সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করা হোক

সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা অগ্রাধিকার নিশ্চিতে দেশভিত্তিক র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। নেপাল, পাকিস্তান শ্রীলংকাও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) করপোরেট গভর্ন্যান্স ইন সাউথ এশিয়া: ট্রেন্ডস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস শীর্ষক প্রতিবেদনে হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। ভালো করপোরেট গভর্ন্যান্সের চারটি পিলার রয়েছে। অ্যাকাউন্টেবিলিটি (দায়), ফেয়ারনেস (সততা), ট্রান্সপারেন্সি (স্বচ্ছতা) রেসপনসিবিলিটি (দায়িত্বজ্ঞান) চারটি পিলার বাস্তবায়নই একটি কোম্পানিকে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত তালিকাবহির্ভূত সব কোম্পানিতেই করপোরেট সুশাসনের বড় ধরনের ঘাটতি দৃশ্যমান। করপোরেট সুশাসনের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করা হলেও অধিকাংশ কোম্পানিই তা এড়িয়ে চলছে। আইনের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

করপোরেট সুশাসন নিশ্চিতের ধারণা থেকে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালক পদ সৃষ্টি করা হয়। স্বতন্ত্র পরিচালক একাধারে একজন নন-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নন-শেয়ারহোল্ডিং ডিরেক্টর। পদটি তৈরির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নন-এক্সিকিউটিভ স্বতন্ত্র পরিচালকদের ক্ষমতা প্রদানের মধ্য দিয়ে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং, অডিট রেমুনারেশন কমিটিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যাতে কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থ তথা সব বিনিয়োগকারী বিশেষ করে সংখ্যালঘু শেয়ার মালিকদের স্বার্থে তারা সব ধরনের স্বার্থগত দ্বন্দ্ব অথবা যেকোনো ধরনের অনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করেন। কিন্তু আইন প্রয়োগের দূর্বলতায় কাঙ্খিত ফল মিলছে না। উন্নত দেশগুলো এরই মধ্যে স্বতন্ত্র পরিচালকদের ক্ষমতায়নের জন্য নতুন নতুন চিন্তা গবেষণার ফল পেতে শুরু করেছে। অথচ আমরা রয়ে গেছি সেই তিমিরেই; সংখ্যাগুরুদের দ্বারা পরিচালিত কোম্পানির যুগেই। বরং আইনের মারপ্যাঁচে সংখ্যাগুরুরা আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে।

স্বতন্ত্র পরিচালক ধারণাটি আমাদের দেশে দেড় দশকেরও বেশি পুরনো। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে কোম্পানিগুলোয় স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে সে লক্ষ্য কতটুকু পূরণ হচ্ছে, সে প্রশ্ন এসেই যায়। স্বতন্ত্র পরিচালকরা আদৌ যথাযথভাবে কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে অবদান রাখতে পারছেন কিনা সেটিও ভাবার সময় এসেছে। অডিট কমিটির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্বতন্ত্র পরিচালককে। অডিট কমিটির প্রধান হিসেবে তার কাজ কোম্পানির সব আর্থিক অনিয়ম অসংগতি উদ্ঘাটন করা এবং তদনুযায়ী পর্যদ সভাকে অবহিত করা। পাশাপাশি বার্ষিক সাধারণ সভায় সব শেয়ারহোল্ডারকেও বিষয়টি অবহিত করার বিধান রাখা হয়েছে। অধিকন্তু পর্যদ সভা বিষয়টি আমলে না নিলে কমিশনকে অবহিত করার বিধানও রাখা হয়েছে। এর অর্থ হলো পরিচালনা পর্ষদ- জ্ঞান দক্ষতায় বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পরিচালনা পর্ষদ- স্বতন্ত্র পরিচালকের অন্তর্ভুক্তির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে, যা করপোরেট সুশাসনের অন্যতম উপাদান। অথচ তাদের ওই কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে যে সময় এবং শ্রম দিতে হবে তার জন্য পারিশ্রমিকের হার খুবই কম। প্রতিবেশী ভারতে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক বছরে গড়ে তার চেয়ে সাত গুণ বেশি আয় করেন। 

উন্নত দেশের মতো বিএসইসির করপোরেট গভর্ন্যান্স কোডে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণে স্বতন্ত্র পরিচালকদের সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলো যেন স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারে তার জন্য যোগ্যতার শর্ত বেঁধে দেয়া হয়েছে। অথচ যোগ্যতার শর্তগুলোর ফাঁক গলে নিজেদের পছন্দের লোককে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। অতএব বাংলাদেশের উচিত যত দ্রুত সম্ভব স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটি পুল বা প্যানেল তৈরি করা। উপরন্তু যোগ্যতার শর্তগুলোর ফাঁক গলে দুর্বলচিত্তের কাউকে যাতে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া না যায় সেজন্য স্বতন্ত্র পরিচালক প্যানেল তৈরির কোনো বিকল্পও নেই। স্বতন্ত্র পরিচালক প্যানেল গঠিত হলে বিএসইসির করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড আরো শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং কোম্পানিগুলোতে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা বাড়বে। কারণ যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালকরাই পুঁজিবাজারে করপোরেট সুশাসনের মূল শক্তি। পাশাপাশি বিএসইসির উচিত স্বতন্ত্র পরিচালকসহ অন্যান্য পরিচালক যেন কোম্পানিগুলোতে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেন সে লক্ষ্যে ইনস্টিটিউট অব ডিরেক্টর্স প্রতিষ্ঠা করে তাদের প্রশিক্ষিত করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবদান রাখতে সাহায্য করা।

বাংলাদেশে করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড প্রণয়ন করা হয়েছে, যা যেকোনো বিচারে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে এর প্রয়োগ নিয়ে। তদারকির দুর্বলতার সুযোগে অধিকাংশ তালিকাভুক্ত কোম্পানি কোড অব কন্ডাক্ট সঠিক কার্যকরভাবে অনুসরণ করছে না। এক্ষেত্রে বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়া প্রয়োজন। চেয়ারম্যান বোর্ডের সদস্যরা সিইওদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সিইওদের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যে করপোরেট গভর্ন্যান্সের অধিকাংশ বিষয় মানা প্রতিটি কোম্পানির জন্য বাধ্যতামূলক। শুধু তা- নয়, নিয়মিত বিরতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের কার্যক্রম তদারকপূর্বক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পরামর্শ প্রদান আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য তাদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান সক্ষম করে তুলতে হবে। দক্ষ জনবলের সন্নিবেশ ঘটানো এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার পরামর্শও এসেছে এডিবির প্রতিবেদন থেকে। তারা দক্ষিণ এশিয়ায় তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট গভর্ন্যান্স নিশ্চিত করতে দুটি পরামর্শ দিয়েছেকোম্পানি পরিচালনায় স্বতন্ত্র পরিচালকদের শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি। আইনের যথাযথ প্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে। আমরা চাইব, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট গভর্ন্যান্স উন্নত করার মাধ্যমে সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন