অপ্রচলিত পণ্যের বিকাশ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

‘কলা রুয়ে না কেটো পাত

তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত’

খনার বচনের এই শ্লোক মনে করিয়ে দেয় কলার চাষ করে কৃষকের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান সম্ভব ছিল সেই সুপ্রাচীন কালেও। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা কৃষিপ্রধান এই বঙ্গীয় বদ্বীপে স্বয়ম্ভর অর্থনীতি অতীতে অনায়াস সাধ্য ছিল না। পরবর্তী দীর্ঘ উপনিবেশবাদের কালে কৃষি অর্থনীতির আন্তঃসহায়ক সলিলা শক্তিতে ধরে ফাটল, অতি মাত্রায় একঘরে হয়ে পড়ে স্থানীয় পণ্য, বাজার ব্যবস্থা হয়ে পড়ে সংকুচিত, উৎসাহে ভাটা পড়ে কৃষি উৎপাদনে, খরা দেখা দেয় সৃজনশীলতায়, বুননে, কর্মকুশলতায়।

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ কৃষি খাতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে। আর এই এগিয়ে যাওয়ার হাত ধরে যেমন বিকশিত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি আবার বিকশিত গ্রামীণ অর্থনীতিই এই উন্নতির পেছনে অন্যতম নিয়মিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সুতরাং এটা অনস্বীকার্য থেকে যায় যে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতির পেছনে গ্রামীণ অর্থনীতি তথা ‘লাঙলের পিছনে যে মানুষ’ সেই পরিশ্রমী আমজনতার ছিল বা আছে অনবদ্য অবদান। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭১-৭২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, একই সীমা-পরিসীমার সেই বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। ১৯৭১-৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে শুধু নয়, বৈশ্বিক মন্দার কারণেও তীব্র খাদ্য ও সম্পদ সংকটে ছিল যে দেশ সেই বাংলাদেশ ৪৯ বছর পর এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদিও এরই মধ্যে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে এবং ভোক্তার সংখ্যা ও চাহিদা বেড়েছে আড়াই গুণ। এই নীরব বিপ্লবের নায়ক বাংলাদেশের কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে অপ্রচলিত পণ্য উৎপাদনে, বিপণনে, ব্যবহার উপযোগিতায় ঘটে যাওয়া ব্যাপক পরিবর্তন বা উন্নতি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের (ইউএসডিএ) প্রত্যয়নমতে বাংলাদেশ এখন চাল, পুকুর, খাল-বিলের উন্মুক্ত পানিতে মাছ ও শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, একুয়াকালচার অর্থাৎ মাছ চাষে পঞ্চম এবং মৌসুমি ফল উৎপাদনে দশম অবস্থানে।

সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে ‘নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’ বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার জন্য সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি তথা গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরের লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বাধীনতার পর থেকেই নিরন্তর কাজ চলছে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। বলা বাহুল্য, অপ্রচলিত পণ্য বিকাশে নানা উদ্ভাবনী কর্মযজ্ঞে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার পারঙ্গমতায় আজকের এই টেকসই সাফল্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা, ২০১৯’ উপাত্ত অনুযায়ী দেশের মোট ১৬ কোটি ৫৭ লাখ জনগোষ্ঠীর ২১.৪% শহরে, বাকি ৭৮.৬% গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। অর্থনৈতিক মুক্তি তথা স্বয়ম্ভর জাতীয় অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক শক্তি বিকাশের জন্য গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন অনিবার্য। লক্ষণীয়, সেখানে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ এ বিকাশকে ত্বরান্বিত করছে। এসএমই ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) পরিচালিত ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে নারী উদ্যোক্তা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত ২০১৭’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ২০০৯ সালে শিক্ষিত ২০ শতাংশ নারী ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১৭ সালে তা বেড়ে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছে নারীদের। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, গ্রামীণ পরিবহন ও যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হওয়ায় স্বল্প আকারে হলেও বাড়ছে নারীর সম্পৃক্ততা। এক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবারগুলোর আয় ও কর্মসংস্থান বাড়াতে অকৃষি খাতের অবদানও বাড়ছে। মাইক্রোক্রেডিটের দেশ বাংলাদেশ। মাইক্রোক্রেডিট গ্রামীণ অর্থনীতিতে অপ্রচলিত পণ্যের বিকাশে এবং সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ মাইলফলক হয়ে রয়েছে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রেক্ষাপটে।

বৈচিত্র্য ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের অগ্রসরমান গ্রামীণ অর্থনীতিতে। শহরের পাশাপাশি এখন গ্রামেও বাড়ছে বিনিয়োগ। কৃষিজ ও অকৃষিজ কর্মকাণ্ডের বহুগুণ ও বহুমুখী সম্প্রসারণ হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, গ্রামীণ পরিবহন ও যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার পাওয়ায় গ্রামীণ জনপদে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ও চাঞ্চল্য বেড়েই চলছে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবারগুলোর আয় ও কর্মসংস্থান বাড়াতে অকৃষি খাতের অবদানও বাড়ছে। 

গ্রামীণ অর্থনীতিতে একজন উদ্যোক্তা ক্ষুদ্র মূলধন গঠনের পাশাপাশি সমাজে সম্পদ তৈরি করেন এবং এ প্রক্রিয়ায় বেকারত্ব ও দারিদ্র্য হ্রাস পায়। গ্রাম পর্যায়ে উদীয়মান উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা যেমন—ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কুটির শিল্প, কৃষিকাজ এবং অর্থনৈতিক বিকাশের শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করেন। দেশীয় সম্পদ অর্থাৎ স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে স্থানীয় জীবনযাত্রার মান উন্নীতকরণের মাধ্যমে স্বনির্ভর ও স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে তাদের রয়েছে তাত্পর্যপূণ অবদান। বিগত পাঁচ দশকে এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে যে গ্রামীণ অঞ্চলের বিকাশ ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বগামী হয়ে অর্থনীতির সহায়ক সলিলা শক্তি বা সহনশীল (রেজিলিয়েন্ট) ক্ষমতা দিন দিন বেড়েছে। ব্যক্তি, পরিবার ও সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নত করার জন্য এবং একটি স্বাস্থ্যকর অর্থনীতি ও পরিবেশ বজায় রাখতে সেই সহনশীল শক্তি প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। মহামারী করোনায় বিপর্যয় মোকাবেলায় ধকল সওয়ার সক্ষমতা গ্রামীণ অর্থনীতি দেখাতে পারছে। স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোতে এ সক্ষমতা ছিল বেশ দুর্বল। বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান ২৫ ভাগ, সেখানে সব শিল্প খাতের রয়েছে ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ৭৮ লাখ উদ্যোক্তাই জিডিপিতে এ অবদান রাখছেন। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধু বিগত ১০ বছরেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি ৫ দশমিক ৫৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। মাথাপিছু আয় দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৮৪৩ থেকে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার পৌঁছেছে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে অপ্রচলিত পণ্যের তালিকাটি দিন দিন বড় হচ্ছে। মৎস্য ও হিমায়িত চিংড়ি, ব্যাঙের পা, শুঁটকি, কাঁকড়া, কুচে, শাকসবজি, শাকসবজির বীজ, নারকেলের ছোবড়া ও খোল দিয়ে তৈরি পণ্য, ফলমূল, পান, সুপারি, গোল আলু, মসলা, হাতে তৈরি কার্পেট, অলংকার ও অন্যান্য হস্তশিল্প দ্রব্য, টেরিটাওয়েল ও স্পেশালাইজড টেক্সটাইল, পরচুলা, গরুর নাড়িভুঁড়ি, চারকোল, টুপি, বড়শি, মশারি, শুকনা খাবার, পাপড়, হাঁসের পালকের তৈরি পণ্য, লুঙ্গি, জুতা, কাজুবাদাম, চশমার ফ্রেম, কৃত্রিম ফুল, গলফ শাফট, খেলনা, আগর, ছাতার লাঠি, ব্লেড, রেশম, রাবার, ফেলে দেয়া কাপড় থেকে তৈরি পণ্য, ভবন নির্মাণসামগ্রী, সিরামিক পণ্য, রাসায়নিক দ্রব্য, গ্যাস, পেট্রোলিয়াম উপজাত, দিয়াশলাই, গুড়, পার্টেক্স, রেয়ন—ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি, বই-পুস্তক, সাময়িকী, ফিচার ফিল্ম, রেশম, তোয়ালে, শরীর থেকে রক্ত নেয়ার পাইপ (ব্লাড টিউবিং সেট), অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই), সি আর কয়েল, তামার তার ইত্যাদি।

বাংলাদেশে প্রায় ৭০ রকমের প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফল জন্মে। প্রচলিত ফলের মধ্যে কলা, আম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, পেঁপে, লেবু, বাতাবিলেবু, লিচু, কুল ও নারকেল উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে কামরাঙা, লটকন, সাতকড়া, তৈকর, আতা, শরিফা, জলপাই, বেল, আমড়া, কদবেল, আমলকী, জাম, ডালিম, সফেদা, জামরুল, গোলাপজাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য অপ্রচলিত ফল। স্থানীয় ও বিদেশী ফল এ দেশের উষ্ণ-অব উষ্ণ জলবায়ুতে জন্মে বিধায় স্বাদে, গন্ধে, আকারে ও ফলনে নানা বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়।

গ্রামীণ সেবা খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বিউটি পার্লার, বিকাশ, নগদ, এজেন্ট ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য ও ফার্মেসি সেবা, ফটো স্টুডিও, সার্ভিসিং ভিত্তিক কার্যক্রম, পাম্প মেরামত ও সার্ভিসিংসহ জ্বালানি ইঞ্জিন পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত, মোবাইল, রেফ্রিজারেটর, যানবাহন মেরামত, খুচরা বা পাইকারের দোকানে সরবরাহকৃত পরিষেবা, মুদ্রণ, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, চা স্টল, সার, কীটনাশক ও বীজ বিক্রির দোকান, মাছ-মাংসের ব্যবসা, টেক্সটাইলভিত্তিক কাজগুলোর মধ্যে বুনন, কাটা, টেইলারিং ও মেরামতের অন্তর্ভুক্ত। 

সাম্প্রতিক হিসাবে বাংলাদেশের মোট রফতানিতে অপ্রচলিত দ্রব্যের অবদান শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি। একদম অপরিচিত পণ্যও রয়েছে এ তালিকায়। যেমন এসব পণ্যের কারখানা সাধারণত বড় হয়, বিনিয়োগও একটু বেশি। তালিকার অন্য কারখানাগুলো ছোট ছোট। আবার এমন পণ্যও রয়েছে, যার একটিমাত্র কারখানা রয়েছে দেশে। প্রধান রফতানি পণ্য পোশাকের পাশাপাশি দেশের আনাচকানাচে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে নানামুখী রফতানি পণ্যের ছোট ছোট কারখানা। কেউ দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে আবার কেউ কাঁচামাল আমদানি করে এসব কারখানা গড়ে তুলেছেন। 

কোনো কোনো পণ্যের রফতানির পরিমাণ খুব বেশি নয়, কোনো কোনো পণ্যের রফতানির পরিমাণ আবার বেশ ভালোই। কিছু পণ্য আছে বিশ্ববাজার খুব বড় নয়, আবার কিছু আছে অনেক বড় বাজার, তুলনায় বাংলাদেশ রফতানি করছে সামান্যই। কমবেশি যা-ই হোক না কেন, দিন যাচ্ছে আর রফতানির ঝুড়িটি বড় হচ্ছে বাংলাদেশের। এতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়ছে, অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাও। প্রতিবেশী দেশের পাশাপাশি ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলোতেও যাচ্ছে বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্য। রফতানি আয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অপ্রচলিত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশের আয় হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান।

উৎপাদনমুখী কাজে নিয়োজিত হবে মানুষ, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, নিজের আয়ও বাড়বে, এ চিন্তাচেতনায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরপা এলাকায় ওয়াহিদুজ্জামান গড়ে তোলেন মশারি উৎপাদনের ছোট এক কারখানা। এখন তার দুটি কারখানা। ‘দৈনিক পাঁচ লাখ মিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কারখানায় প্রথমে ১০০ জন নিয়ে শুরু করা হয়েছিল ২০০৫ সালে। এখন কমর্রত ২ হাজার ৫০০ জন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি হয় প্রায় ১ কোটি ডলারের মশারি। প্রতি বছর মশারির উৎপাদন ও রফতানি বাড়ছে। মাসে রফতানি হয় ৫৫০-৬০০ টনের মতো। ৫০ ধরনের মশারি উৎপাদন হয়। এগুলোর দাম ১৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। আপাতত ভারতে রফতানি হলেও আফ্রিকার কিছু দেশে রফতানির চেষ্টা চলছে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের সালদিঘা গ্রামটি মোগল আমল থেকেই আগরের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। বে অব বেঙ্গল পারফিউমারি নামের প্রতিষ্ঠানের আওতায় এ গ্রামে গড়ে উঠেছে আগর উৎপাদনের জন্য ৫০টি ইউনিট। ৩০-৩৫টি ইউনিট সব সময় চালু থাকে। উপজেলার ৩০-৪০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আগর উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। জানা যায়, ‘বংশপরম্পরায় মোগল আমল থেকেই চলে আসছে আগরের ব্যবসা। আগর তৈরি হয় আগর গাছের কাঠ থেকে। সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম এসব অঞ্চলে আগর গাছ উৎপাদন হয়। আগর রফতানিকারকের উৎসাহে অন্য অঞ্চলেও কিছু কিছু আগর কাঠ উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় বিশ্ববাজারে প্রতি বছর ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার আগরের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ সেখানে রফতানি করে মাত্র ১৩ কোটি টাকার আগর। বাংলাদেশে তিন ধরনের আগর তৈরি হয়। ১২ গ্রাম আগর বিক্রি হয় ৫ থেকে ১২ হাজার টাকায়। রফতানি হয় মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরব, দুবাই, কাতার ইত্যাদি দেশে।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার সমমূল্যের গরু-মহিষের নাড়িভুঁড়ি রফতানি হচ্ছে। সিংহভাগই যাচ্ছে চীন, হংকং, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে। এটি দিয়ে উন্নত মানের স্যুপ ও সালাদ তৈরি হয় এবং তা চীনাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় খাবার। ইংরেজিতে নাড়িভুঁড়ির নাম ‘ওমাসম’, যা একসময় উচ্ছিষ্ট হিসেবে খাল-নালা ও ডোবায় ফেলে দেয়া হতো। পণ্যটি রফতানি পণ্য হিসেবে পরিচিতি পায় চট্টগ্রাম থেকে। দেশে বর্তমানে ২৫ জন নাড়িভুঁড়ি রফতানিকারক রয়েছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোক ঠিক করে বছরজুড়েই তারা ওমাসম সংগ্রহ করেন। কোরবানির সময় সংগ্রহ করা হয় বছরের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মাসে ১৫টি কনটেইনার ওমাসম রফতানি হয় এবং একেকটি কনটেইনারে ৬০-৭০ হাজার পিস ওমাসম থাকে। এক টন প্রক্রিয়াজাত করার পর ৭০০ কেজি ওমাসম পাওয়া যায়। দেশের ওমাসম রফতানিকারকদের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম অঞ্চলের। অপ্রচলিত পণ্য শ্রেণীতে ওমাসম রফতানিতে বর্তমানে ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হয়। বিশ্বে ৩২ হাজার কোটি টাকার ওমাসমের বাজার রয়েছে।

দিন বদলেছে। চলছে চুলেরও ব্যবসা। কেটে ফেলা চুল এখন দেশের বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে, রফতানিও হচ্ছে। তবে প্রাকৃতিক চুলের চেয়ে কৃত্রিম চুলের বাজারই বড়। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলারের কৃত্রিম চুল ও মানুষের মাথার চুল রফতানি হয়েছে। ১ ডলার ৮৫ টাকা করে হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আগের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ পণ্য রফতানি হয়েছিল ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। অর্থাৎ এক বছরে বেড়েছে ৪১ শতাংশ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নারীরা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর পর যে চুল পড়ে, তা ফেলে না দিয়ে গুছিয়ে রাখেন বিক্রির জন্য। গ্রামের ফেরিওয়ালারা মাসে একবার সেই চুল কিনে নিয়ে যান। চুলের বিনিময়ে চুড়ি, শাড়ি, হাঁড়িপাতিলও বদল হয়।

এসব চুল দিয়ে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের পরচুলা। কেটে ফেলা চুল প্রতি কেজি ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। তবে শর্ত হচ্ছে, চুলের আকার একটু বড় হতে হয়। বাংলাদেশে চুলের ব্যবসা বড় হতে থাকে মূলত ১৯৯৯-২০০০ সালের পর। এক কেজি চুল প্রক্রিয়াকরণের পর ৬০০ গ্রাম হয়। বাংলাদেশ থেকে দুই রকমের চুল রফতানি হয় এবং মান নির্ণয় করা হয় চুলের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী। জানা গেছে, প্রতি কেজি চুলের দাম ৭ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ইতিবাচক ব্যাপার হচ্ছে, পরচুলা রফতানিও প্রতি বছরই বাড়ছে। 

সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, রাজশাহী, নওগাঁ, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় চুল বেচাকেনার দোকান রয়েছে বলে জানা গেছে। নওগাঁয় সাপ্তাহিক হাটও বসে। দেশে চারটি পরচুলা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার তিনটিই ইপিজেডে এবং তিনটির মালিকানাই চীনাদের। এর মধ্যে উত্তরা ইপিজেডে রয়েছে এভারগ্রিন প্রডাক্টস, ঈশ্বরদীতে এমজেএল কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ও মোংলায় রয়েছে ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি। ইপিজেডগুলো চলে বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) আওতায়। এর বাইরে গাজীপুরেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

১৯৮৮ সালের বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তখন ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার অদম্য চেষ্টা মানুষের ঘরে ঘরে। এরই মধ্যে একদিন বগুড়ার ধুনটের জনৈক আজহার আলী বাজার থেকে ফিরে একটা সুতার টুপি আর কুরুশ-কাঁটা তার স্ত্রীকে ধরিয়ে দিলেন। বললেন টুপি তৈরির চেষ্টা করতে। স্ত্রী হাতে তুলে নিলেন সুই-সুতা। বছর দুয়েক নিজেই বাড়িতে টুকটাক টুপি তৈরির চেষ্টা করলেন। পরে সুই-সুতায় টুপি বুননের কাজটা শেখানোর কাজও শুরু করলেন অন্য নারীদের। একসময় গ্রামীণ লাখো নারীকে সচ্ছল-স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের চককল্যাণী গ্রামের আরো অনেক নারী। বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম চককল্যাণী থেকে টুপি তৈরির কর্মজজ্ঞ এখন ছড়িয়ে পড়েছে শেরপুর ছাড়াও ধুনট, বগুড়া সদর, শিবগঞ্জ, শাজাহানপুর উপজেলার শতাধিক গ্রামে। প্রায় তিন লাখ নারী জড়িয়ে পড়েছেন টুপি তৈরির এ কর্মযজ্ঞে। টুপি তৈরির পেশায় দারিদ্র্য ঘুচিয়েছেন হাজারো নারী। গড়ে প্রতিদিন সুই-সুতায় টুপি তৈরি হচ্ছে দুই লাখ। প্রতিটি টুপির বাজারমূল্য গড়ে ৩০ টাকা। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ৬০ লাখ টাকার টুপি তৈরি হয়। বছরে টুপি তৈরি হয় ২১৯ কোটি টাকার। এর এক-তৃতীয়াংশ রফতানি হয়। টুপি শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এখানে রফতানি প্রক্রিয়াজাত কারখানা, টুপির উপযোগী সুতা তৈরি ও ধোলাই কারখানা। এসব টুপি রফতানি হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, দুবাইসহ বিশ্বের নানা দেশে। অবশিষ্ট টুপি যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাইকারি বাজারে।

রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭১৬ কোটি টাকার বাইসাইকেল রফতানি হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপসহ কয়েকটি বড় কারখানা রয়েছে সাইকেল উৎপাদনের। গত অর্থবছরে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার ডলারের কাঁকড়া রফতানি হয়েছে, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা ৩৬৫ কোটি টাকার সমান। 

বাণিজ্য নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির দুই মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে যে লড়াই চলছে, তা থেকে এরই মধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করলে যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ওই দেশটির পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা চীনে না গিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন।


ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন