প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ধুঁকছে নওগাঁর হাস্কিং মিল

আরমান হোসেন, নওগাঁ

শস্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁর প্রধান ফসল ধান সবজি। ধানকেন্দ্রিক জেলা হওয়ায় গড়ে ওঠে অসংখ্য চালকল। শহর থেকে মহাদেবপুর উপজেলা যাওয়ার পথে নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়কের দুপাশে এসব চালকলের অবস্থান। অর্ধযুগ আগেও জেলায় প্রায় হাজার ২০০ চালকল ছিল। এসব চালকলে যুক্ত ছিলেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। বর্তমানে চালু রয়েছে এক হাজারের মতো চালকল। এর মধ্যে ৫৫টি অটো রাইস মিল। অল্প সংখ্যক অটো রাইস মিলের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাস্কিং মিল (ছোট চালকল) টানা লোকসানে অনেক মালিক এরই মধ্যে মিল বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে মিল ভাড়া দিয়েছেন। কেউবা চাতালগুলোয় চালের পরিবর্তে তৈরি করছেন গুঁড়ো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাস্কিং মিলগুলোর ধান-চাল তৈরি করতে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়। আবহাওয়া বিশেষ করে বর্ষা শীতকালে এক চাতাল (২০০ মণ) ধান শুকানো থেকে শুরু চাল করা পর্যন্ত ১৫-২০ জন শ্রমিকের -১০ দিন সময় লাগে। হাস্কিং মিলগুলো প্রতিযোগিতার বাজারে সময়মতো চাল উৎপাদন করতে পারে না। এজন্য সময়মতো বাজার ধরতে না পারায় অনেকটা পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। টানা লোকসানে একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক হাস্কিং মিল।

সরেজমিন হাঁপানিয়া এলাকার মঈনউদ্দিন হাস্কিং মিলে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে মিলটি বন্ধ থাকায় চাতালে ঘাস গজিয়েছে, ভেঙে পড়েছে চিমনি। অন্যদিকে পাশেই সনি অটোরাইস মিলে অল্প শ্রমিক নিয়ে কম সময়ে প্রচুর পরিমাণ চাল উৎপাদন করা হচ্ছে।

নারী শ্রমিক কোহিনুর বেগম, পারভিন সাজেদা বেগম বলেন, হাস্কিং মিলে ছয়জন কাজ করছেন। চাতালে ২০০ মণ ধান ভেজানো শুকানো থেকে শুরু করে ভাঙানো পর্যন্ত পারিশ্রমিক হিসেবে ৬০০ টাকা এবং ৪৫ কেজি চাল দেয়া হয়। জনপ্রতি ভাগে ১০০ টাকা সাড়ে সাত কেজি করে চাল পাওয়া যায়। মাসে তিন-চারটি চাতাল ওঠে। পরিশ্রম বেশি হয়; কিন্তু সে তুলনায় পারিশ্রমিক পাই না। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। যে টাকা পাই, তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। একসময় অনেক মানুষ কাজ করতে হতো। অনেক চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। তাই যারা আগে মিলে কাজ করতেন, তারা এখন পেশা বদল করেছেন। আমরা অন্য কোনো কাজ পারি না। তাই বাধ্য হয়েই চাতালে পড়ে আছি।

সদর উপজেলার হাঁপানিয়া এলাকার কফিল উদ্দিন হাস্কিং মিলের মালিক কফিল উদ্দিন বলেন, ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে চাতালের সঙ্গে জড়িত। একসময় মিলে ১৫-১৮ জন শ্রমিক কাজ করতেন। ছয় বছর থেকে চাতাল বন্ধ রয়েছে। চাল উৎপাদনের পরিবর্তে এখন ধানের চিটা সংগ্রহ করে গুঁড়ো ভাঙানোর কাজে মিল ব্যবহার করছি।

তিনি বলেন, অটোরাইস মিলে বেশি ধানের প্রয়োজন হওয়ায় তারা বেশি দামে ধান কেনে। আমাদের ছোট চালকলে ধান কম লাগলেও বেশি দামে কিনতে হয়। শ্রমিক খরচ চাল উৎপাদন করতে গিয়ে খরচটা বেশি হয়। বেশি দামে ধান কিনে চাল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছিল না। বেশ লোকসানে পড়তে হয়েছিল। কারণে মিল বন্ধ করে দিয়েছি। হাস্কিং মিলগুলো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

সামিয়া চালকলের মালিক মোতালেব হোসেন বলেন, ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে -১২ দিন সময় লেগে যায়। আর অটোরাইস মিলে এক-দুদিনের মধ্যে চাল উৎপাদন করে বাজারজাত করে এবং তারা দাম পায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না।

তিনি বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বিভিন্নভাবে সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কোথাও থেকে কোনো ধরনের সুবিধা পাই না। সরকার একটা উদ্যোগ নিয়েছেধারণক্ষমতা অনুযায়ী মিলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মজুদ রাখতে পারবে। ধারা চলমান থাকলে আমরা কিছুটা উপকৃত হব।

নওগাঁ জেলা ধান্য বয়লার অটো সার্টার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, অনেক হাস্কিং মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। ১০-১৫ বছর আগে যে পারিশ্রমিক দেয়া হতো; এখনো সেই মজুরি দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। পারিশ্রমিক বাড়াতে মালিকদের সঙ্গে তিনবার বৈঠক হয়েছে। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়ার দুই বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

মেসার্স ফারিহা রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী শেখ ফরিদ উদ্দিন বলেন, অটোরাইস মিলের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১০ জন শ্রমিক ৩০ টন চাল উৎপাদন করতে পারেন। সেখানে হাস্কিং মিলে এক সপ্তাহে প্রায় ১৫ জন শ্রমিক ৩০ টন চাল উৎপাদন করতে পারেন। একসময় হাস্কিং মিলে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অটোরাইস মিল আসার পর মানুষ বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। কিছু হাস্কিং মিল অনেক কষ্টে এখনো টিকে আছে।

নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বণিক বার্তাকে বলেন, মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। অটোরাইস মিলে চাল উৎপাদন করতে বেশি গরম করতে হয়। ওই চালের ভাত রান্নার পর দীর্ঘ সময় ভালো থাকে। কিন্তু হাস্কিং মিলের চালের ভাত পুষ্টিগুণ সুস্বাদু বেশি হলেও দীর্ঘ সময় ভালো থাকে না। অন্যদিকে সরকারের কিছু বৈষম্য রয়েছে। হাস্কিং মিলের জন্য সরকার স্বল্প পরিমাণ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এখান থেকে উত্তরণের জন্য হাস্কিং মিলে বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। যেন চালকল মালিকরা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন