ঢাবির অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ

৯৫% ভাউচারেই কারো স্বাক্ষর নেই

সাইফ সুজন

বিভাগের কোটি টাকার এফডিআর খোলা হয়েছে দুজন শিক্ষকের নামে। সম্মানীর নামে নিয়মবহির্ভূতভাবে ১৭ লাখ টাকা নিয়েছেন খোদ বিভাগের চেয়ারম্যান। সন্ধ্যাকালীন কোর্সের আয় থেকে নির্ধারিত অর্থ জমা দেয়া হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে। বেশির ভাগ আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রেই একাডেমিক কো-অর্ডিনেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিঅ্যান্ডডি) কমিটির অনুমোদন নেয়া হয়নি। পিপিআর অনুসরণ না করেই কয়েক লাখ টাকার কেনাকাটা করা হয়েছে। অর্থছাড়ের ক্ষেত্রেও সংরক্ষণ করা হয়নি কোনো ভাউচার। যেসব ভাউচার রয়েছে সেগুলোর ৯৫ শতাংশেই কারো সই নেই।

এসব অনিয়ম হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান (ক্রিমিনোলজি) বিভাগে। ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্তপাঁচ বছরে বিভাগটির নিজস্ব উৎস থেকে আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ধরনের অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। সময়ের বড় অংশজুড়েই বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক . জিয়া রহমান। নিরীক্ষায় উঠে আসা অনিয়মগুলোর বেশির ভাগই সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমানের সময়ে সংঘটিত হয়েছে। প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান দায়িত্ব গ্রহণ করেন গত বছরের ফেব্রুয়ারি। পাঁচ বছরের নিরীক্ষা সময়ে নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ-পরবর্তী সাত মাসে ক্রয়সংক্রান্ত কোনো লেনদেন হয়নি। তবে অস্থায়ী কর্মচারীদের বেতন, পরীক্ষাসংক্রান্ত, ওরিয়েন্টেশন দান-অনুদানের কিছু ব্যয় হয়েছে।

বিভাগের আবেদনের পরিপ্র্রেক্ষিতে নিরীক্ষাটি পরিচালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অডিট শাখার উপহিসাব পরিচালক খোরশেদ আলম সহকারী হিসাব পরিচালক (অডিট) মো. আহসানুল আলম। নিরীক্ষা শেষে মার্চ প্রতিবেদনটি বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আগে বিভাগের নিজস্ব উেসর আয়-ব্যয়ের কোনো নিরীক্ষা হয়নি। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের অনুমোদনক্রমে নিরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নিই। সম্প্রতি নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। আজ (সোমবার) একাডেমিক কমিটির সভায় পূর্বনির্ধারিত এজেন্ডা অনুযায়ী প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হলে সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান একজন শিক্ষক একাডেমিক কমিটির অনুমোদন ছাড়া নিরীক্ষা করায় প্রতিবেদন অগ্রাহ্য করেছেন মর্মে নোট দেন। বাকি দুজন শিক্ষক প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন। আমি সভায় বলেছি, যেহেতু একাডেমিক কমিটির কার্যপরিধিতে নিরীক্ষার জন্য অনুমতি গ্রহণের কোনো শর্ত নেই, তাই বিভাগীয় প্রধানের রুটিন কাজ হিসেবেই আমার নিরীক্ষা করানোর এখতিয়ার রয়েছে। এছাড়া কোষাধ্যক্ষ মহোদয়ের অনুমতি নিয়ে নিরীক্ষা হয়েছে। তাই সবার মতামতসহ প্রতিবেদনটি কোষাধ্যক্ষ কার্যালয়ে পাঠানো হবে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী অধ্যাপক জিয়া রহমান বিভাগটির চেয়ারম্যান পদে থাকাকালীন উন্নয়নকাজসহ বিভিন্ন বড় অংকের ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি। বিশেষ করে বিভাগের সিঅ্যান্ডডি একাডেমিক কমিটির কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি। এমনকি ব্যয়ের জন্যও কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে বিভাগীয় শ্রেণীকক্ষ সংস্কারের নামে ৪২ লাখ টাকা, ভারত মিয়ানমার ভ্রমণ বাবদ ১১ লাখ, ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের নামে লাখ, কনফারেন্সের অনুদান বাবদ লাখ, ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের আয়োজন বাবদ ১০ লাখ এবং কম্পিউটার অন্যান্য মালপত্র ক্রয় বাবদ ১২ লাখ টাকার বেশি অর্থ নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যয় করা হয়েছে।

অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হওয়া এসব ব্যয়ের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খরচের অনুমোদন ভাউচারগুলোতে চেয়ারম্যান মহোদয়ের সই নেই। বড় বড় খরচের ক্ষেত্রে কোনো কমিটির মাধ্যমে অর্থ ব্যয় হয়নি। এমনকি একাডেমিক কমিটির অনুমোদন না নিয়ে চেয়ারম্যান মহোদয় এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা নিয়মবহির্ভূত। এছাড়া ব্যয়ের সপক্ষে অনেক খরচেরই ভাউচার পাওয়া যায়নি এবং অনুমোদন নেই। কোনো কমিটির মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করা হয়নি। এমনকি যেসব ভাউচার পাওয়া গেছে, তার ৯৫ শতাংশেই কারো সই নেই, টাকা গ্রহণের প্রাপ্তি স্বীকারপত্র নেই। এমনকি হিসাবও সংরক্ষণ করা হয়নি। এছাড়া বেশকিছু চেকের মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করা হলেও কোনো ভাউচার পাওয়া যায়নি এবং কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে নিরীক্ষায় তা দেখাতে পারেনি।

নিরীক্ষায় উঠে আসা কয়েকটি অনিয়মের ক্ষেত্রে বিভাগটির তত্কালীন চেয়ারম্যানের নাম উঠে এসেছে। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের আয় থেকে সম্মানী বাবদ ১৭ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন খোদ চেয়ারম্যান, যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। এছাড়া পারিশ্রমিক গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর বাবদ ১১ দশমিক ১১ শতাংশ অর্থ যোগ করে সম্মানী গ্রহণ করলেও আয়করের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে মূল টাকা থেকে ১০ শতাংশ হারে আয়কর কর্তন করেছেন। এছাড়া সাবেক চেয়ারম্যানের মেয়াদকালীন সিঅ্যান্ডডির সুপারিশ নিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে দুজন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি। অস্থায়ী কর্মচারীদের বেতন প্রদানের সঙ্গে উত্তোলনের হিসাব সঠিক নয়। আবার এক্ষেত্রে ধারাবাহিকতাও রক্ষা করা হয়নি। এছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে মোট কোটি টাকার এফডিআর খোলা হয়েছে দুজন শিক্ষকের নামে।

এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে কয়েকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি অধ্যাপক জিয়া রহমান। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাননি তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক . মো. আখতারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, আমি নিজেও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সে অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একটি দেয়াল ভাঙার কাজ করতে হলেও সিঅ্যান্ডডি কমিটির অনুমোদন নিতে হয়েছে। আর বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিজেই সব কাজ না করে সবাইকে নিয়ে করলে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনেকাংশেই কমে যায়। আমার মতে, বিভাগের সব ধরনের কাজে একাডেমিক কমিটি সিঅ্যান্ডডির অনুমোদন বা মতামত নিতে হবে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেই কমিটিগুলোকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন