রোহিঙ্গা

এগিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী এখন উদ্বাস্তু, বুনে চলেছে হিংসার বীজ

বণিক বার্তা ডেস্ক

গত নভেম্বরে কাতিবা আল-মাহদি ফি বিলাদ আল-আরাকান নামে রাখাইনভিত্তিক এক জঙ্গি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। সংগঠনটি নিজেকে ইসলামিক স্টেট অব খোরাসানের অংশ হিসেবে দাবি করেছে। একই সঙ্গে আনুগত্য ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের নেতার প্রতিও। মিয়ানমারের রাখাইনকে জিহাদের পরবর্তী স্থল ঘোষণা দিয়েছে তারা। এজন্য অন্যান্য দেশের জিহাদিদের রাখাইনে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।

সংগঠনটির ঘোষণা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। ধরনের সংগঠনের উত্থান বাংলাদেশ-ভারতসহ গোটা দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলবে বলে আশঙ্কা তাদের।

ধরনের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের আবির্ভাবের পেছনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দীর্ঘদিনের জাতিগত সহিংসতাকেই দায়ী করছেন পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। মুহূর্তে তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রবিবর্জিত জাতি। উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ মিয়ানমারে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। তাতমাদোর (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাখাইনসহ গোটা মিয়ানমারেই জাতিগত ধর্মীয় সহিংসতার চর্চা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এর সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা। দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত শিক্ষাবঞ্চিত থেকে যাওয়ায় তাদের মধ্যে দারিদ্র্য, গোঁড়ামি কুসংস্কারও ছড়িয়েছে অনেক বেশি। কারণে তাদের মধ্যে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি। কাতিবা নামের সংগঠনটির আত্মপ্রকাশও সেদিকেই নির্দেশ করছে।

অথচ এক সময় রোহিঙ্গারা ছিল শিক্ষিত একটি জনগোষ্ঠী। তাদের মধ্যে অনেকেই সম্পদশালীও ছিল। এক সময় সাবেক বার্মার (মিয়ানমার) ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে। মালিকানা ছিল প্রচুর কৃষিজমির। কারণে বার্মার স্বাধীনতার পর দেশটির জাতীয় পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের জায়গা করে নিতে কোনো অসুবিধাও হয়নি। পার্লামেন্টে জনপ্রতিনিধিত্ব থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পদে আসীন হয়েছে তারা।

কিন্তু দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন রোহিঙ্গাদের এখন বানিয়ে তুলেছে মিয়ানমারের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। জনপ্রতিনিধিত্ব বা সরকারের উচ্চপদে আসীন হওয়া দূরের কথাতাদের এখন শিক্ষার অধিকারও নেই। এমনকি তাদের আর মিয়ানমারের নাগরিক বলেও স্বীকার করতে চায় না দেশটির সরকার। নেপিদোর দাবি, রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গারা সব বাইরে থেকে আগত।

শুধু কাতিবা নয়, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একাধিক সশস্ত্র সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা লিবারেশন আর্মি রোহিঙ্গা ইনডিপেনডেন্স ফ্রন্ট (পরে নাম পরিবর্তন করে রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট), আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ইত্যাদি। সংগঠনগুলোর দাবি হলো রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার রাখাইনের স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতা দিতে হবে। নতুন আত্মপ্রকাশ করা কাতিবা নামের সংগঠনটি মিয়ানমারের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীসহ সংগঠনগুলোকেও নিজেদের শত্রু বলে ঘোষণা করেছে।

অন্যদিকে তাতমাদোও বিভিন্ন সময়ে এসব সংগঠনকে দমনের নামে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে। প্রতিবারই তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে ভয়াবহ সব নিপীড়নের অভিযোগ। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে রাখাইনে আরসার এক হামলার অজুহাতে অভিযান শুরু করে তাতমাদো। ওই অভিযানে বর্মি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ মাত্রায় নিপীড়ন জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালায়, যা বাংলাদেশকে ঠেলে দেয় আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ শরণার্থী সংকটের মুখে।

রাষ্ট্রের নিপীড়ন জাতিগত সহিংসতার কারণে রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশেই অনাহূত। বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিকদের মতে, সংকটের বীজ বপন হয়েছিল ব্রিটিশদের হাতে। ইতিহাস বলছে, রাখাইন তথা সাবেক আরাকান ব্রিটিশ শাসনের অংশ হয় ১৮২৬ সালে। অঞ্চলটি দখলের পর এখানেও বিভাজনের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা পোক্ত করার নীতি গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। এর ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ শাসকদের বেশ কাছাকাছিও চলে আসে। ফলে যে সময় গোটা বার্মায় স্বাধীনতার দাবি জোরালো হয়ে উঠছিল, সে সময় রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয়রা ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতার পথ ধরে। এর ফলে তারা শিক্ষাদীক্ষার দিক থেকেও বেশ এগিয়ে যায়। তবে রোহিঙ্গাদের এক অংশ সে সময় রাখাইন বর্মিসহ মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতোই ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করে এসেছে।

নেতৃস্থানীয়রা ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করায় রোহিঙ্গারা শাসকদের কাছাকাছি এলেও অন্যদের থেকে দূরে সরে যায়। দূরত্ব আরো বাড়ে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। মিয়ানমারের বর্তমান জাতিগত সব সংকটের শুরু ওই সময়েই। সে সময় সংখ্যাগুরু বর্মিদের মধ্যে স্বাধীনতার দাবি বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। তাদের মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন স্থানে কারেন, কাচিন, চিন আরাকানি রোহিঙ্গাসহ ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের কাজে লাগায় ব্রিটিশরা। তবে তাদের মধ্যকার কিছু কিছু অংশ স্বাধীনতার সমর্থনে জোরালো অবস্থানও নিয়েছিল।

জাতিগত বিরোধ আরো জোরালো হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি আগ্রাসন শুরুর পর। সময় স্বাধীনতার দাবিতে গড়ে ওঠা বার্মিজ ইনডিপেনডেন্স আর্মিকে (বিআইএ) সহায়তা দেয় জাপানিরা। ১৯৪২ সালে জাপানি বাহিনী ব্রিটিশদের আরাকান থেকে হটিয়ে দেয়। সময় বিআইএ থেকে বেরিয়ে আসা কতিপয় বিপথগামী স্থানীয় রাখাইনদের সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে উসকানি দেয় বর্মি ভিক্ষুরা। এরপর ব্রিটিশরা ওই এলাকা দখল করে নিলে এবার রোহিঙ্গারা স্থানীয় বৌদ্ধদের ওপর লুটপাট গণহত্যা চালায়। এক পর্যায়ে আরাকানের বিভিন্ন এলাকা বিভক্ত হয়ে চিহ্নিত হয়ে পড়ে মুসলমান এলাকা বা বৌদ্ধ এলাকা হিসেবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে এলাকায় বিপুলসংখ্যক অস্ত্র গোলাবারুদ রেখে যায় ব্রিটিশরা। অস্ত্রের দখল চলে যায় রোহিঙ্গাদের হাতে।

ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে শুরু হয় পাকিস্তান আন্দোলন। ওই সময় উত্তর আরাকান মুসলিম লিগ নামে একটি দল আন্দোলনে যোগ দেয়। দলটির দাবি ছিল, হয় আরাকানের স্বাধীনতা দিতে হবে, নয়তো পাকিস্তানের অংশ হিসেবে একে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ইতিহাস বলছে, সে সময় জিন্নাহসহ পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা আরাকানিদের আবেদনকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। ফলে ব্রিটিশরাও তাতে কর্ণপাত করেনি।

১৯৪৮ সালে জেনারেল অং সানের নেতৃত্বে স্বাধীন হয় বার্মা। দেশটি স্বাধীন হলেও স্বাধীনতা বা পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সংযুক্তির দাবি ছাড়েনি আরাকানি মুসলিম লিগ। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া অস্ত্রকে ব্যবহার করে সংঘাত শুরু করে তারা। তবে ১৯৫৭ সালের মধ্যেই তাদের দমন করতে সক্ষম হয় ইয়াঙ্গুন।

তবে সে সময়ও পরিস্থিতি বর্তমানের মতো শোচনীয় পর্যায়ে ছিল না। ১৯৫৮ সালে বার্মার তত্কালীন প্রেসিডেন্ট সাও শোয়ে থাইক ঘোষণা দেন, আরাকানি মুসলমানরা বার্মার আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর অন্যতম। ওই সময় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসূচক সরকারি পরিচয়পত্রও ছিল।

তবে সংকট আবার গভীর হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দেয় ১৯৬২ সালের দিকে। ঔপনিবেশিক শাসনে শুরু হওয়া বিরোধ চরমতম রূপ নেয় সামরিক শাসনে। ওই সময় সামরিক বাহিনী বার্মার ক্ষমতা দখল করে নেয়। ক্ষমতায় বসেই জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসূচক পরিচয়পত্র কেড়ে নেয় তারা।

১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করে। আইন বলবৎ হওয়ার পর নাগরিকত্ব হারায় রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের বাসিন্দাদের ভ্রমণ, ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি পেতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রয়োজন। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ দূরের কথা, তাদের নাগরিকত্ব দিতেই অস্বীকৃতি জানায় সামরিক জান্তা। এর বদলে তাদের পরিচয়পত্র দেয়া হয় বিদেশী হিসেবে। ফলে ভ্রমণ, বিয়ে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিসহ যেকোনো কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার সীমিত হয়ে পড়ে। জেঁকে বসে অশিক্ষা, কুসংস্কার গোঁড়ামি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন