বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতির সুপারিশ

উত্তরণ-পরবর্তী প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন

২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের খাতায় নাম লিখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। খবরটি নিঃসন্দেহে আনন্দের। উত্তরণ যে ঘটতে চলেছে, তা অবশ্য আমাদের অজানা ছিল না। শর্ত অনুসারে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) নির্ধারিত মান অর্জনে সফলভাবেই উতরে গেছি আমরা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী মুজিব বর্ষ উদযাপনের ক্ষণে দ্বিতীয়বারের মতো সুপারিশ প্রাপ্তি দেশের জন্য বড় ধরনের অর্জন বটে। অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য আগামী পাঁচ বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক আঞ্চলিক পরিবেশ-পরিস্থিতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূল নয়। বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়েই আমাদের আগামী বছরগুলোতে অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যেতে হবে। তাছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নতুন করে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আসবে বাংলাদেশের সামনে, যা মোকাবেলার প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন।

এবার বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল লাওসও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ পেয়েছে। নেপাল ২০১৮ সালেই দ্বিতীয়বারের মতো উত্তরণের মানদণ্ড অর্জন করে। তবে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাদের সময় লেগে যায়। তাই নেপালের নীতিনির্ধারকরা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রতিবেশী আঞ্চলিক অংশীদার দেশগুলোতে বর্ধিত ব্যবসায়ের সুযোগ অন্বেষণের বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছেন। এর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হিসেবে জোর দিচ্ছেন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে। বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর থেকে ক্রমবর্ধমান সমর্থন এবং বৃহত্তর এফডিআই প্রতিশ্রুতি আদায়ে মনোযোগী তারা। লক্ষ্যে পরিবহন ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে দেশটি। রফতানি সম্প্রসারণ রফতানি বৈচিত্র্যকরণে বিবেচনায় নিচ্ছে কম্বোডিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো এশিয়ার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতাগুলো।

তবে এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এখন যেসব বাণিজ্য সুবিধা পায়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সেগুলো পাবে না। যেমন রেয়াতি সুদের ঋণ পাওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক সুবিধা, মেধাস্বত্ব সুবিধা ইত্যাদি কমে যাবে। ফলে বিশ্ববাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরো প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। বাড়তি বোঝা হিসেবে রয়েছে বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী। দেখা গেছে, ধরনের নানা কারণে অনেক দেশ এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সমস্যায় পড়েছে। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেছে; রফতানি, বিদেশী সহায়তা, রেমিট্যান্সও কমেছে।

আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া চাই। অভিযোগ রয়েছে দেশে বাণিজ্য বিনিয়োগের পরিবেশ এখনো ব্যবসাবান্ধব নয়। উদ্যোক্তাদের পদে পদে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হয়রানি মোকাবেলা করতে হয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ-অবকাঠামোগত সমস্যা এখনো প্রকট। বিশ্ব বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারলে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ বাড়ানোর পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। সেজন্য জ্বালানি অবকাঠামোগত ঘাটতি দূর করা জরুরি। রফতানি খাতে তৈরি পোশাকের ওপর অধিক নির্ভরতা নয়, বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর। বিনিয়োগকারীদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি সুদক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ব্যাপক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। লক্ষ্যে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। অধিক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে। তাছাড়া প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় এগিয়ে থাকতে হলে বাংলাদেশকে এখন থেকেই জিএসপি প্লাস প্রাপ্তির শর্তগুলো পূরণের প্রস্তুতি গ্রহণে মনোযোগী হতে হবে। কেননা এলডিসি-পরবর্তী শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আসতে হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশের সামনে মানবাধিকার শ্রমমান সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক রীতি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই শ্রমিকবান্ধব দেশ হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখার পাশাপাশি মনোযোগী হতে হবে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে। পাশাপাশি পণ্য বৈচিত্র্য রফতানি বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে পোশাকের মতো সম্ভাবনাময় অন্য পণ্য।

বাংলাদেশের প্রতিযোগী অনেক দেশই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের অবস্থা সুসংহত করতে সক্ষম হয়েছে। ভিয়েতনাম যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এর অধীনে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ইইউর বাজারে ভিয়েতনামের পণ্য শূন্য শুল্ক সুবিধা পাবে। চীন ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনাময় বড় বাজার। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর চীনের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে ১৬ দশমিক শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। অবস্থায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। চীনের পাশাপাশি জাপান, ভারতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। নতুন সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ লাভজনক হবে।

অস্বীকারের উপায় নেই যে এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের সামনে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। যখনই আমরা মধ্যম উন্নতের মর্যাদায় উঠে যাব, তখনই সরকারি ব্যক্তি অর্থায়নের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশী বিনিয়োগ আমাদের খুব দরকার। মধ্যম আয়ের দেশ হলে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাবে। আস্থাও অনেক বাড়বে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের। উত্তরণের পর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, যা বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তাই নিজস্ব প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এখন থেকেই উত্তরণ-পরবর্তী প্রস্তুতি শুরু করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন