হুমকিতে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র

বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক

বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা বিশ্বের বৃহত্তম জোয়ার-ভাটার বনভূমি সুন্দরবন। এটি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ, আমাদের গর্ব। প্রাণিজ, জলজ বনজ মিলিয়ে অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদের আধার এটি। প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা এক অনন্য বন। অসংখ্য উদ্ভিদ প্রাণীর আবাসস্থল। তবে বেশ অনেক দিন ধরে সুন্দরবনে নানা বিরূপ পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে বনটির বাস্তুতন্ত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এটা অশনিসংকেত। বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন না হলে অদূরভবিষ্যতে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন যে অস্তিত্বের সংকটে পড়বে, তা সহজেই অনুমেয়।

ক্রমাগতভাবে সুন্দরবন সংকুচিত হচ্ছে, আয়তন কমছে। বনটির আজকের দুরবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, এজন্য দায়ী মানুষের অব্যাহত অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড। মানবসৃষ্ট কারণে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, এর অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের বদল ঘটছে। খবর মিলছে, দুই যুগের বেশি সময় ধরে বিশেষ করে বনটির পূর্বাংশের ছয় এলাকায় ভূমির উচ্চতা বেড়েছে দেড়-দুই ফুট। সেখানে ঢুকতে পারছে না জোয়ারের পানি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্যারাবনের বৃক্ষের শ্বাসমূলের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস। ব্যাঘাত ঘটছে বংশবিস্তারেও। বনভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে অগ্নিঝুঁকিরও একটা আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। উচ্চতার কারণে পাতা গুল্ম পচন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। বনের মাটিতে এসব পাতা গুল্মের আবরণ পড়ে এখন অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে। মৌয়াল বা অন্য কোনো উৎস থেকে আসা সামান্য আগুনের আঁচেই ঘটছে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। চলতি বছরেই পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় দুবার অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সর্বশেষ গত সোমবার দুপুরে দাসের ভারানী এলাকায় ঘটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বড় ক্ষতি হয় বনের। সংলগ্ন নদী খালগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। নদীগুলোর গভীরতা কমছে। সুন্দরবনসংলগ্ন শিবসা পশুর নদেও ডুবোচরের মাত্রা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে তেলদূষণ, শব্দদূষণ। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অবাধে চলছে পণ্য তেলবাহী জাহাজ। আসা-যাওয়া বাড়ছে পর্যটকদের। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে, অবৈধ উত্পীড়ন বাড়ছে। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বন্যপ্রাণীদের আবাসযোগ্যতা। চোরা কারবারিদের দৌরাত্ম্যে চলছে অবাধে বৃক্ষনিধন। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ের মুখে অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের আধার সুন্দরবন। এটা হতে দেয়া যায় না। কাজেই সুন্দরবন রক্ষায় বলিষ্ঠ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

আমরা দেখছি তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও ভারতীয় অংশের সুন্দরবন অনেকটা সুরক্ষিত। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো অক্ষুণ্ন রাখতে দেশটির বন বিভাগ অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করছে। তারা বনকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত করেছে। পর্যটক, মত্স্যজীবী বনজীবীদের আসা-যাওয়া অনেকাংশে রোধ করেছে। সংযোগ খাল সংলগ্ন নদীগুলো নিয়মিত খননের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাকৃতিক গঠন প্রক্রিয়া যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য তারা বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলে সেখানে বাঘ থেকে শুরু করে অন্য বন্যপ্রাণীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি প্যারাবনের গাছের সমাহারও বাড়ছে। তারা যদি তাদের অংশে বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে, আমরা কেন পারব না? তাদের অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে সুন্দরবন রক্ষায়ও আমাদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া চাই।

সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে আগুন লাগার ঘটনা বিরল। অথচ আমাদের এখানে অগ্নি-দুর্ঘটনা যেন একটা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। থেকে দুই দেশের বন বিভাগের দায়িত্বশীলতার একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায় বৈকি। প্রতিবার অগ্নিকাণ্ডের পরপরই কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে আগুন লাগা এড়াতে করা সুপারিশ বাস্তবায়িত হতে দেখা যায় না। বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী খাল খনন, অগ্নিকাণ্ডপ্রবণ এলাকায় দুই কিলোমিটার পরপর পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করা, চাঁদপাই রেঞ্জের ভোলা নদীর কোলঘেঁষে বনের পাশ দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ব্যবস্থা করার বিষয়ে জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ এখনো ওইসব সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। এটা হতাশাজনক। প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্যের অবসান জরুরি।

সুন্দরবনের সংযোগ খালগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। পলি জমে সংলগ্ন নদীগুলোর গভীরতা কমায় জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাস্তুতন্ত্রে। অবস্থায় খাল নদীগুলো নিয়মিত খনন করা প্রয়োজন। উজানে স্বাদু পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। সুন্দরবনের সৌন্দর্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। করোনাকালেও সেখানে পর্যটকদের আসা-যাওয়া বাড়ার খবর মিলছে। তাদের চলাচল সীমিত করতে হবে। নৌ-চলাচল, বিশেষ করে তেলবাহী জাহাজের চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে চোরাকারবারিদের তত্পরতা। মনে রাখা চাই, ম্যানগ্রোভ অরণ্য অন্য যেকোনো অরণ্য থেকে অনেক বেশি স্পর্শকাতর। এখানকার বাস্তুতন্ত্রের উপাদানগুলো জটিল বহুমাত্রিক। তাই বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিক শৃঙ্খল যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য কড়ই মেহগনির মতো প্যারাবনের প্রতিবেশ অনুপযোগী বৃক্ষরোপণ পরিহার করা প্রয়োজন। নইলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব স্বাভাবিকতা বজায় রাখা কঠিন হবে বৈকি।

শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য একটি অনন্যসাধারণ প্রাকৃতিক রক্ষাব্যূহও সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় বন। সাম্প্রতিক কালের আম্পান, বুলবুল, ফণী প্রভৃতি ঘূর্ণিঝড়কে বুক চিতিয়ে আগলেছে এটি। ফলে কমেছে সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি। অন্যদিকে বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশের দূষণ কমায়। দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ৫১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। পরিবেশগতভাবেও বড় সহায় এটি। তাই জাতীয় স্বার্থে সুন্দরবনের সুরক্ষা দরকার। বিষয়টি আমলে নিয়ে বনটি রক্ষায় সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেএটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন