স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক

অনিয়মে বাস্তবায়ন হয়নি বিটিসিএলের তিন প্রকল্প

সুমন আফসার

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইন্টারনেট সংযোগের নিরবচ্ছিন্নতা অপরিহার্য। এজন্য দেশেও একাধিক বিকল্প সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযোগ পরিবর্তনের প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) অভিযোগ রয়েছে, এরই মধ্যে তিনটি ভিন্ন প্রকল্পে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটির অনাগ্রহ অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ দরপত্রটিও বাতিল করা হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে।

স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য প্রথম প্রকল্প হিসেবে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প নিয়েছিল বিটিসিএল। কিন্তু ক্রয় আইন-বিধি জাইকার নীতিমালা লঙ্ঘন করায় জাপান সরকার ২০১৫ সালে প্রকল্পটির লট-বির জন্য বরাদ্দ দেয়া ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেয়ার সুপারিশ এবং জাইকার অনুমোদন উপেক্ষা করে দরপত্র বাতিল পুনঃদরপত্র আহ্বানের কারণে ন্যূনতম (দশমিক শূন্য শতাংশ) সুদে ৪০ বছরে ফেরতযোগ্য ঋণ প্রত্যাহার করা হয়েছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সরকারি ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কে যুক্ত হতো স্বয়ংক্রিয় সংযোগ প্রযুক্তি (এএসওএন) নিয়ে সরকারকে দেয়া চিঠিতে ভবিষ্যতে ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধও জানিয়েছিল জাইকা।

২০১৬ সালে দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে বিভিন্ন জেলার মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের প্রকল্প নিয়েছিল বিটিসিএল। প্রকল্পটিতে সর্বনিম্ন দরদাতার প্রতিনিধির পাসপোর্টের ফটোকপি না দেয়ার অজুহাতে ক্রয় আইন বিধি লঙ্ঘন করে দরপত্র বাতিল করা হয়। দরপত্র বাতিলের তিনদিনের মাথায় সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কার্যাদেশ দেয় বিটিসিএল। কার্যাদেশ দেয়ার সময় এএসওএন প্রযুক্তি বাদ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত সে চুক্তি অবৈধ বলে রায়ও দেন। রায়ে বিটিসিএলের ক্রয় আইন বিধি ভঙ্গের বিস্তারিত উঠে আসে, তবে যন্ত্রপাতি দেশে চলে আসায় সময় বা অর্থ বৃদ্ধি না করার শর্তে কার্যাদেশ অব্যাহত রাখার বিশেষ অনুমতি দেন সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে সর্বনিম্ন দরপত্রদাতাকে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়া হয়।

সর্বশেষ ডিজিটাল কানেকটিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন (এসটিএন) শীর্ষক প্রকল্পটিতেও ঘটেছে ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদিত হয়। এর আওতায় চারটি মূল অংশ রয়েছেএএনএস গেটওয়ে, ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ), আইজিডব্লিউ অপারেটর সুইচ (আইওএস) ডেনস ওয়েভলেন্থ-ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং (ডিডব্লিউডিএম)

প্রকল্পের জন্য বিটিসিএলের সম্প্রতি সমাপ্ত চলমান প্রকল্পের আওতায় ধরনের পণ্য সেবার ব্যয় এবং নতুন আইটেমের ক্ষেত্রে বাজার, ইন্টারনেট ভেন্ডরের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে ডিডব্লিউডিএম ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতির প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৪ কোটি ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করে ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এটি একনেকে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর ভিত্তিতে দরপত্র মোট আটটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করে। এগুলো হলো হুয়াওয়ে টেকনোলজিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড, টেক ভ্যালি নেটওয়ার্কস, জিটিই করপোরেশন, উহান ফাইবারহোম ইন্টারন্যাশনাল টেকনোলজিস, এক্স-ফার লিমিটেড, এনজিএন টেলিকম অ্যান্ড আইটি সার্ভিসেস, তেজাস নেটওয়ার্কস স্মার্ট টেকনোলজিস।

এসব দরপত্র মূল্যায়নের জন্য গত বছরের ১২ জানুয়ারি একটি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে কমিটিতে ছিলেন যথাক্রমে অধ্যাপক . মো. কাউসার আলম, লে. কর্নেল রাশেদুল ইসলাম এবিএম বদিউজ্জামান। এছাড়া সাত সদস্যের কমিটিতে বিটিসিএলের তিনজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন, যাদের একজন কমিটির চেয়ারম্যান। কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে ছিলেন প্রকল্প পরিচালক।

২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে চীনের তিন কোম্পানি হুয়াওয়ে টেকনোলজিস, জিটিই করপোরেশন উহান ফাইবারহোম তাদের নিজস্ব যন্ত্রপাতির প্রস্তাব করে। মার্কিন কোম্পানি সিসকোর যন্ত্রপাতি সরবরাহের প্রস্তাব করে টেক ভ্যালি নামে দেশী একটি প্রতিষ্ঠান। আরেক দেশী কোম্পানি এক্স-ফারের প্রস্তাবনায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনফিনেরার যন্ত্রপাতি সরবরাহের কথা।

সাত সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে যোগ্য সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে এক্স-ফারের নাম ঘোষণা করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবিত দর ছিল প্রাক্কলিত দরের চেয়ে দশমিক ৭১৮ শতাংশ কম। সদস্য সচিব বিটিসিএলের বাইরের দুজনসহ কমিটির মোট তিন সদস্য ক্রয় আইন বিধি অনুযায়ী একমাত্র যোগ্য দরদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তির সুপারিশ করেন।

অন্যদিকে বিটিসিএলের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম, একেএম হাবিবুর রহমান খোন্দকার যুবায়ের হাসান এবং মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এবিএম বদিউজ্জামান নিজেদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী এক্স-ফারকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দরদাতা হিসেবে স্বীকার করলেও সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পুনঃদরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করেন।

অভিযোগ রয়েছে, ক্রয় আইন অনুযায়ী বাতিলকৃত দরদাতাদের দেয়া দর বিবেচনার কোনো সুযোগ না থাকলেও তাদের উদ্ধৃত মূল্যকে বাজারমূল্য হিসেবে ধারণা করেছেন কমিটির ভিন্নমত পোষণকারী চার সদস্য। অযোগ্য ঘোষিত দরদাতাদের সঙ্গে তুলনা করে তারা সর্বনিম্ন মূল্যায়িত দর বাজারমূল্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মতামত দেন। এক্ষেত্রে ক্রয় আইন বিধিতে দরপত্র বাতিলের অনুমোদিত কারণগুলোর ব্যত্যয় ঘটিয়েই পুনঃদরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

আরো অভিযোগ উঠেছে, মূল্যায়ন প্রতিবেদনের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা নম্বর হাতে কেটে ভিন্নমত সংবলিত অতিরিক্ত দুই পাতা সংযোজন করা হয়। পৃষ্ঠা নম্বর হাতে কেটে সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়টি গোপন করতে মূল্যায়ন প্রতিবেদনের বদলে বিটিসিএলের ১৭৬তম বোর্ড সভায় শুধু কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়। বিটিসিএলের ১১ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে বিষয়টি উপস্থাপিত হলে বিষয়টিকে ক্রয় বিধি আইনবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে পর্ষদে সংস্থার বাইরে থেকে নিযুক্ত চার সদস্য দরপত্র বাতিলের বিপক্ষে মত দেন। অন্যদিকে দরপত্র বাতিলের পক্ষে মত দেন পর্ষদের অন্য সদস্যরা। বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী বোর্ড সভায় আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ভার্চুয়ালি আয়োজিত পরবর্তী বোর্ডসভায় (১৭৭তম) এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি বিদেশ সফরে থাকার অজুহাত দেখিয়ে তাকে সভায় অংশ নেয়ার জন্য জুম লিংক প্রেরণ করা হয়নি। অন্যদিকে বুয়েটের প্রতিনিধি লিখিতভাবে ভিন্নমত না দেয়ায় তাকে দরপত্র বাতিলের পক্ষে দেখানো হয়। ১৭৭তম বোর্ড সভায় ক্রয় আইন, বিধি দরপত্র দলিলে নির্ধারিত কারণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলেও দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভিন্নমত প্রদানকারী পর্ষদ সদস্যদের বক্তব্যসহ পূর্ণ আলোচনার বদলে বিটিসিএলের সভার শুধু সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে দরপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ে রিভিউ প্যানেলের কাছে আপিল করে এক্স-ফার। অনুমোদিত দাপ্তরিক প্রাক্কলন নিয়ে বাদী কোনো অভিযোগ না করলেও রিভিউ প্যানেল বাদী আবেদন করেছে উল্লেখ করে প্রাক্কলন প্রস্তুত প্রণয়নসংশ্লিষ্টদের শাস্তির নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে বাদী দুর্নীতি প্রমাণ করতে না পারার কারণ দেখিয়ে দরপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে আবেদন গ্রহণ করেনি রিভিউ প্যানেল।

বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রয় বিধি ৩৩ ()-এর নির্দিষ্টকৃত কারণ ছাড়া দরপত্র বাতিলের নিয়ম নেই। বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত দরপত্র বাতিলের কারণও বিবেচনায় নেয়া হয়নি বলে রিভিউ প্যানেলে দেয়া লিখিত বক্তব্যে স্বীকার করেছে বিটিসিএল। যদিও রিভিউ প্যানেল বলছে, ধারাটি আমলে নিয়েই বিটিসিএল দরপত্র বাতিল করেছে। অন্যদিকে আবেদনকারীর কাছ থেকে লিখিত বক্তব্য নিলেও তা থেকে অনিয়ম-দুর্নীতিসংক্রান্ত বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে বাদ দিয়ে পরস্পরবিরোধী পর্যবেক্ষণসহ সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে।

এদিকে আপিল নিষ্পত্তির আগেই পুনঃদরপত্র আহ্বান করে বিটিসিএল। গত বছরের নভেম্বরে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এক্ষেত্রেও ক্রয় আইন বিধি লঙ্ঘন করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির দুই বহিঃসদস্যকে (বুয়েট সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি) না জানিয়েই তাদের বাদ দেয় বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ। ওই দুজন সদস্যকে বাদ দিয়ে গঠন করা হয় নতুন আরেকটি মূল্যায়ন কমিটি। নতুন কমিটির সভাপতি করা হয়েছে দরপত্রে অংশ নেয়া একটি প্রতিষ্ঠানের (জিটিই) বাস্তবায়নাধীন বিটিসিএলের এমওটিএন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালককে। প্রথমবার পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিলেও পুনঃদরপত্রে অংশ নিয়েছে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান। জিটিই মূল দরপত্রে সর্বোচ্চ অনুমোদিত ৫০ পেনাল্টি পয়েন্টের স্থানে ৫০৫ পেনাল্টি পয়েন্ট তিনটি অগ্রহণযোগ্য মাত্রার বিচ্যুতির কারণে বাতিল ঘোষিত হলেও পুনঃদরপত্রে তাদেরই কার্যাদেশ দেয়ার সুপারিশ করে বিটিসিএল।

তবে দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ সঠিক নয় জানিয়ে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক . রফিকুল মতিন বণিক বার্তাকে বলেন, মূল্যায়ন কমিটি পুনর্গঠনের সুযোগ রয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়া আইন মেনেই পরিচালিত হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন