ডোনাল্ড ট্রাম্প: একজন আনপ্রেডিক্টেবল প্রেসিডেন্ট

অনিন্দ্য সাইমুম ইমন

‘আনপ্রেডিক্টেবল পারসন’ শব্দের বাংলা অর্থ- যাকে আগেভাগে বোঝা যায় না। সহজভাবে বললে, একজন ব্যক্তি কী করবেন, কী বলবেন, তা আগে থেকে আন্দাজ করতে না পারাই আনপ্রেডিক্টেবল ব্যক্তির মূল বৈশিষ্ট্য। আর এ শব্দটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য একেবারেই যুৎসই।  বিশ্বে সবচেয়ে আনপ্রেডিক্টেবল রাজনৈতিক নেতার কোনো তালিকা তৈরি করলে তাতে ট্রাম্পের নাম থাকবেই। 

গত চার বছর ট্রাম্পের আচরণ অনুমান করতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও ঘাম ছুটেছে। অনেক সময় তার আচরণ, নীতি, গতিপ্রকৃতি বুঝে ওঠাও কঠিন হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে তার সমর্থকদের হামলার ঘটনা। রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়ার আগে ট্রাম্পের সমর্থকরা এমন একটি নজিরবিহীন কাজ করবে, তা কে ভেবেছিল!

চার বছর আগে ট্রাম্প যখন প্রথম নির্বাচনী লড়াইয়ে শামিল হতে দৌড়ঝাঁপ করছেন, তখন এক টিভি সাক্ষাৎকারে উপস্থাপক তার কাছে নির্বাচনে জয়ের পর পররাষ্ট্রনীতির সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রাম্পের জবাবটা ছিল সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষণীয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কোনো কার্ড খেলবো না। বরং আমি আনপ্রেডিক্টেবল থাকতে পছন্দ করব।’

আইএমডি বিজনেস স্কুলের লিডারশিপ অ্যান্ড অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ারের অধ্যাপক জেনিফার জর্ডান বলেন, ট্রাম্প শুরু থেকেই চমক দিতে চেয়েছেন। বিভিন্ন সময় তিনি কথা, আচরণ, নীতি, সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বিশ্বনেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ- সবাইকে চমকে দিয়েছেন। গত চার বছরে অনেকেই তাকে ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেননি। এটাই ট্রাম্পের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। 

এর পেছনে ট্রাম্পের বেড়ে ওঠা বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন অনেকে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম ট্রাম্পের। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনী ব্যবসায়িক পরিবারে তার জন্ম। বিত্ত-বৈভব আর ঐশ্বর্যের আবহে বেড়ে উঠেছেন। পেশাগত জীবনের শুরুতে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছেন। শূন্য থেকে শুরু করে সাগর গড়ার কোনো ইতিহাস নেই তার। 

তবে হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, ক্যাসিনো, গলফ কোর্স কিংবা বিনোদন ব্যবসাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব ট্রাম্পকে দিতেই হয়। ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় টিভি সেলিব্রেটি, তারকা ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক উচ্চাঙ্ক্ষা থাকলেও রাজনীতিতে নামার অভিপ্রায় প্রকাশ করতে তাকে খুব একটা দেখা যায়নি। সেই ট্রাম্প পড়ন্ত বয়সে শুধু রাজনীতির মাঠ দাপাননি, বরং বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। চার বছরের শাসনামলে অনেক কিছুকে ওলটপালট করে দিয়েছেন। এর চেয়ে আনপ্রেডিক্টেবল ঘটনা আর কী হতে পারে!

ডোনাল্ড ট্রাম্প পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনি একমাত্র প্রেসিডেন্ট যার হোয়াইট হাউসে প্রবেশের আগে সরকারি দফতর কিংবা সামরিক বাহিনীতে কাজের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ছিল না। ধনী বাবার আদরের সন্তান তিনি। নিজেও ধনী তারকা ও ব্যবসায়ী। স্বাভাবিকভাবেই যখন যা ইচ্ছে তা করার সহজাত প্রবণতা ট্রাম্পের মধ্যে রয়েছে। আর এ প্রবণতা ট্রাম্পের ভেতর আনপ্রেডিক্টেবল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে দিয়েছে বলে মনে করেন জেনিফার জর্ডান। 

হোয়াইট হাউসে বসেও যখন যা ইচ্ছে তা করেছেন ট্রাম্প। অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ ও তা নিয়ে মেক্সিকো ও নিজ দেশের আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে তুমুল বিরোধে জড়িয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের উগ্র চর্চা এগিয়ে নিয়েছেন। বিভক্ত করেছেন আমেরিকান সমাজকে। চীনের সঙ্গে তুমুল বাণিজ্যিক-রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়েছেন। ক্ষমতা ছাড়ার আগেও চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে। 

ট্রাম্পের এমন আনপ্রেডিক্টেবল নীতি ও সিদ্ধান্তের তালিকা বেশ দীর্ঘ। অনেক বিশ্লেষক এসব নীতিকে হঠকারি বলে সাব্যস্ত করেছেন। তবে ট্রাম্পের তাতে কিছু আসে যায়নি, দমেও যাননি তিনি। এমনকি নিজ প্রশাসনের কেউ তার এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দ্বিমত করলে তাকে পত্রপাঠ চাকরি থেকে বিদায় দিয়েছেন। এ তালিকায় একাধিক মন্ত্রী থেকে শুরু করে আইন ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাও রয়েছেন। 

বিশ্ব নেতারাও ট্রাম্পের আনপ্রেডিক্টেবল আচরণ ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেননি। তাইতো ট্রাম্পের হাত ধরে ঐতিহাসিক মিত্র ইউরোপ ও ন্যাটো জোটের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে মার্কিন প্রশাসনের। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, কাতারের অবরোধ নিরসনে মধ্যস্ততা, ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক উষ্ণ করতে ভূমিকা রাখা, সর্বোপরি পূর্বসূরীদের মতো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো যুদ্ধে না জড়ানোর পরও এ অঞ্চলের দেশগুলো তাকে খুব একটা বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। বরং ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ছিলেন জনতুষ্টবাদী ও উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী বিশ্বনেতারা। 

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে ট্রাম্প ভারতকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এসেছেন। এর পেছনে কাজ করেছে হোয়াইট হাউসের চীন-ফ্যাক্টর। উপেক্ষা করেছেন পুরনো মিত্র পাকিস্তানকে। উন্নয়নশীল ও উন্নয়নকামী দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিকাশ ও অগ্রযাত্রা ট্রাম্পের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে কম। তাইতো তিনি জাতিসংঘের বাজেট কমানোর কথা বলেছেন। করোনা মহামারীর সংকটময় মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় অর্থের জোগান বন্ধ করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চলমান করোনা মহামারী ট্রাম্পের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। এ মহামারী নিয়ে শুরু থেকেই তিনি ছিলেন উদাসীন। একের পর এক হঠকারীমূলক কথা বলেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনকি সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক পরার ঘোর বিরোধী ছিলেন ট্রাম্প। নিজে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর তার মুখে মাস্ক দেখা গেছে। তার ভ্রান্ত নীতির বলি হয়েছে কয়েক লাখ আমেরিকান। বলা হচ্ছে, আনপ্রেডিক্টেবল আচরণ না করে সময়মতো কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া গেলে করোনা আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এত মানুষের মৃত্যু হতো না। 

‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক মেয়াদে দু’বার অভিশংসনের মুখে পড়েছেন তিনি। তবে করোনা মহামারী না এলে অর্থনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেশ ভালোই করছিলেন তিনি। বাণিজ্যযুদ্ধের আড়ালে চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন রোধ ও মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আর্থিক নীতির প্রশংসা করেছেন কেউ কেউ। তবে সবই এখন অতীত। হোয়াইট হাউসের নেতৃত্বের পালাবদলে ট্রাম্পের আচরণ ও নীতি আর দেখতে হবে না। গণমাধ্যমকে আর ছুটতে হবে না তার আনপ্রেডিক্টেবল ঘটনা ও কাজের পেছনে। বিশ্বনেতারাও হয়তো এরই মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তবে এমন আচরণের কারণে বিশ্বের সবেচেয়ে আনপ্রেডিক্টেবল ক্ষমতাধর ব্যক্তি ট্রাম্পকে মনে রাখবে আমেরিকান সমাজ, পুরো বিশ্ব।  

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন