একজন ধবধবে সাদা মানবাধিকার কর্মীকে দেখেছি

এম মাহফুজুর রহমান

২০১১ সালের কথা। তখন আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। একটা প্রোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে বসে আছি। দেখলাম ধবধবে সাদা কিন্তু সেলাই-জোড়াবিহীন থান কাপড়ে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। চুলগুলোও দেখার মতো- ঝকঝকে সাদা। শুভ্রকেশী ওই ভদ্রলোকের পরিচয় পেলাম একটু পরেই। ঘোষণা এলো এখন বক্তব্য দেবেন  লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। এই প্রথম তার কথা শুনছি। তাকে দেখছি। যদিও তার লেখাগুলো পড়ছি অনেক আগে থেকেই।

বছরখানেক পরে কাছে থেকে সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয় তার সঙ্গে। সেদিন দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামে। একটি সেমিনারে। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এবং কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন ওই সেমিনারে। অনেক দিনের প্রশ্ন ছিল তিনি সাদা কাপড়ে থাকছেন কেন? ভাবলাম প্রশ্নটা সরাসরি এবার তাকেই করে দেখি। সঙ্গে ৩-৪ জন বন্ধু। সেমিনার থেকে বেরিয়ে যেতে শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল মকসুদের কাছে বিষয়টা নিয়ে জানতে চাইলাম।

উত্তর করলেন এভাবে, ‘২০০৩ সালে ইরাকে শুরু হওয়া মার্কিন আগ্রাসন নিয়েতো জানো। সেই আগ্রাসনের বিরোধিতাস্বরূপ এই কাপড়। যেকোন ধরনের আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমি। যেকোনরকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরূদ্ধে আমার এই প্রতিবাদ। মৃত্যু অবধি চলবে আমার প্রতিবাদ।’ অবনত মস্তকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। বিনম্রচিত্ত কুর্নিশ জানিয়েছিলাম তার মানবতাবোধকে।

পরে জেনেছি, তিনি ঘোষণা দিয়েই এই সেলাইবিহীন কাপড়ে সতর ঢাকছেন। কথা রাখলেন। দেখালেন এটা শুধু কথার কথা নয়। প্রতিবাদের অর্থেই প্রতিবাদ করেছেন তিনি। পুরো জাতি অন্তত তাই দেখলো। মৃত্যু অবধি তিনি পশ্চিমাদের উদ্ভাবিত ওই সেলাই করা কাপড় পরিধান করলেন না। এক কাপড়েই থাকলেন। মৃত্যু পর্যন্তই তিনি তার মানবাধিকারের ব্রত পালন করে গেলেন। দেখালেন ঘূণে ধরা সমাজব্যবস্থায় একজন আবুল মকসুদ ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য কতটা বিস্তর! বুঝিয়ে গেলেন দেখ কিভাবে ব্রত পালন করতে হয়। কনকনে শীতে কিংবা প্রচণ্ড গরমে অথবা বর্ষা; কোন সময়ই তাকে দেখিনি এই সেলাইবিহীন সাদা পাতলা কাপড়টা ভিন্ন অন্য কিছুতে।

ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সময় কেবল শৈশব ছেড়ে কৈশরে। এসময় জাতীয়-বিশ্ব রাজনীতি অতকিছু বুঝতাম না। তবে ইরাকে মার্কিন হামলার খবর বিবিসি রেডিওতেই শুনেছি প্রথম। সপ্তাহে একটি করে পত্রিকা আমার নিজ আগ্রহেই সংগ্রহ করতাম। খুঁটিয়ে পড়তাম সেগুলো। দেখতাম ফলাও করে ছাপানো হতো মার্কিন হামলার খবর। গ্রামে থেকে খবর পেতাম ঢাকাসহ সারা দেশে মার্কিন বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে। বিক্ষোভ হচ্ছে অন্যান্য অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোতেও। ইত্যকার আরও কতকি!

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ বারাক ওবামার ঠিক আগের প্রেসিডেন্ট। বুশ ইরাকে হামলা পরিচালনা করে বিশ্ব ইতিহাসে খলনায়ক হয়ে গেলেন। কারণ ইরাকে হামলা ছিলো মিথ্যা অজুহাতে। সাদ্দাম হুসেনের হাতে- গণবিধ্বংসী মারণাত্মক অস্ত্র রয়েছে, এর থেকে আমেরিকাকে বাঁচাতে হবে- এমন অযৌক্তিক এক সাজানো গল্পে ইরাকে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে আমেরিকা। যুদ্ধে ইরাকে হাজার-হাজার মার্কিন, ব্রিটিশ ও অন্যান্য দেশের সৈন্য এবং লাখ লাখ নিরীহ মানুষ নিহত হন।

সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহতের মধ্য দিয়ে ইরাককে এক ধ্বংস্তুপে পরিণত করে মার্কিনি গোঁয়ারেরা। মূলত সাদ্দাম ও তার সরকারের পতনই ছিলো বুশ প্রশাসনের মূল লক্ষ্য। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে যে ইরাকের কাছে কোনোদিনও কোনো মারণাস্ত্র ছিলো না, পাওয়া যায়নি। সারা বিশ্ব ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিলো আমেরিকার বিরুদ্ধে। বলা হয়, এই সময়েই ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ওঠে।

তার প্রশাসনের একেবারেই শেষ দিকে ২০০৮ সালে ইরাক সফরে গিয়েছিলেন জর্জ ডাব্লিউ বুশ। সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে ৩০ বছর বয়সী এক ইরাকি টিভি সাংবাদিক মুনতাজার আল-জাইদি বুশকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করেছিলেন। সামাজিকমাধ্যমে সেই ভিডিও ছড়িয়ে যায় মুহুর্তেই। সারাবিশ্বে সেদিন হাসির পাত্র হয়েছিলো আমারিকা। ঘৃণা কত চরমে থাকলে একজন মানুষ অন্যকে জুতো নিক্ষেপ করতে পারে! সৈয়দ আবুল মকসুদও আমেরিকাকাণ্ডে ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। ঘৃণা ভরে এসবের প্রতিবাদ করেছেন।

তার মানবাধিকারের মানস নিয়েই বলতে চাই আজ। তার লেখালেখির বিষয়ে নাইবা বললাম। দেশ, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি, মানবাধিকার কিংবা পরিবেশ হেন বিষয় নেই যে বিষয়ে তিনি লিখেননি। কত সহজ আর প্রাঞ্জল তার ভাষার ব্যবহার! বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বা বাসসের উপবার্তা সম্পাদক ছিলেন আবুল মকসুদ। অন্যায়ের প্রতিবাদ স্বরূপ ছেড়ে দেন সেই চাকরিটাও। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ছাত্র-শিক্ষক পেশাজীবী-জনতার আন্দোলন সবকিছুতেই সবার আগে দেখতাম তাকে।

প্রতিবাদ করেছেন রোহিঙ্গা নিধনের বিরুদ্ধে, ইসরাইলিদের ফিলিস্তিনি নির্যাতন ইস্যুতে, ভারতের কাশ্মির সংকটে কিংবা চীনের উইঘুর নিয়েও। দেশে-বিদেশে সবধরণের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিপক্ষে ছিলেন তিনি। কাজ করেছেনন পরিবেশকর্মী হিসেবে। রাস্তায় দেখা গেছে নদী ও বন রক্ষার আন্দোলনে। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে চষে বেড়িয়েছেন দেশের সর্বত্র।

সৈয়দ আবুল মকসুদের সাদা পোশাকের মতোই তার মনটাও ছিলো সাদা আর কলুষমুক্ত। সবসময় যতটুকু পেরেছেন ন্যায়ের পক্ষেই কথা বলেছেন সেটা যার বিরুদ্ধে বা পক্ষেই যাক না কেন। আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামের পরেও অনেক সভা-সেমিনারে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। জ্ঞানের ভারে ন্যূব্জ কিন্তু দীপ্তিমান ছিলেন আবুল মকসুদ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার দেখেছি তাকে। যেখানেই নায্য দাবির পক্ষে মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন সেখাইনে দেখা গেছে সাদা কাপড়ের আবুল মকসুদকে।

পোশাকের মতোই ব্যক্তিগত জীবনটাও তার কতটা নির্মল! একটি ঘটনা স্পষ্টভাবে মনে দাগ কেটে আছে। একবার শিক্ষার্থীদের কি এক প্রোগ্রামে গিয়েছিলেন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বক্তব্য দিলেন। সভা শেষে চলে যাচ্ছেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। বাসায় যাবার জন্য সভা থেকে রাস্তায় নেমে নিজেই সিএনজি ডাকতে লাগলেন। আমরা কয়েকজন দৌঁড়ে গিয়ে সিএনজি ডেকে দিলাম। কিন্তু কিছুতেই তিনি সিএনজির ভাড়া দিতে দিলেন না! বললেন, ‘প্রোগ্রামে এসেছি তাতে সিএনজি ভাড়া দিতে হবে কেন তোমাদের?’ কী নির্মোহ! কী নির্লোভ! কী আত্মসম্মান-আত্মোপলোব্ধি! সহজ-সরল জীবন তার।

‘বুদ্ধিজীবী’ নামে যারা ফায়দা লোটেন তারা কী করতেন? হয়তো বলতেন, বাসা-শহীদ মিনার-বাসা একটি চার পা ওয়ালা উবার ডেকে দিও ভাই। নইলে কেমনে যাই তোমাদের সভায়! তার সঙ্গে অন্য ‘অনেক বুদ্ধিজীবী’র পার্থক্য হল- তিনি বুদ্ধি বেচে খাননি বরং বুদ্ধিকে মানবকল্যাণে কাজে লাগিয়েছেন। সমাজে আহমদ ছফাদের; আবুল মকসুদদের বড়ই প্রয়োজন।

মানবাধিকার নিয়ে কীভাবে কথা বলতে হয়, প্রতিবাদ করতে হয় সেটা শিখিয়ে গেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। বুদ্ধিজীবীদের কীভাবে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বুদ্ধির নির্মোহ চর্চা করতে হয় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন যুবসমাজকে। বিচিত্র বিষয়ে তার লেখাগুলো সমাজ নিয়ে ভাবাতে উদ্বুদ্ধ করতো। বিশেষত শিক্ষার্থী-যুবকদের কাছে তিনি আদর্শের প্রতীক। তার গভীর কিন্তু সহজ-সরল জীবনবোধ থেকে; দেশ ও মানুষের জন্য তার সুগভীর মমত্ববোধ থেকে কতটুকু শিক্ষা নিতে পারবো আমরা? দুই খণ্ড সেলাই ছাড়া সাদা চাদরওয়ালা, মানবতার ফেরিওয়ালার কথা মনে থাকবে আজীবন।

এম মাহফুজুর রহমান: লেখক এবং ওয়ালটনের গণমাধ্যম শাখার ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর

ই-মেইল: [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন