও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নিজ পরিবারের জন্য রাজশাহীতে বাড়তি একটি গাড়ি দিয়ে রেখেছেন। সে গাড়ির চালক জ্বালানির খরচ দেয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে। এছাড়া তিনি ভর্তি পরীক্ষার আয় থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ অবৈধভাবে গ্রহণ করেছেন। অবশ্য তদন্ত চলাকালে তিনি অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে ফেরত দিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন