পঞ্চাশের দশকে হলুদ উৎপাদনে শীর্ষ অঞ্চলগুলোর অন্যতম ছিল বৃহত্তর কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গা। হলুদের সবচেয়ে বড় ১৬টি বাজারের একটি ছিল আলমডাঙ্গায়। পরবর্তী সময়ে হলুদ ছেড়ে বোরো আবাদ করতে থাকেন সেখানকার কৃষক। কিন্তু সেচ খরচ এবং বাড়তি ব্যয়ের কারণে এখন বোরো ছেড়ে আউশ ও ভুট্টা আবাদে ঝুঁকছেন তারা। শুধু তা-ই নয়, শস্য বিন্যাসে আমূল পরিবর্তনের ফলে এক দশকের ব্যবধানে ভুট্টা আবাদে দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ এলাকা হিসেবে উঠে এসেছে চুয়াডাঙ্গার নাম।
মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় অধিকাংশ কৃষক মাঠ ফসল হিসেবে ভুট্টার পর আউশ এবং আউশের সবজি (ভুট্টা-আউশ-সবজি) আবাদে মনোনিবেশ করেছেন। এছাড়া অনেক এলাকায় ভুট্টা-সবজি-আউশ কিংবা বোরো-আউশ-আগাম সবজি বিন্যাসে ফসল আবাদ করছেন।
কৃষকরা বলছেন, ভুট্টাসংশ্লিষ্ট শস্য বিন্যাসে আউশ ধান সবচেয়ে উপযুক্ত ও লাভজনক ফসল। শস্য বিন্যাস ও বৃষ্টিনির্ভরতার জন্য এ জেলায় আউশ ধান রোপণ দেরিতে হয়। কিন্তু উৎপাদন খরচ কম হওয়া এবং স্বল্প জীবত্কালের উন্নত জাত ব্যবহারের ফলে কৃষকের জন্য আউশ ধান আবাদ লাভজনক হচ্ছে। সে কারণে কয়েক বছর ধরে আউশ ধানের আবাদ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে চুয়াডাঙ্গায়। এবারো সর্বোচ্চ পরিমাণ জমিতে আউশের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফলনও হয়েছে আশানুরূপ।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আলী হাসান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলায় আউশ ধানের আবাদ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। জেলার ভূমি প্রকৃতি মাঝারি উঁচু এবং আবহাওয়া বৃষ্টিনির্ভর হওয়ায় এ অঞ্চল আউশ ধান চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ করে ও উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে বৃষ্টিনির্ভর আউশ ধান আবাদকে জনপ্রিয় করা হচ্ছে এখানে। আউশকে কেন্দ্র করে শস্যের বিন্যাসও সাজিয়ে ফেলেছেন এ অঞ্চলের কৃষক।
বোরোনির্ভরতা থেকে সরে এসে আউশ, ভুট্টা ও তামাকজাত পণ্যের পাশাপাশি নানা ধরনের সবজি ও ফলমূলের আবাদও বেড়েছে চুয়াডাঙ্গায়। সেখানে শস্য বিন্যাসের এ পরিবর্তনের পেছনে নানা উদ্যোগ কাজ করেছে, যার পেছনে দেশের অন্যতম বীজ উৎপাদন খামার দত্তনগর এবং পার্শ্ববর্তী জেলা মেহেরপুরের বীজ খামারের ভূমিকাও রয়েছে। পাশাপাশি কয়েক বছর আগে এ অঞ্চলে বাস্তবায়ন করা হয়েছে দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্প, যে প্রকল্পের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের শস্য আবাদের পাশাপাশি পরিবেশসম্মত শস্য আবাদে কৃষককে উৎসাহিত করা হয়। সেখান থেকেই ভুট্টা ও আউশ আবাদের গতি পায়।
এ অঞ্চলের কৃষক ও সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন প্রথিতযশা দুজন ব্যক্তি। তারা হলেন ব্র্যাকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক প্রয়াত ড. মাহবুব হোসেন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান। বিভিন্ন সময়ে নানা নতুন প্রযুক্তি ও জাত এ অঞ্চলে পরীক্ষামূলক বা পাইলট আকারে আনতে সহযোগিতা করেছেন এ দুজন। পাশাপাশি সম্প্রসারণ কর্মীরাও নানাভাবে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করায় শস্য বিন্যাসে একটি বড় পরিবর্তন এসেছে।
জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সারা দেশে প্রায় ৩২ লাখ ৪৫ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ জেলা দিনাজপুরে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৩২২ টন। দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে থাকা চুয়াডাঙ্গায় উৎপাদন ছিল ৪ লাখ ১৯ হাজার ৯৩২ টন। জেলাটিতে ভুট্টার আবাদ ছাড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার একর।
কয়েক বছরের ব্যবধানে চূয়াডাঙ্গায় তামাকের আবাদ ছড়িয়েছে। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আউশ আবাদে দেশের শীর্ষে থাকা পাঁচ জেলায় স্থান করে নিয়েছে চুয়াডাঙ্গা। আর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে আউশ আবাদে শীর্ষ অবস্থানে চলে আসতে পারে জেলাটি।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে যেখানে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় আউশ ধানের আবাদ ছিল ৬ হাজার ৮০০ হেক্টর, সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ৬৮৫ হেক্টর। ছয় বছরের ব্যবধানে আউশ আবাদ বেড়েছে ৮ হাজার ৮৮৫ হেক্টর। আউশের গড় ফলনেও চুয়াডাঙ্গা জেলা সারা দেশে সেরাদের তালিকায় রয়েছে। দেশে আউশ ধানের গড় ফলন (চাল) যেখানে প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৮ টন, সেখানে চুয়াডাঙ্গা জেলায় আউশ ধানের গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ৩ দশমিক ৪৭ টন।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ তালহা জুবাইর মাসরুর বণিক বার্তাকে জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা কৃষকদের আউশ ধান আবাদ বৃদ্ধির জন্য তাদের প্রণোদনা দিয়ে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। চুয়াডাঙ্গায় দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন ধরনের শস্য বিন্যাস চালু রয়েছে। যেখানে আউশ ধান অন্যতম জনপ্রিয় চাষ হিসেবে কৃষকের কাছে বিবেচিত হচ্ছে। আউশ ধান সোনা হয়ে হাসি ফুটাচ্ছে চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃষকদের মুখে। এ জেলায় এবার সর্বোচ্চ পরিমাণ আউশ আবাদ হয়েছে এবং ফলন হয়েছে সর্বোচ্চ। তাছাড়া ধানের বাজারদর ভালো পাওয়ায় কৃষকরা খুশি। বিগত ছয় বছরে চুয়াডাঙ্গায় আউশ আবাদ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেপ্টেম্বরের শেষ সময়ে কৃষকরা আউশ ধান কেটে ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন। এবার ধানের দাম বেশি থাকায় ও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা খুশিমনেই মাঠের কাজ করছেন। ধানের সঙ্গে বিচালি বিক্রি করেও লাভবান হচ্ছেন তারা।
জেলার জীবননগর উপজেলার বাঁকা ইউনিয়নের সুটিয়া গ্রামের কৃষক আতিকুর রহমান বলেন, চলতি মৌসুমে তিনি ৩৫০ শতক জমিতে ব্রিধান-৪৮ আবাদ করেন। সেখান থেকে প্রায় ২০০ মণ অর্থাৎ আট হাজার কেজি কেজি শুকনা ধান পেয়েছেন। ধান বিক্রি ছাড়াও প্রায় ৫০ হাজার টাকার বিচালি (গো-খাদ্য) বিক্রি করেন তিনি। ধানের দাম মণপ্রতি ১ হাজার টাকার উপরে থাকায় কৃষকরাও খুশি।
