পাঁচ দশকে পেশাগত রূপান্তর

গৌতম কুমার রায়

প্রকৃতির জন্য বিজ্ঞান নাকি বিজ্ঞানের জন্য প্রকৃতি—এই জটিল সমীকরণের উত্তর খুঁজে পেতে যে কষ্ট তার চেয়েও বেশি কষ্ট প্রকৃতি রূপান্তরিত হচ্ছে তার প্রাণীর মোহভোগে, অন্তরালে বিজ্ঞানের কারণে সব সময় এই বিষয়টি। তেল তৈরিতে কলুর বলদের বদলে কলের মেশিন। পালেদের মাটির তৈরি বাসনকোসনের চেয়ে স্টিলের বা ম্যালামাইনের বাসন এখন জনপ্রিয় বেশি। এই যে ভোগ্যগত বা ব্যবহারযোগ্য রূপান্তর, এসবের কাছে হার মানছে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের আদি নিদর্শন। তবে আমি দৃঢ়ভাবে একটি কথা বলতেই পারি এই যে অভ্যাস এবং সভ্যতা সব সময় বির্তনের দিকে যায়। অর্থাৎ তা রূপান্তরিত হয়। এ কথা যেমন সত্য আবার এটাও সত্য তা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতেও চায়। যেমন মাটির শানকিতে মানুষ আবার পান্তা-মরিচ খেতে ফিরেছে। কিংবা কলুর ঘানের খাঁটি সরিষার তেল কিনতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। প্রকৃতি বা প্রতিবেশ, জড় অথবা প্রাণ। এরা পৃথিবীতে জন্ম নেয়ার পর থেকেই রূপান্তরিত হয়। তা হয়তো বিস্তৃত হতে, নচেৎ বিলুপ্ত হতে। মানুষ পৃথিবীতে আসার আগেই তার ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি পৃথিবীর মাটিটুকুও ভাগে চলে যায়। পরে তার ইচ্ছে হলেই কোনো কিছুকে ত্যাগ বা গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ করতে যে প্রচেষ্টা তার স্পষ্টত আঘাতটা কিন্তু পড়ে প্রকৃতির ওপরই। তবে এ কথা ধ্রুব সত্য প্রকৃতিতে সব কিছুই কখনো বাধ্য হয়ে, কখনো ক্ষয় প্রতিঘাতের প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়। তা হয়তো সম্প্রসারণের জন্য নয়তো হারিয়ে যাওয়ার জন্য। যদি রাজনৈতিক বিষয়ের কথা বলি, তবে নির্দিষ্ট সীমারেখায় মানুষের নীতিনৈতিকতার বিষয়কে বাদ রেখে অনেকটা বাধ্য হয়ে সমাজ ও দেশের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে সামগ্রিক পলিসিতে অর্থনীতির গতিপথ সচল রাখতে হয়। এখানেও অনেকে কৌশলগত কারণে বেঁচে থাকার জন্য পেশার ধরনকে বদলে ফেলে। এভাবে সেই অতীত সময় থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিবর্তন এসেছে। তার পুরোটাই প্রভাবিত হয়েছে প্রথম আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি। আমাদের অর্থনীতির গ্রামীণ চলকে এখনো টিকে আছে শহরের অর্থনীতি এবং তার আধিপত্যের আর্থিক ভিত। স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা। বারবার এই রাজনৈতিক পালাবদলে সবচেয়ে বেশি ধারা বদলেছে আমাদের কেন্দ্রীয় অর্থশক্তির মূল রিসোর্স, পল্লীর অর্থশক্তিতে। রাজনৈতিক আঘাতে ধ্বংস হয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। এভাবেই কৃষক থেকে শ্রমিক, জেলে থেকে কলু। সবার চেষ্টার সম্মিলিত যে ধারা তাও ক্রমে ক্রমে সচল থেকে অচল হয়ে আরেকটি ধারায় পরিচিতি পেয়েছে। তার নাম রূপান্তরিত ধারা।

আমাদের মাটি আছে। তা রসালো। আমাদের শ্রম সেই মাটির ঘর্ষণে নিগূঢ়িত। আমাদের জনশক্তি আছে। আছে সুখ এবং আছে দুর্ভিক্ষ। এগুলোর শক্তি ক্রমবর্ধমান। বৈরী আবহাওয়া এবং বাড়তি জনসংখ্যার জন্য আমাদের অর্থনীতির নির্ভরতার অনেকটা জুড়ে রয়েছে এই মাটি, শুধুই এই উর্বর মাটি। যদি বাঙালি উদ্ভবের সাড়ে পাঁচ হাজার বছর সময়ের বিবেচনায় চিন্তা করি, তবে দেখা যায়, আমাদের জীবনে পরিবর্তিত উন্মেষ ঘটেছে খুব ধীরে ধীরে। সনাতনী জীবন থেকে বিলাসী জীবনের চেতনাকে বাঙালি সহজে আঁকড়ে ধরার তেমন চেষ্টাও তখন করেনি। কৃষ্টি এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্যের বসবাসে ছোট ছোট এক একটি গ্রামকে এক একটি পৃথক পৃথক ভূখণ্ড হিসেবে মনে করেছে এরা। আবার এখানকার আঞ্চলিক উৎপাদন চেষ্টা ছিল বিশেষ করে অঞ্চলভিত্তিক জল, আলো, তাপ বিবেচনায়। কিন্তু এ কথা সত্য যে তাদের মূল রিসোর্স সামষ্টিকভাবে ছিল কৃষিকে নিয়ে। মোগল থেকে তুর্কি। কিংবা কোম্পানি আমল ঘিরে ব্রিটিশ শাসন বা পাকিস্তানি সময়ে শাসকেরা শুধু শাসন, শোসন, বাণিজ্যিকীকরণ করতে গিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে পরিবর্তনের চিন্তার চেয়ে শাসনের সময় অতিবাহিত করতে সচেষ্ট ছিল। তাদের এ শাসনের পেছনে এ দেশের কৃষিজ উৎপাদন এবং তার ভোগ বাণিজ্য ছিল এদের কাছে প্রধান। গ্রমকে শহর, শহরকে আরো উন্নত বাসযোগ্য করার চেয়ে এদের চিন্তা ছিল শ্রম ও ঘাম ঝরিয়ে চা, পাট, নীল, মসলিন উৎপাদনের। ১৯৭১ সালে দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট আমাদের এই চিন্তাকে জাগ্রত করতে বাধ্য করে। এই সময়ে বিশ্ব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের খোলস খেকে সয়ম্ভর হওয়ার চেষ্টা খুঁজতে আমাদের একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ মাটিকে তার বৈরী আবহাওয়া উৎপাদনের চিন্তাকে আরো কাজে লাগাতে অনেকটা বাধ্য করে। কেননা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। আবার ভোগের জন্য মুখ বেশি। আমাদের সদ্য স্বাধীন দেশের যোগাযোগ এবং প্রাপ্ত আর্থিক প্রাপ্তি ঋণাত্মক পর্যয়ে। নিজেদের উন্নয়ন নিজেদের চেষ্টায়—এই ভাবনা থেকে রাজস্ব আয় বাড়াতে এমনকি হানাদার শাসকদের বেশি বেশি আমদানি চিন্তার বিপরীতে কম কম আমদানিকে প্রশ্রয় দিতে হয়। এজন্য প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হয়ে যায় রূপান্তর। গ্রামীণ সমাজ, পেশাবৃত্তিক সুখ ও অর্থনীতির রূপান্তর। চাষের রূপান্তর, ব্যবসার রূপান্তর, প্রযুক্তির রূপান্তর। এই রূপান্তর অনেকটাই কখন যে আপনাআপনিই হয়ে গেছে তা ভাবতেও সময় দেয়নি। এখান থেকে পরিবর্তন আসে কাজে, চিন্তায়। পেশায়, ইচ্ছাশক্তিতে। প্রকৃতি কখনো থেমে নেই। আপন নিয়মে নিভৃত মননে চলছেই। চলতে চলতেই রূপান্তরিত হয়ে পরে। গুহাচারী সময় থেকে আজ প্রকৃতির এই রূপান্তর কেউ রোধ করতে পারেনি। প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্কেও নিয়ন্তা হলো সমাজ। আর এই ধারা থেকেই জন্ম নেয় সামাজিক বাস্তুতা। এই বাস্তুতাকে ধরে মানুষের টিকে থাকা এবং টিকে থাকতে গিয়ে রূপান্তর। যা আজ আছে কালকে তার আবার পরিবর্তন হচ্ছে। 


দেশ এবং দেশের মানুষের ভরণপোষণ দায় মেটাতে গিয়ে প্রথমে চিন্তায় আশ্রয় নেয় সম্পদের সীমাবদ্ধতায় বিস্তর জনগোষ্ঠীর কথা। আমাদের দেশে ধারাবাহিক বৃদ্ধিজনিত জনমানুষের আবির্ভাব আমাদের খাদ্যোৎপাদনের বিষয়কে অস্বাভাবিক বিস্মিত করে তোলে সবসময়। যেজন্য এই খাদ্য এবং তার উৎপাদন প্রক্রিয়া আমাদের বিচলিত করেছে সময়ে-অসময়ে। এখান থেকে এক সময়ে আমদানি বিমুখ মানুষেরা ক্রমে ক্রমে মুখ ঘুরিয়ে নিতে অনেকটা বাধ্য হতে থাকে। নিগূঢ় লালিত বীজ এবং তা থেকে জন্মানো ফল ও ফসলের পরিবর্তে চিন্তায় বাসা বাঁধে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারের বিষয়টি। এ প্রক্রিয়ায় সেচ সুবিধার চিন্তা জমির আশপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জলের ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হয় সেচ বিতরণের সুবিধা পেতে। নদী-নালা, বিল-ঝিল দিনে দিনে দখলে এবং শুকিয়ে যেতে থাকে। প্রকৃতি উৎপাদিত মৎস্যভোগী জাতি দিনের ধারায় পরিচয় খোঁজে মৎস্য চাষের জাতিরূপে। এক সময়ে কৃষকের সম্পদ বলতে হালের গরু, লাঙল, মইয়ের জায়গায় যেমন ট্রাক্টর, পাম্পের বিকল্প হিসেবে আবার গরু-মহিষের গাড়ির বদলে আনতে হলো কলের গাড়িকে। এভাবে আগে জমি চাষ করালে যখন গোবর-মূত্র জমিকে মাটিকে সমৃদ্ধ করত, এবারে কিন্তু তেল পোড়া মবিলে সে তার যৈবিকতাকে নিরাশ্রিত করতে শুরু করল।

দেশ স্বাধীনের পর আমাদের নিজের ভূখণ্ডকে নিয়ে সব চেতনায় দীর্ঘসূত্রিত পরিকল্পনায় এগোতে লাগল। স্বাধীন জাতি হিসেবে আর পরের আশ্রয় চিন্তা বা সম্পদ কেড়ে নেয়ার ভয় তাগিয়ে এবারে পল্লীর আশা স্বপ্নে শহুরে নাগরিক সুবিধা ভোগেরও বাসনা জড়ো হতে লাগল। যেজন্য যে ধারায় শহর রূপান্তরিত হতে লাগল তার চেয়ে আরো বেশি গতিতে এগোতে লাগে গ্রামীণ ধারা। শহরে মানুষের আশ্রয় গ্রহণের চেয়ে নিজ গ্রামকে নগরায়ণের চিন্তায় স্বপ্ন তৈরির বাস্তবতা খুঁজতে লাগে মানুষ। সত্তর দশক হতে শেষ চার দশকে গ্রাম এবং গ্রামের জীবনযাত্রা পরিবর্তিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। আমাদের গ্রামীণ সমাজে একটা সময় ছিল পরিবারের প্রাত্যহিক অন্ন, বস্ত্রের উপকরণ জোগান দিতে সপ্তাহের হাটের পরে নির্ভর করতে হতো। এই হাটকে ঘিরে দিনক্ষণ নির্ণয় করতে হতো যেকোনো অনুষ্ঠানের। এমনকি বাড়িতে যদি সমাজদার কোনো অতিথি আসত তাকে ভোজন আপ্যায়ন করাতে হাট এমনকি পাড়ার বাড়ি বাড়িতে গিয়ে পছন্দের খাবারের উপকরণ জোগাড় করে নিতে হতো। ইদানীং এই হাটের পরিবর্তে প্রতিদিনের বাজারের ওপর এই নির্ভরতা স্থান করে নিয়েছে। কাঁচাবাজার থেকে মাছ-মাংস, কসমেটিক থেকে পোশাক সব হাজির হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ বাজারের কারণে বাড়িতেই। আবার অনলাইন শপিংয়ের জন্য সব এসে পৌঁছেছে মুহূর্তের মধ্যেই নিজের হাতে। এসবের পেছনের আসল কারণ প্রতিদিন প্রচুর জনগোষ্ঠীর ব্যাপক চাহিদা। আবার কষ্ট করে বাজারে না যাওয়ার এক অলসতা। এক সময় হাটবাজারগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নদীপাড়ের বিভিন্ন রাস্তার সংযোগস্থলে। এখনকার মতো রেল, সড়ক, আকাশপথ ছিলই না। নদী বয়ে গিয়ে চলাচল করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। দিনবদলের পালায় সত্তর দশক সময় হতে এসব ঘুরতে বসেছে। আমাদের সমাজে বারো জাতের মানুষের বসবাস ছিল। সমাজ সৃষ্টি হতো বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিয়ে। চুল কাটতে ক্ষৌরশিল্পী বা নাপিত, কাপড় তৈরি করতে তাঁতি, কাঠের কাজের জন্য সূত্রধর, কামার-কুমোর, গোয়ালা, গন্ধবণিকের কাজ, বসবাস করত পালকি বাহক; যারা সমাজ বা গ্রামের মানুষের প্রয়োজনে কাজ করে যেত। মিস্ত্রি, গাড়িয়াল, চর্মকার, ঢুলি, পাল, ময়রা, ডোম, বাগদিদেরও আলাদা আলাদা কাজ ছিল। কর্মগুণে সমাজে নির্দিষ্ট জায়গা ছিল বসবাসের জন্য গ্রামে গ্রামে। শহরে কোনো কাজে এদের ব্যবহার করতে হলে গ্রামে গিয়ে যোগাযোগ করে ডেকে আনতে হতো। ধাঙ্গর, ধোপা, স্বর্ণকার, মাহুত, তেলি বা কলু সম্প্রদায়, কসাই, বায়েন-গায়েন, খাতা লেখার কেরানি, সর্দার, পটুয়া, কারিকর, ডোম—এদের বসবাস ছিল গ্রামীণ আঙিনায় পাড়ায় পাড়ায় চিহ্নিত স্থানে। পেশাগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের নামে নামে পাড়া গড়ে উঠেছিল। এখন সেই হিসাব আর নেই। যেন সব পেশায় সবাই পারদর্শী। রাজমিস্ত্রি সময়ের প্রয়োজনে কাঠমিস্ত্রির কাজে। ব্যবসার চেয়ে এসএসসি পাস করলেই যেন চাকরির দাবিদার হয়ে যাচ্ছে। জেলে পাড়ায় গিয়ে মাছের ফরমায়েশ এখন আর দেয়ার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার গ্রামের ঠাকুর বাড়িতে এখন আর পুরোহিতকে খুঁজে পাওয়া যায় না। গেল চার দশকে মানুষের পেশাগত ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিদেশমুখী প্রবণতা মানুষকে জমি কিনতে শিখিয়েছে। গ্রাম কিংবা শহর টাকা হাতে এলেই এক চিলতে জমিতে বিনিয়োগের শখ। যেখানে জমি সেখানে বহুতল ভবন তৈরি করা গেলে ভাড়াটের অভাব নেই। গ্রামের তুলনামূলক কম মূল্যের জমি কিনে বিনিয়োগ করতে করতে সেই গ্রাম কখন যেন বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করতে শুরু করেছে তা চোখ ফেরালেই তো ফিরে আসছে। জমির অভাবে কৃষক যেমন জমিতে নেই। জেলেরা জলের অভাবে মাছ ধরতে পারছে না। নাপিত হচ্ছে অন্য পেশার মানুষজন। আবার চাকরিতে এখন ঢুকে যাচ্ছে সর্দার, বিশ্বাস, মণ্ডল, খুনকার বা খন্দকার, মোল্যা, ঠাকুর, বৈশ্য, শূদ্রের সবাই। একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সবাই লেখাপড়া করে বংশীয় কেউ পিয়ন কেরানি হচ্ছে। আবার কেউ বাগিয়ে নিচ্ছে বড় বড় পদ। আমাদের গ্রামীণ মানুষেরা অনাদিকাল থেকে ঘরের আড়ে তবিল বা তহবিল বানিয়ে আবার কেউবা নিজের কোমরে খুতি বেঁধে পয়সা সঞ্চয় করতেন। সঞ্চয়ের এই চেহারায় এখন পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সঞ্চয় করতে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ আয়োজনে আড়ম্বরতায় সাজানো হয়েছে। এই আয়োজন এনজিও আর নন-এনজিও পরিচয়ে ঘর পর্যন্ত এগিয়েছে। সুবিধা হলো আগে নিজের টাকায় নিজের নিরাপত্তা ছিল আর এখন এত আয়োজনেও এই বিনিয়োগ নিরাপত্তাহীন।

শহর এখন গ্রামের মানুষের কাছে আগের মতো মোহ জন্মাতে পারে না। শহরের আলোর ঝলকানিতে আলো-আঁধারির খেলা থাকলেও এখানকার আলো, বায়ু ও জলদূষণ মানুষের বসবাসের জন্য বিপজ্জনক। এক সময়ের গ্রামের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে এখন যেন অনাকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। খোপবন্দি বসবাসে মানুষের আচার-আচরণে কোনো মানবিকতা নেই, নেই আপন মানুষের যোগসূত্র বন্ধন। গ্রামে ঘর সাজানোর স্বাধীনতা আছে। খোলামেলা জীবনে চাওয়া আছে, পাওয়া আছে।

একসময়ে গ্রামীণ মানুষের আয়-ব্যয়ের যে পর্যায় ছিল তা আজ রূপান্তরিত হয়ে গেছে। তবে আগে যে সুদখোর মহাজনের বাহুবন্দিতে ছিল এখন তা কেবলই করপোরেট পুঁজিতে আবদ্ধ হয়েছে। খোলামেলা কাঁচা ঘরের আঙিনা পেরিয়ে চাকচিক্যের ফ্রেমে গিয়ে ঢুকেছে এয়ারকন্ডিশন নামের হিমশীতল বায়ুতে শরীর জুড়িয়ে। একসময় একটুকরো মাংস বা জন্মদিনের কেক কাটতে কামারের যে ছুরি খুঁজতে যেত এখন সেটা জোগাড় হয় ইনটেক নামের করপোরেট পুঁজিতে তৈরি শিল্পপণ্য প্যাকেটজাত বাক্স হতে।  

বর্ণপ্রথাকে একসময় বিদেশী শাসকেরা তাদের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করে নিয়েছিল। আবার এই বর্ণপ্রথা আজ বাধ্যতা মানে মানবাধিকার বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার এক স্বাদ বাঙালিদের কাছে। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার আরেক স্বাদ এই বাঙালিদের কাছে। একটি পরাধীনতায় আবদ্ধ করে দিয়েছিল। আরেকটি নিজ মানচিত্রে বসবাসের ঠিকানা তৈরি করে দিয়েছে। আর যা-ই হোক এই দেশে একটি সময় গেছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ উদ্যোগে পল্লীকে নগরায়ণের আদল দিয়ে মানুষের মৌলিক মর্যাদা দিতে উদ্যত হয়েছিলেন আবার অনেক মানুষের ভিড় তাদের মন, আর্থসামাজিক চিন্তার কারণে এখন চোখের পলকেই গ্রাম ঠিকানা তৈরি করে নিচ্ছে নগরায়ণের সুবিধা নিয়ে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের খেত, ঘাট, বৃক্ষ, বাগান, বট বৃক্ষের ছায়াতলের হাট কিংবা ছোট ছোট গাঁওগেরাম আর থাকছে না। রূপান্তর হতে হতে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। হয়তো অতি দ্রুত জনাধিক্যের কারণে ছোট্ট পরিসরের বাংলাদেশটা সোডিয়াম বাতির আলোকচ্ছটায় রূপনগরের ছায়াতল হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং হারিয়ে যাবে গ্রামীণ বৈশিষ্ট্যের স্মৃতিচিহ্নটুকু। 


গৌতম কুমার রায়: প্রাবন্ধিক, উদ্ভাবক-গবেষক (জাবি, সাভার, ঢাকা) ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন