নিজাম উদ্দিন আহমদ চেয়ারম্যান, মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি আইনের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সদস্য। সম্প্রতি বীমা দিবস উপলক্ষে খাতটির বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুসা মিয়া
বাংলাদেশের
বীমা খাতের
বর্তমান অবস্থা
ও ভবিষ্যৎ
নিয়ে আপনি
কতটা আশাবাদী?
বাংলাদেশের
বীমা শিল্পের ভবিষ্যৎ ইতিবাচক। আমি প্রায় ৩৫ বছর বীমার সঙ্গে আছি। একটা সময় দেশে বীমা শিল্পের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আইডিআরএ প্রতিষ্ঠা ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির নজর দেয়ার ফলে বীমা গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার সংখ্যা কমে গেছে। এসব কারণে বাংলাদেশে বীমা শিল্পের অবস্থা দিন দিন ভালোর দিকে যাচ্ছে। বীমা মেলা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বীমা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমরা একটি জাতীয় বীমা দিবস পেয়েছি। গ্রামগঞ্জে বীমার প্রচার হচ্ছে। একটা সময় মানুষ বীমার মাধ্যমে প্রতারিত হতো। এখন এ ধরনের প্রবণতা কমেছে। তাছাড়া প্রতারণা করা হলে ওই কোম্পানি আর টিকতে পারবে না। যারা ভালো কাজ করছে তারা ক্রমেই উন্নতি করছে। তাই যারা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তারা বীমা শিল্পে থাকতে পারবে না। তাই বলব বীমা শিল্পের ভবিষ্যৎ ক্রমেই ভালোর দিকে যাচ্ছে।
করোনার
কারণে বীমা
শিল্পে কী
ধরনের প্রভাব
পড়েছে?
লকডাউনের
সময় সবকিছু বন্ধ ছিল, আমাদের কর্মীরা কাজ করতে পারেনি। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে করোনায় ক্ষতি কম হয়েছে। সে হিসাবে করোনার প্রভাবে আমাদের ব্যবসা কমে গেলেও বর্তমানে আবার বেড়েছে। কোম্পানিগুলো যদি পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থে কাজ করে, তাহলে বীমা শিল্পের অগ্রগতি হবে। মানুষের হাতে অর্থ আছে, দেশ অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে। ফলে মানুষ বীমা করতে আগ্রহী হবে। বীমা শিল্পের উন্নয়নে কাজ করছে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন। তারা কোম্পানিগুলোকে ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট।
করোনার
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে
বীমা খাতে
কী ধরনের
নতুন চ্যালেঞ্জ
তৈরি হয়েছে?
প্রথমত,
বীমা গ্রাহকদের পক্ষে কাজ করতে হবে। তারা যাতে বীমার দাবি পায় ও লাভবান হয়—এটা নিশ্চিত করতে হবে। আরো নিশ্চিত করতে হবে কেউ যেন বীমা করে প্রতারিত না হয়। পাশাপাশি বীমা কর্মীদের সুশিক্ষিত করা জরুরি। তারা যেন এ কাজের মাধ্যমে ভালো উপার্জন করতে পারে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের বীমা শিল্পে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। বীমা কর্মী হিসেবে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের নিয়োগের বিষয়টি বর্তমানে চ্যালেজিং। তবে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।
বাংলাদেশের
সব মানুষকে
বীমার আওতায়
আনার কথা
বলা হচ্ছে—আপনারা
বিষয়টি কীভাবে
অর্জন করবেন?
বীমা
কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন সেক্টরের মানুষদের কাছে যেতে হবে। তাদের বীমার গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে হবে। সারা বিশ্বে বীমা বাধ্যতামূলক। স্বাস্থ্য বীমা থেকে স্কুল বীমা রয়েছে। আমাদের দেশেও ব্যাংক ইন্স্যুরেন্স শুরু হচ্ছে। যারা বিদেশে যাবেন, যাওয়ার আগে বীমা করে যাবেন। আইডিআরএ ও সরকার যদি বীমার দিকে নজর দেয় তাহলে সমস্যার সমাধান হবে। দেশের মানুষের যে একেবারেই বীমার প্রতি আস্থা নেই তা কিন্তু নয়। এ বছরও আমরা অনেক টাকা প্রিমিয়াম পেয়েছি। মানুষের আস্থা আছে এবং আস্থার পরিমাণ বাড়াতে হবে। মানুষের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে হবে।
করোনার
কারণে প্রযুক্তিনির্ভরতা
বেড়েছে। নতুন
চ্যালেঞ্জ তৈরি
হয়েছে। বাংলাদেশের
বীমা খাত
এ চ্যালেঞ্জ
মোকাবেলার জন্য
কতটা প্রস্তুত?
প্রতিটি
বীমা কোম্পানি এখন সচেতন। সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও সজাগ। স্কুলছাত্র থেকে শুরু করে বয়স্কদের সাহায্য করার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বীমা কোম্পানিগুলো। বিগত বছরগুলোর তুলনায় সামনের বছরগুলোতে বীমা শিল্প আরো বেশি অগ্রসর হবে।
কিছু
বীমা কোম্পানির
বিরুদ্ধে বীমা
দাবি পরিশোধ
না করার
অভিযোগ রয়েছে...
একটা
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি গড়তে হলে বীমা বিধি অনুসরণ জরুরি। আমাদের বেশির ভাগ কোম্পানি কিন্তু সে বিধি মোতাবেক গড়ে ওঠেনি। তবে এখন অনেক কোম্পানি এর আওতায় আসছে। অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধে বদনাম নেই। আমি আমাদের মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কথা বলতে পারি। এবার আমরা ৩০০ কোটি টাকা শুধু মানুষের ক্লেইম ইন্স্যুরেন্স পরিশোধ করেছি। আমাদের কোম্পানির কোনো পলিসিহোল্ডারই বলতে পারবেন না যে আমি ক্লেইম ম্যাচুরিটি পাইনি। কেউ যদি ক্লেইম ম্যাচুরিটি পাননি বলে দাবি করেন, তাহলে আমরা তা পরিশোধ করতে বাধ্য। তবে কিছু কোম্পানি যে গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করে না এ অভিযোগও রয়েছে।
দাবি
পরিশোধ না
করার কারণে
তো গ্রাহকের
আস্থার সংকট
তৈরি হচ্ছে?
পলিসিহোল্ডাররা
ভালো কোম্পানির কাছেই তাদের পলিসি করবে। আমরা কিন্তু দেখছি যে ভালো কোম্পানিগুলো ক্রমেই ভালো করছে। যে কোম্পানির নামে বদনাম আছে মানুষ কিন্তু তাদের পরিহার করছে। তাই কোম্পানিগুলো যদি বীমা বিধি মেনে চলে, পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থে চলে তাহলে পলিসিহোল্ডাররা কেন তাদের টাকা পাবে না, অবশ্যই পাবেন।
পণ্য
বৈচিত্র্যকরণ নিয়ে
কথা হচ্ছে।
বাংলাদেশের জনগণ
যেমন চায়
সে ধরনের
পণ্য উন্নয়নের
সংকট রয়েছে—আপনি
কি বিষয়টির
সঙ্গে একমত?
হ্যাঁ,
আমি একমত। অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ বিভিন্ন ধরনের পলিসি চাইছে। আমাদের এখানে ম্যারেজ পলিসি এমনকি ডিভোর্স পলিসিও রয়েছে। শিশুদের জন্য বিভিন্ন পলিসি আছে। গৃহ বীমা, শিক্ষা বীমা রয়েছে। তবে আমাদের আরো উন্নতি করতে হবে। নতুন নতুন পলিসি আনতে হবে। এক একটা কোম্পানির ক্ষেত্রে বিষয়গুলো এক এক রকম। তবে যারা আধুনিক হবে না কিংবা পণ্য বৈচিত্র্যকরণ করবে না তারা ক্রমেই পিছিয়ে পড়বে। কোম্পানিগুলোর বোর্ড ও বীমা অ্যাসোসিয়েশন এখন বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিয়েছে। যারা সমস্যাগুলো আমলে নেবে না তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। জীবন বীমা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জনগণের কোম্পানি, পলিসিহোল্ডারদের কোম্পানি। তারা যদি সন্তুষ্ট না হয় তবে অন্য কোনো কোম্পানি বা বিদেশী আরো ভালো কোনো কোম্পানির কাছে চলে যাবে।
বীমা
পণ্য বৈচিত্র্যকরণের
জন্য অ্যাকচুয়ারির
যে সংকট
রয়েছে এটাকে
কীভাবে মেটানো
যায়?
ভারতে
বীমা কোম্পানিগুলোতে ন্যূনতম ৭ থেকে ৫০ জন অ্যাকচুয়ারি রয়েছেন। আমাদের মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বয়স ২৫ বছর। এখন পর্যন্ত আমরা একজন অ্যাকচুয়ারিও নিয়োগ দিতে পারিনি। কারণ আমাদের দেশে এ পেশায় লোক নেই। আমরা যদি দেশে অ্যাকচুয়ারি তৈরি করতে চাই, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অ্যাকচুয়ারি সায়েন্স পড়াতে হবে। বিদেশ থেকে কোনো অ্যাকচুয়ারি আনা হলে তাকে ২০ লাখ টাকা বেতন দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকচুয়ারি সায়েন্স পড়ানো শুরু করেছে। প্রতিটি বীমা কোম্পানি যদি দুই থেকে তিনজন করে অ্যাকচুয়ারি নিয়োগ দেয়, তাহলে কোম্পানিগুলো সঠিক নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
এ
খাতে দক্ষ
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের
অভাবের কথাটিও
শোনা যায়...
কোম্পানির
বোর্ডকে এক্ষেত্রে সচেষ্ট হতে হবে। দক্ষ, যোগ্য ও সৎ লোকের পাশাপাশি এমন এমডি নিয়োগ দিতে হবে যিনি সব ধরনের নিয়ম-নীতি জানেন। উপযুক্ত ব্যক্তিটি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে না বসেন তাহলে আমানত খেয়ানত হয়ে যেতে পারে। বোর্ডকে সচেষ্ট থাকতে হবে। বলতে দ্বিধা নেই যে বোর্ডের কিছু কর্মকর্তাও দুর্নীতি করছেন। যদি সত্যিকারের সুফল পেতে হয় তাহলে সবাই মিলে সচেষ্ট হতে হবে। বীমা কোম্পানি জনগণের কোম্পানি, এখানে জনগণের অর্থ রয়েছে—বিষয়টির দিকে সজাগ থাকলেই পলিসিহোল্ডাররাও উপকৃত হবে।
ব্যাংক
খাত ঘিরে
মানুষের আস্থা
তৈরি হয়েছে,
এক্ষেত্রে বীমা
খাত কেন
পিছিয়ে থাকল?
এখন
কিন্তু আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছে। মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স গত বছর ৩৫০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম পেয়েছে। আমাদের কোম্পানিতে ৫০ হাজার নিয়মিত কর্মী রয়েছে। আমাদের প্রতি যদি আস্থা না থাকত তাহলে মানুষ আমাদের টাকা দিত না। বীমা খাত নিয়ে একসময় যে বদনাম ছিল তা ক্রমেই ঘুচে যাচ্ছে। অনেক কোম্পানি এখন গ্রাহকদের ব্যাপারে সচেতন। আমি মনে করি ধীরে ধীরে জীবন বীমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে।
উন্নত
বিশ্বের প্রতিটি
মানুষের বীমা
রয়েছে। বাংলাদেশ
উন্নত দেশের
পথে অগ্রসর
হচ্ছে। সেক্ষেত্রে
প্রতিটি মানুষকে
বীমার আওতায়
নিয়ে আসার
বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আপনি কি
তা অর্জন
করা সম্ভব
বলে মনে
করেন?
সাধারণ
মানুষ যদি বীমার মাধ্যমে উপকৃত হয় তবে তারা বীমা করতে আগ্রহী হবে। আবার অনেক পলিসিহোল্ডার না বুঝে বীমা করে। দ্বিতীয় বর্ষেও যে তাকে বীমা পলিসি দিতে হবে তা অনেক সময় সে বুঝে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে অদক্ষ বীমা কর্মীদের দায় রয়েছে। কারণ অনেক সময় তারা গ্রাহককে বিষয়টি ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হয় না। কোনো একভাবে প্রথম বর্ষের অর্থটা উঠিয়ে নিতে চায়। গ্রাহক যদি দ্বিতীয় বর্ষের অর্থ পরিশোধ না করে তাহলে তার অর্থটা খোয়া যায়। তবে দ্বিতীয় মেয়াদ পরিশোধ করে তৃতীয় বা চতুর্থ মেয়াদের অর্থটা যদি না-ও দেয় সেক্ষেত্রে সে তার সব অর্থ ফেরত পাবে—এটা আর বোঝায় না। তাই বীমা খাতে দক্ষ কর্মী নিয়োগ দেয়া জরুরি।
শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস