আলোকপাত

পেট্রোলিয়াম পণ্য পরিবহন, মজুদ বিতরণ, বিপণন নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে

এম শামসুল আলম

জানুয়ারি ১৪, ২০২১ তারিখে বিইআরসি আয়োজিত এলপিজির গণশুনানিতে ভোক্তাপক্ষ বাধ্য হয়ে এখন দাম নির্ধারণে বিইআরসি শিরোনামে ওইদিন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছে, ওই খবরে বলা হয়েছে যে বিইআরসি পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের খুচরা মূল্যহার নির্ধারণ প্রবিধানমালার খসড়া তৈরি করে এবং ২০১২ সালে জ্বালানি বিভাগে পাঠায়। কিন্তু আজ অবধি তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে দাম নির্ধারণ নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর জ্বালানি বিভাগ গত ২৩ ডিসেম্বর বিইআরসিকে চিঠি দিয়ে শুধু এলপিজি নিয়ে একটি প্রবিধানমালা তৈরি করতে বলেছে। বিষয়ে জ্বালানি সচিব বলেছেন, আট বছরেও প্রবিধানমালা তৈরি করতে না পারার দায় পুরোপুরি বিইআরসির। ফলে দায় নির্ধারণে শুনানিতে প্রথমেই নিচের তথ্যাদি পেশ করা হয়

() ওই প্রবিধানমালা উপেক্ষা করে জ্বালানি বিভাগ এলপিজি অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করে এবং . অনুচ্ছেদ মতে এলপিজির খুচরা মূল্যহার নির্ধারণ পদ্ধতি প্রণয়নক্ষমতা নিজের হাতে নেয়। পদ্ধতি প্রণীত না হওয়ায় বিইআরসি সে মূল্যহার নির্ধারণ করতে পারেনি। () বিইআরসি কর্তৃক জ্বালানি বিভাগকে প্রদত্ত ০২.১২.২০২০ তারিখের এক পত্রে বলা হয়, পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের (এলপিজিসহ) মূল্যহার (ট্যারিফ) নির্ণয়সংক্রান্ত () পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের খুচরা ট্যারিফ প্রবিধানমালা, ২০১২, () পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ মজুদকরণ, বিপণন বিতরণ ট্যারিফ প্রবিধানমালা, ২০১২, এবং () পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ পরিবহন ট্যারিফ প্রবিধানমালা, ২০১২ ভেটিংয়ের জন্য বিইআরসি থেকে ওই বিভাগে পাঠানো হয়। আরো বলা হয়, এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০১৭ অনেক ক্ষেত্রেই বিইআরসি আইন, ২০০৩-এর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরস্পরবিরোধী। অথচ নীতিমালা মতে বিইআরসি এলপিজির খুচরা মূল্যহার নির্ধারণ পদ্ধতি প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করে। কমিটি পদ্ধতি তথা ফর্মুলা প্রণয়ন করে। তাতে জ্বালানি বিভাগের মতামতও চায়। () আইন কোর্ট কর্তৃক বলবেযাগ্য। নীতিমালা নয়। ফলে আইনের সঙ্গে নীতিমালা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। যদি হয়, তাহলে আইন কার্যকর হবে, নীতিমালা নয়। ওই কার্যক্রমে জ্বালানি বিভাগ বিইআরসি উভয়ই উল্টোটি করেছে। ফলে বিইআরসি আইন বিইআরসির কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছে। () বিইআরসি আইনের ৫৮ ৫৯ ধারা মতে, সরকার বিইআরসির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে বিধিমালা এবং বিইআরসি সরকারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রবিধানমালা প্রণয়ন করবে। আইনে উল্লিখিত কোনো বিষয়ে সরকার বিইআরসির মতপার্থক্য বা বিরোধ দেখা দিলে তা নিষ্পত্তির বিধান ২৬ ধারায় বর্ণিত আছে। এলপিজিসহ ২৫টি পেট্রোলিয়াম পদার্থের মূল্যহার নির্ধারণ প্রবিধানমালাগুলো নিয়ে যে পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে, তা ধারায় নিষ্পত্তিযোগ্য। আইনি এমন নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিইআরসি তার কার্যক্রমের দ্বারা নিজেকে জ্বালানি বিদ্যুৎ উভয় বিভাগের অধীন করে রেখেছে। ফলে বিইআরসির স্বাধীনতা নিরপেক্ষতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এখন সেসব মূল্যায়ন করা আবশ্যক। () মূল্যহার নির্ধারণ পদ্ধতি প্রবিধানমালা দ্বারা নির্ধারিত হয়। বিইআরসি আইন ২০০৩ মতে, প্রবিধানমালা প্রণয়নের এখতিয়ার বিইআরসির। বিইআরসি আলোচ্য প্রবিধানমালাগুলো প্রণয়ন করেছে। তা আটকে রেখে জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগ ওই লাইসেন্সিং নীতিমালা ২০১৭ তৈরি করে এবং এলপিজির মূল্যহার নির্ধারণ পদ্ধতি প্রণয়নের ক্ষমতা নিজে গ্রহণ করে। তাতে বিইআরসি আইন লঙ্ঘন এবং বিইআরসির কর্তৃত্ব খর্ব হয়, যা বিইআরসি আইনের ৪২ ধারা মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। () ২৫..২০২০ তারিখে হাইকোর্ট গণশুনানির ভিত্তিতে এলপিজির মূল্যহার নির্ধারণ করার আদেশ দেন। সে আদেশ বলবৎ থাকা অবস্থায় কোনো কোনো ব্যবসায়ী এলপিজির মূল্যহার অবৈধভাবে এক বা একাধিকবার বৃদ্ধি করেন। ফলে অবৈধ মূল্যবৃদ্ধি এবং মূল্যবৃদ্ধিতে জড়িত লাইসেন্সিদের লাইসেন্স বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে বিইআরসি আইনের ৪৩ ধারা মতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্যাব বিইআরসির কাছে ১১.১০.২০২০ তারিখে আবেদন জানায়। অথচ বিইআরসি নিষ্ক্রয় থাকে। () বিইআরসির নিষ্ক্রিয়তা অবৈধ ঘোষণা এবং বিইআরসি আইনের ২২() ৩৪ ধারা মতে, এলপিজির মূল্যহার পুনর্নির্ধারণের আদেশ চাওয়ায় ক্যাবের রিট মামলায় ১৩.১১.২০১৬ তারিখে রুল ইস্যু হয় এবং ২৫..২০২০ তারিখে আদেশ হয়। () আদেশ প্রতিপালিত না হওয়ায় ২৯.১১.২০২০ তারিখে কোর্ট অবমাননা মামলা রুজু হয়। ফলে বিইআরসি .১২.২০২০ তারিখ থেকে আদেশ বাস্তবায়ন শুরু করে। আদেশ বাস্তবায়ন চলছে। পাশাপাশি কোর্ট অবমাননা মামলাও চলছে।

উল্লিখিত তথ্য-প্রমাণাদিতে দেখা যায়, এলপিজিসহ পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের মূল্যহার নির্ধারণসংক্রান্ত প্রবিধানমালাগুলো আট বছরেও তৈরি না করার দায় কেবল বিইআরসির নয়, জ্বালানি বিভাগেরও। ব্যাপারে বিইআরসির নিষ্ক্রিয়তা জ্বালানি বিভাগের অভিপ্রায়েরই প্রতিফলন।

কোর্টের আদেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উল্লিখিত তথ্যাদি বিইআরসির বিবেচনার জন্য গণশুনানিতে পেশ করা হয়। মূল্যহার প্রস্তাবগুলো মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বিইআরসির কারিগরি কমিটির (টিসি) সুপারিশ: () মাসভিত্তিক মূল্যহার পরিবর্তন এবং () সরকারি কোম্পানি এলপিজিসিএলের এলপিজির মূল্যহার ৬০০ থেকে ৯০৪ টাকা বাড়ানো দুটি সুপারিশের প্রতি শুনানিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়, উচ্চ আদালত ভোক্তার জ্বালানি অধিকার স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে গণশুনানির ভিত্তিতে এলপিজির মূল্যহার নির্ধারণের আদেশ দেন। সে আদেশ বাস্তবায়নে আয়োজিত গণশুনানিতে টিসি এমন সব সুপারিশ উপস্থাপন করেছে, তাতে ভোক্তারা ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে রবীন্দ্রনাথের গল্পে রাজা পখিটিকে পোষ মানাতে রাজ পণ্ডিতকে আদেশ দিয়েছিলেন, পণ্ডিত যেমন বুঝতে পারেননি যে পোষ মানাতে তিনি যা কিছু করেছেন, তাতে পাখিটি মারা গেছে; বিইআরসিও তেমন বুঝতে পারেনি যে ওই সুপারিশগুলো গৃহীত হলে ভোক্তা স্বার্থ অধিকার সুরক্ষা নয়, পাখিটির মতো মারা যাবে। বিষয়টি প্রশ্ন-উত্তরে নিম্নরূপভাবে স্পষ্ট করা হয়:

() হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে গণশুনানিতে বলা হয়, বিইআরসি কর্তৃক এলপিজির মূল্যহার পুনর্নির্ধারণের চূড়ান্ত আদেশ না হলে কোর্টের আদেশ প্রতিপালিত হয়েছে বলা যাবে না। () বিইআরসি স্বাধীন নিরপেক্ষ, বিইআরসি আইন দ্বারা তা ঘোষিত নিশ্চিত। আইনের ৩৪() ধারা মতে, ভোক্তা স্বার্থ সুরক্ষা এবং ২২() ধারা মতে অসাধু ব্যবসা প্রতিরোধ করা বিইআরসির অন্যতম দায়িত্ব। তাছাড়া ২২() ধারা মতে, ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি করাও বিইআরসির দায়িত্ব। এসব দায়িত্ব পালনে বিইআরসির নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণিত। () ২০০৮ সালে গ্যাসের এবং ২০১২ সালে বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণে বিইআরসি যে মানদণ্ড অনুসরণ করে, এলপিজি অটোগ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণ প্রস্তাবগুলো মূল্যায়নে সেই মানদণ্ডই অনুসরণ করা সমীচীন। অথচ তা অস্পষ্ট। () বিইআরসি এর আগে এলপিজিসহ পেট্রোলিয়াম পদার্থের মূল্যহার নির্ধারণসংক্রান্ত তিনটি ভিন্ন প্রবিধানমালা প্রণয়ন করেছে। টিসি কোন প্রবিধানমালা অনুসরণে প্রস্তাবগুলো মূল্যায়ন করেছে, তাও অস্পষ্ট। পদ্ধতি/ফর্মুলা নির্ধারণ কমিটি প্রণীত ফর্মুলা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ফর্মুলা/পদ্ধতি বিইআরসি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। () শুনানিতে উপস্থাপিত যে দুটি ফর্মুলার ভিত্তিতে ভোক্তাপর্যায়ে এলপিজি অটোগ্যাসের মূল্যহার মাসভিত্তিতে নির্ধারণ করার প্রস্তাব টিসি করেছে, তা ওই আইনের ৩৪() উপধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। () বিইআরসি আইনের ৩৪()() উপধারা মতে, এনার্জি সঞ্চালন, বিপণন, সরবরাহ মজুদকরণ ব্যয়ের সঙ্গে মূল্যহার সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। সরকারি কোম্পানি এলপিজিএল কর্তৃক দাখিলকৃত এলপিজির মূল্যহার পরিবর্তন প্রস্তাব মূল্যায়নে টিসি স্বীয় বিবেচনায় ক্রস সাবসিডি ফান্ড বাবদ সিলিন্ডারপ্রতি ৩৩৩.২৪ টাকা প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাব আইনের ওই উপধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। রাজস্ব চাহিদা এমন সামঞ্জস্যহীনভাবে বৃদ্ধি করে মূল্যহার নির্ধারণ করা বিইআরসির এখতিয়ারবহির্ভূত। () ক্রস সাবসিডির ধারণা অলোচ্য ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর। জ্বালানি বেশি খরচের ভোক্তার কাছ থেকে বেশি মূল্যহার আদায় করে জ্বালানি কম খরচের ভোক্তার কম মূল্যহারে সমন্বয়ই ক্রস সাবসিডি। () সরকারি এলপিজির মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় শুনানিতে বলা হয়েছে, এলপিজিসিএল বাজার হারাবে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সেবা প্রতিষ্ঠানের মতোই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। () টিসি এলপিজিতে ভর্তুকির সুপারিশ করেছে। বলা হয়েছে, সুপারিশ টিসির স্বতঃপ্রণোদিত। আসলে তা কমিশনেরই প্রস্তাব। এখানে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট কমিশন সদস্য প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। অথচ তা গোপন করা হয়। তাকে প্রধান করে টিসি গঠিত হলে নানা বিতর্কের অবসান হতে পারে। সরকার বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহরের নীতি গ্রহণ করেছে। এলপিজিতে ভর্তুকি প্রদানের ব্যাপারে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তবে সরকারের কাছে ভর্তুকির প্রস্তাব করা যেতে পারে। () টিসির প্রতিবেদনে এলপিজির টনপ্রতি জাহাজ ভাড়া ধরা হয়েছে ১০০ ডলার। টিসি জাহাজ ভাড়া কমানোর লক্ষ্যে যে কৌশল গ্রহণের প্রস্তাব করেছে, সে প্রস্তাব মতে যৌক্তিক ভাড়া ৭০ ডলারের অধিক হয় না। ১০০ ডলার ভাড়া হারে টিসি প্রস্তাবিত মূল্যহার সিলিন্ডারপ্রতি (১২ কেজি) ৮৬৬ টাকা সিলিং প্রাইস হতে পারে। সেক্ষেত্রে ফ্লোর প্রাইসও থাকা দরকার। () লাইসেন্সিদের ২১ জায়গা থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। প্রতিটি জায়গায় তাদের ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে হয়রানির শিকারও হতে হয়। অসাধু ব্যবসা প্রতিরোধের লক্ষ্যে তাদের জন্য ওয়ান স্টপ সেবা বিবেচনা করা দরকার। () বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের .১১.২০১৯ তারিখের পরিপত্র মতে এলপিজি ব্যবসায়ী হতে হলে এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) সদস্য হতে হবে। ফলে লোয়াব এখন লাইসেন্স প্রদানকারী নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির লাইসেন্স প্রদানের ক্ষমতার অংশীদার, যা বিইআরসি আইনের ২২() উপধারা এবং ২৮ ৬৬ ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। () এলপিজি বটলিং প্লান্ট স্থাপন লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০১৬ এবং এলপিজি অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০১৭ প্রণয়ন করে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষমতা জ্বালানি বিভাগ নিজে গ্রহণ করেছে, যা বিইআরসি আইনের ওই সব ধারা উপধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উভয় নীতিমালা চ্যালেঞ্জ করে করা রিট মামলা এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। () ভোক্তা পর্যায়ে বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যহার, মান মাপে এলপিজি/অটোগ্যাস সরবরাহের ব্যাপারে লাইসেন্সি দায়বদ্ধ। এলপিজি/অটোগ্যাস সরবরাহে ভোক্তা সুরক্ষা নিরাপত্তা লাইসেন্সি কর্তৃক নিশ্চিত করার লক্ষ্যে লাইসেন্সির সক্ষমতা উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেই এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমও সমন্বয়হীন। () বিইআরসি আইনের ৩৪() উপধারা মতে, মূল্যহার পরিবর্তন প্রস্তাব প্রদানের এখতিয়ার একমাত্র লাইসেন্সির। লাইসেন্সি না হওয়ায় ক্যাবের প্রদত্ত বিদ্যুতের মূল্যহার পরিবর্তন প্রস্তাব বিইআরসি আমলে নেয়নি। অথচ লোয়াবের প্রস্তাব আমলে নিয়েছে, বিইআরসি আইনের সঙ্গে যা অসংগতিপূর্ণ। তবুও ভোক্তা পক্ষ অসংগতিতে এবারের জন্য আপত্তি দেয়নি। শুনানিতে বলা হয়েছে, পেট্রোবাংলা সব লাইসেন্সির পক্ষে এক সময় এককভাবে মূল্যহার পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তা গৃহীত হয়নি। প্রতিটি লাইসেন্সিকে এখন পৃথক প্রস্তাব দিতে হয়। এলপিজির বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা তৈরির জন্য লাইসেন্সিদের সক্ষমতা উন্নয়ন দরকার। মানসম্মত প্রস্তাব প্রণয়নে সক্ষমতা অর্জনও সে উন্নয়নের অংশবিশেষ। () ..২০২১ তারিখে প্রদত্ত ক্যাবের গণশুনানি পূর্ব অভিমত সুপারিশগুলোর একটিও টিসি বিবেচনায় নেয়নি। ফলে টিসির মূল্যায়ন সুপারিশ ভোক্তা স্বার্থ অধিকার সুরক্ষায় সীমাবদ্ধতার শিকার। () টিসির প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগের ২৫.১২.২০২০ তারিখের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য এলপিজির মূল্যহার পুনর্নির্ধারণ বিষয়ক মূল্যায়ন প্রতিবেদন। যে গণশুনানির ভিত্তিতে মূল্যহার নির্ধারণের ব্যাপারে কোর্টের আদেশ রয়েছে, সে আদেশ বাস্তবায়নে অনুষ্ঠিত সে গণশুনানিতে উপস্থাপিত টিসির ওই সুপারিশগুলো বিইআরসি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং ভোক্তা স্বার্থ অধিকারবিরোধী। ফলে তা অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য।

ভোক্তা স্বার্থ অধিকার সুরক্ষায় গণশুনানিতে ভোক্তাপক্ষ নিম্নের সুপারিশ/প্রস্তাবগুলো পেশ করে:

() জ্বালানি বিভাগ কর্তৃক প্রণীত এলপিজি বটলিং প্লান্ট স্থাপন লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০১৬ এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা ২০১৭ বিইআরসি আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় উভয় নীতিমালা বাতিল এবং ২০১২ সালে বিইআরসি কর্তৃক প্রণীত ভোক্তা পর্যায়ে পেট্রোলিয়াম পদার্থের মূল্যহার নির্ধারণসংক্রান্ত তিনটি প্রবিধানমালা (জ্বালানি বিভাগে আটকে আছে) গেজেটে প্রকাশের প্রস্তাব করা হয়। উভয় প্রস্তাব এক মাসের মধ্যে কার্যকর করার অনুরোধ করা হয়। গণশুনানির সূত্রে অনুরোধ বিইআরসি থেকে জ্বালানি বিভাগকে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। তাছাড়া এলপিজির মূল্যহার নির্ধারণের জন্য পৃথক প্রবিধানমালা করার ব্যাপারে জ্বালানি বিভাগের প্রস্তাব অযৌক্তিক অগ্রহণযোগ্য, ভোক্তাদের অভিমতও ওই পত্রে অন্তর্ভুক্ত করে জ্বালানি বিভাগকে জানানোর প্রস্তাব করা হয়।

() এলপিজি ব্যতীত অন্য ২৪টি পেট্রোলিয়াম পদার্থের মূল্যহার গণশুনানির ভিত্তিতে নির্ধারণের লক্ষ্যে এক মাসের মধ্যে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বিইআরসিকে অনুরোধ জানানা হয়। বিইআরসির লাইসেন্সি হিসেবে বিপিসির দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার জন্যও অনুরোধ করা হয় ভবিষ্যতে কেবল একক লাইসেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত প্রস্তাবগুলোর ওপর গণশুনানি নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়। লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া লোয়াবের প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের .১১.২০১৯ তারিখের পরিপত্র বাতিলের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পত্র দেয়ার প্রস্তাব করা হয়।

() ক্রস সাবসিডি ফান্ড বাবদ সিলিন্ডারপ্রতি এলপিজিসিএলের জন্য যে রাজস্ব চাহিদা ধরা হয়েছে, তা বিইআরসি আইনের ৩৪()() উপধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই তাতে ভোক্তাপক্ষের আপত্তি রয়েছে। বিপিসি কর্তৃক নির্ধারিত টনপ্রতি সরকারি এলপিজির পাইকারি মূল্যহার ৩৫৭.৮৯ টাকা ন্যায্য যৌক্তিক কিনা তা যাচাই-বাছাইক্রমে ওই আইন মতে, নির্ধারিত রাজস্ব চাহিদার ভিত্তিতে মূল্যহার নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়। অন্যথায় ভোক্তা পর্যায়ে ৬০০ টাকা মূল্যহার পরিবর্তন না করা এবং সুবিধাভোগীদের পরিবর্তে ওই মূল্যহারে এলপিজিসিএলের এলপিজি বস্তিবাসী স্ট্রিট ফুড ভেন্ডরদের মধ্যে বিতরণের আদেশ প্রদানের প্রস্তাব করা হয়।

() সম্প্রতি বিইআরসি আইনের ৩৪() উপধারা পরিবর্তন করে মূল্যহার কোনো অর্থবছরে একবারের স্থলে একাধিকবার পরিবর্তন করার বিধান করা হয়েছে। এলপিজির ক্ষেত্রে তা মাসভিত্তিক করার প্রস্তাব ওই আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় টিসির প্রস্তাবে ভোক্তাপক্ষ আপত্তি দিয়েছে। তাছাড়া এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার বিইআরসির নেই বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেছে।

() টিসির প্রস্তাব মতে টনপ্রতি এলপিজির জাহাজ ভাড়া ১০০ ডলার বিবেচনা করা যায়, বলা হয়েছে। তবে সে ভাড়াসহ বেসরকারি লাইসেন্সি কর্তৃক এলপিজি/অটোগ্যাস সরবরাহ চেইনের বিভিন্ন সেগমেন্টে যেসব ব্যয় সংযোজন হয়, সেসব ব্যয় ন্যায্য যৌক্তিক কিনা তা অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পক্ষগণের মতামতের ভিত্তিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করা হয়।

() এলপিজির মূল্যহার (১২ কেজি সিলিন্ডার প্রতি) ভোক্তা পর্যায়ে লোয়াব কর্তৃক প্রস্তাব করা হয়েছে হাজার ২৫৯ টাকা। টিসির মূল্যায়নে তা ৮৬৬ টাকা। প্রতি লিটার অটোগ্যাসের মূল্যহার ৪০.৮০ টাকা। তাতে প্রোপেন বিউটেন অনুপাত ৪০:৬০। টিসির প্রস্তাবিত মূল্যহার সিলিং প্রাইস হিসেবে নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়।

() কোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে মূল্যহার নির্ধারণ প্রক্রিয়া যেন জটিলতামুক্ত এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়, সেজন্য পেট্রোলিয়াম পদার্থের মূল্যহার নির্ধারণসংক্রান্ত ২০১২ সালে বিইআরসি কর্তৃক প্রণীত তিনটি প্রবিধানমালায় বর্ণিত মূল্যহার নির্ধারণ পদ্ধতিগুলো অবলম্বে এলপিজি অটোগ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়।

() তবে এলপিজিতে ভর্তুকি প্রদান প্রস্তাব বিইআরসি আইনের ২৪() ধারার আওতায় সরকারের কাছে পেশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি প্রণয়নের জন্য পক্ষগণ প্রতিনীধি সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়।

() অসাধু ব্যবসা প্রতিরোধকল্পে লাইসেন্সিদের জন্য ওয়ানস্টপ সেবা প্রদান এবং তদর্থে বিইআরসি আইনের ৩৪() উপধারা বলে কেবল এক স্থান তথা বিইআরসি থেকে লাইসেন্স প্রাপ্তি নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়। সেবা প্রদান গাইডলাইন প্রণয়নের দায়িত্ব নং সুপারিশে প্রস্তাবিত কমিটির ওপর অর্পণ করার প্রস্তাব করা হয়।

(১০) ভোক্তা পর্যায়ে বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যহার, মান মাপে এলপিজি/অটোগ্যাস সরবরাহের ব্যাপারে লাইসেন্সি দায়বদ্ধ। ভোক্তা সুরক্ষা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও লাইসেন্সি দায়বদ্ধ, তা নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়।

(১১) ২৫..২০২০ তারিখে কোর্টের আদেশের পর যেসব এলপিজি/অটোগ্যাসের মূল্যহার এক বা একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে, সেসব বৃদ্ধিজনিত সমুদয় অর্থ আদায় করা এবং যেসব লাইসেন্সি মূল্যবৃদ্ধিতে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়।

পরিশেষে সুপারিশে বলা হয়, সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় গ্যাস বিদ্যুৎ খাতকে মনোপলিমুক্ত করা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ডে পরিণত করার লক্ষ্যে আনবান্ডিলিং করে গ্যাস অনুসন্ধান, গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন বিতরণের জন্য পৃথক কোম্পানি করা হয়েছে। সেসব কোম্পানি বিইআরসি আইনের আওতায় পৃথক প্রবিধানমালার অধীনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ওই একই লক্ষ্যে তরল জ্বালানি তথা এলপিজিসহ ২৫টি পেট্রোলিয়াম পণ্য পরিবহন, মজুদকরণ, বিতরণ বিপণনকে আনবান্ডিলিং করার মাধ্যমে গ্যাস বিদ্যুতের অনুরূপ পৃথক কোম্পানি করে পৃথক প্রবিধানমালার অধীনে বিইআরসি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়নি। প্রস্তাবিত প্রবিধানমালাগুলো আটকে রেখে জ্বালানি বিভাগ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করেছে। ফলে প্রস্তাবিত প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করে ২৫টি পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহকে বিইআরসির নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ভোক্তাপক্ষ তাগিদ দিয়েছে।

 

এম শামসুল আলম: বিদ্যুৎ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন