ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বঙ্গবন্ধুর

বিজয়ীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাজ্য

সাইফুল ইসলাম

১৯৭২ সালের জানুয়ারি। লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে সকালে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই উড়োজাহাজ থেকে নেমে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি কারাগারে নয় মাসের বন্দিজীবন কাটিয়ে মুক্ত বঙ্গবন্ধুকে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে বিশেষ একটি উড়োজাহাজে। সেখানে যথোপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে তার সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ব্রিটিশ সরকার। বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ক্লারিজেস হোটেলে।

মুক্ত অবস্থায় সেখানেই প্রথম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন বঙ্গবন্ধু। সেদিন সন্ধ্যায়ই তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিব। ওই সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, আপনার জন্য কী করতে পারি। উত্তরে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে ফিরে আসার জন্য উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান বঙ্গবন্ধু। সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিলেন এডওয়ার্ড হিথ।

পরদিনই ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ একটি উড়োজাহাজ বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গীদের নিয়ে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশে। দিল্লি হয়ে জাতির জনক যেদিন প্রথম স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রথম পা রাখেন, সেদিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি।

স্বাধীন একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ভিভিআইপির মর্যাদা দিয়ে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করলেও তখনো বাংলাদেশকে খোলাখুলি স্বীকৃতি দেয়নি যুক্তরাজ্য। আগের বছরের প্রায় পুরোটা সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আড়ালে দুই সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার যে বিরোধপূর্ণ পরিবেশ জাতিসংঘকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেখানে শুরুতে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছিল যুক্তরাজ্য। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রীর পক্ষেই ঝুঁকতে থাকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন তিক্ততা তৈরি হয় লন্ডনের। এডওয়ার্ড হিথের আত্মজীবনীতেও এর স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের পর ডিসেম্বরের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন, সে সময় তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে এডওয়ার্ড হিথের একটি আলোচনা হয়। ওই আলোচনার এক পর্যায়ে নিক্সন কিসিঞ্জারকে বলে বসেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বিষয়টি নিয়ে আমাদের মতের অমিলের কারণটি টেডকে (টেড হিথ নামেও পরিচিত ছিলেন এডওয়ার্ড হিথ) বুঝিয়ে বলুন হেনরি।

নিক্সনের নির্দেশমতো কিসিঞ্জার এডওয়ার্ড হিথকে বোঝাতে লাগলেন, যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল চীন। এবং ভারতের পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। পাকিস্তান ছিল ভারতের তুলনায় দুর্বল এবং চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় দুর্বল। এখানে দুটি দুর্বল দেশ দুটি শক্তিশালী দেশের বিপক্ষে একজোট হয়েছে। আমরা এখানে দুর্বল দুই দেশের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছি, যাতে করে ভারসাম্য ফিরে আসে এবং তাদের ভরাডুবি না ঘটে। ঘটলে তা হতো আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। যদি আমি ঠিকঠাক বলতে পারি, তাহলে ব্রিটিশরাও যুগ যুগ ধরে নীতিরই অনুসরণ করে এসেছে।

প্রত্যুত্তরে এডওয়ার্ড হিথ তার গোটা পররাষ্ট্রনীতিকে এক কথায় পরিষ্কার করে দিলেন এভাবে, হেনরি, অবশ্যই আপনি যা বলেছেন তা ঐতিহাসিকভাবে সঠিক। শুধু একটি ভুল রয়েছে। যদি আমরা বুঝতে পারি আমাদের তিন দেশেরই পরাজয় ঘটবে, সেক্ষেত্রে আমরা কখনই দুর্বল সহযোগীদের পক্ষ নিই না। যদি নিতাম, তাহলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটত।

এডওয়ার্ড হিথের আত্মজীবনীতে ওই আলোচনার বিবরণ দেয়া রয়েছে। পরবর্তীকালের ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের আলোচনায়ও হিথের ওই বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তাদের ভাষ্যমতে, ডিসেম্বরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যুক্তরাজ্য অঞ্চলে নিজ স্বার্থ বেশ  ভালোভাবেই রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় অঞ্চলে একদিক থেকে যেমন ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে সক্ষম হয় দেশটি, তেমনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সহায়তার মাধ্যমে অঞ্চলে নিজের অবস্থানকে আরো জোরালো করে তোলে যুক্তরাজ্য।

বিষয়ে পরবর্তীকালের ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরাও বলেছেন, বিজয়ীর পক্ষে অবস্থান নেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাজ্য দক্ষিণ এশিয়ার সংকট যুদ্ধের ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যেও উপমহাদেশে নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণে সফল হয়েছে।

যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সে সময় আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর প্রতিনিধিরা এসে ভিড় করছিলেন। আঞ্চলিক উপদেষ্টা হিসেবে তাদের জন্য সহায়ক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিনিধিরা। দেশের শিক্ষা খাত এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখনো পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত বহন করছিল। শিক্ষা খাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সক্রিয় সহযোগিতামূলক ভূমিকা নেয় ব্রিটিশ কাউন্সিল।

ব্রিটিশদের অবস্থানকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশীরা। বিষয়টি নিয়ে সাবেক ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার আর্থার কলিন্স পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, বাংলাদেশে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। কারণ সেখানে আমাদের দেখা হচ্ছিল বাঙালিদের প্রতি সহমর্মী হিসেবে। আমরা বাঙালিদের পক্ষে তখনো একেবারে স্পষ্ট অবস্থান না নিলেও আমাদের যেটি করণীয় ছিল, সময়ে সময়ে নানা সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসা। যে কেউ বলতে পারে, আমরা সেখানে বেশ ভালোভাবেই সুনাম অর্জন করেছিলাম। তবে আমরা কতটা কী অর্জন করতে পেরেছিলাম, সেটি অন্য বিষয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন