মহামারীতে শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট কেন স্থগিত রাখা প্রয়োজন

মোহাম্মদ হাতেম

বিশ্ব মহামারী ‘কভিড-১৯’ এর ছোবলে সাড়া বিশ্বের অর্থনীতি পর্যদুস্থ, স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতির চাকাকে চলমান রাখার সংগ্রামে লিপ্ত উদ্যোক্তাসহ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সমূহ। সংকুচিত হয়ে পড়েছে কর্মক্ষেত্র। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লকডাউনে পড়ে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে বিশাল এক জনগোষ্ঠী। পরিস্থিতি সামাল দিতে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ- কোথাও চলছে সাময়িক বন্ধ, চলছে কোথাও কর্মী ছাঁটাই, কোথাও বা চলছে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভিন্ন পার্সেন্টেজে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কমিয়ে দিয়ে টিকে থাকার প্রচেষ্টা। আবার ভারতের শিল্পঘন বেশ কিছু রাজ্যে স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে শ্রম আইন। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তার নেই কোন পূর্বাভাস, চরম প্রতিকুলতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে এক অস্বাভাবিক সময়। এমনই পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের ঘোষিত সহযোগিতা নিয়ে কোনভাবে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান রফতানিখাত পোশাক শিল্প।  

পর্যাপ্ত কার্যাদেশ নেই, ধারাবাহিকভাবে কমছে রফতানি আদেশ, নেই আগামী দিনগুলোতেও স্বাভাবিক কার্যাদেশ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা; যা কিছু কার্যাদেশ রয়েছে বা রফতানি হচ্ছে তারও পয়সা মিলবে ১৮০ থেকে ২০০ দিন পরে; আবার পূর্বের তুলনায় পোশাকের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে ১০-১৫ শতাংশ। কোন প্রকার দর কষাকষির সুযোগ নেই। শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্ম সংস্থান বজায় রাখার স্বার্থে জানা স্বত্বেও লস দিয়েই কার্যাদেশ নিতে বাধ্য হচ্ছে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে কাঁচামালের বাজারেও চলছে এক চরম অনিশ্চয়তা। হঠাৎ করে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় ইতিপূর্বে নিশ্চিৎ করা ক্রয়াদেশ সমূহের রফতানি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গুণতে হচ্ছে আরেক দফা বিশাল অংকের লস। সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় চরম হিমশিম খাচ্ছে দেশের রফতানির প্রধান এ খাতটি।  

মজুরি বোর্ড ঘোষিত ২০১৩ সালের গ্যাজেটে সর্বপ্রথম মালিক পক্ষের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রমিকদের বাৎসরিক ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির একটি বিধান রাখা হয়েছে যা ২০১৮ সারের গ্যাজেটেও চলমান রয়েছে। এর পূর্বে কখনও এ ধরনের ইনক্রিমেন্ট বিধান ছিল না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যেখানে শ্রমিক-কর্মচারীদের বর্তমান বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করাটাই প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই বিভিন্ন খাতে যেখানে বেতন-ভাতা কমিয়ে দিয়েছে। সেখানে পোশাকখাতে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি কোনভাবেই বাস্তব সম্মত নয় বলেই আমরা মনে করছি। এখানে উল্লেখ যে, আইনে থাকার কারণে কভিডের মধ্যেও বিগত সময়েও আমরা ইনক্রিমেন্ট দিতে বাধ্য হয়েছি। 

করোনার প্রথম ধাক্কা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রমবিকাশমান ধারাকে দারুনভাবে ব্যাহত করেছে এবং বিগত অর্থবছরের অধিকাংশ সময়ে নিটখাতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে করোনার দ্বিতীয় প্রকোপ আসার সাথে সাথে এই শিল্পের ভবিষ্যতটাই এখন হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সঠিক সময়ে শিপমেন্ট আমদানিকারকরা গ্রহণ করবেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে নিট শিল্প উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতি, শিল্প ও শ্রমিকের জীবন প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যেও কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে। কভিডের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতির সংকোচন হয়েছে ব্যাপকহারে। এমনি পরিস্থিতিতে সারা পৃথিবীতে যখন কর্মী ছাঁটাই, বেতন সংকোচন, এমনকি  কোথাও কোথাও পুরো প্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, সেখানে পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা সাময়িক সময়ের জন্য শুধুমাত্র  শ্রমিকদের বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট স্থগিত রাখার আবেদন জানিয়েছে। আমরা মনে করি এমন কঠিন পরিস্থিতিতে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এর বিকল্প নেই। কারণ শিল্পই যদি না বাঁচে তবে শ্রমিকদের কী হবে, উদ্যোক্তাদের কী হবে?  উদ্যোক্তা ও শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্যই এই শিল্পকে সবার আগে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের সকলের  প্রচেষ্টা থাকা উচিত। 

এমতাবস্থায় আসুন আমরা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা না করে বাস্তবতা অনুধাবন করে অন্তত সাময়িক সময়ের জন্য ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির এই বিধানটি স্থগিত রাখার সুপারিশ করি। শিল্প টিকে থাকলে আবারও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো ইনশাল্লাহ।

লেখক: ১ম সহ-সভাপতি, বিকেএমইএ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন