বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ত্রুটি বিশ্লেষণ : ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণের প্রাসঙ্গিকতা

শেখ রাফি আহমেদ, নহলী নাফিসা খান, সাফা তাসনিম

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে নিজ নিজ দেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে চিন্তিত পুরো বিশ্ব। কীভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এই জাতীয় পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া যায় এই নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, যা বিশেষত এই জাতীয় দেশেকীভাবে স্বাস্থ্যসেবা আরও উন্নত হতে পারে সে সম্পর্কে একটি আলোচনার পথ তৈরি করে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে, ইকোনমিক্স স্টাডি সেন্টার বাংলাদেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্য খাত নিয়ে পর্যালোচনা করার লক্ষ্যে বিদ্যমান তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। সংকটের আরো গভীরে পৌঁছাতে আরো দুইটি ফেনোমেনোলজিকাল স্টাডি করা হয়। প্রথমটিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে কর্মরত চিকিৎসকদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় গবেষণাটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে প্রয়োজনীয় কাঠামো বর্ণনা করার জন্য পরিচালিত হয়েছিল।

কভিড-১৯ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে লেখকেরা দেশের স্বাস্থ্যখাতের মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী কী এবং কী করে দেশের স্বাস্থ্যখাত এগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারে সে বিষয়েই মূলত জোর দেন। একটি বিস্তৃত লিটারেচার রিভিউয়ের পর দেশের স্বাস্থ্য খাতের কিছু মূল বিষয় যেমন স্বাস্থ্য সেবায় বৈষম্য এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলিতে দারিদ্র্যের প্রভাব, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সুবিধার অভাব, অত্যধিক ব্যয়, স্বাস্থ্যবীমার অনুপস্থিতি, অকার্যকরপ্রশাসন, কর্মী ও সরঞ্জামের ঘাটতি, ওষুধ শিল্পে তদারকির অভাব, দুর্নীতি ও তথ্যের ব্যবধান ইত্যাদি উঠে আসে। 

লিটারেচার রিভিউ থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বৈষম্য একটি বড় সমস্যা। স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য কেবলমাত্র আর্থ-সামাজিক অবস্থান কিংবা বয়স অথবা অবস্থানভিত্তিক কারণ ছাড়াও আরো নানা কারণেই বিদ্যমান। এ খাতে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যও প্রচুর। এই বিষয়গুলো শুধু স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সম্ভাবনাকেই প্রভাবিত করে না বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসা সহায়তা চাওয়ার আচরণকেও প্রভাবিত করে। উদহারণস্বরূপ, শীর্ষ ২০ শতাংশ পরিবারে শিশুর জ্বর, ডায়রিয়া বা শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত সমস্যা গুলোর ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের ২০ শতাংশ পরিবারের তুলনায় তিনগুণ বেশি চিকিৎসা সহায়তা নেবার সম্ভাবনা থাকে। অসুস্থ শিশুদের মধ্যে কেবল ৩৭ শতাংশ শিশু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে চিকিৎসা নেয়, এর মধ্যে দরিদ্র ও মেয়ে শিশুদের সংখ্যা কম। অত্যধিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বৈষম্যের সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চিকিৎসা ব্যয় নাগরিকদের নিজ পকেট থেকে করতে হয় এবং এতে করে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে দরিদ্র পরিবারগুলোর। কেননা তাদের আয়ের বড় একটি অংশ এই স্বাস্থ্যসেবা নিতেই চলে যায়। স্বাস্থ্য সেবা নেয়ার সামর্থ্য না থাকার ফলে স্বাস্থ্যের আরো অবনতি ঘটে এবং স্বভাবতই দরিদ্র মানুষের উপার্জনক্ষমতা আরো হ্রাস পায়। এছাড়াও, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা, বীমার ওপর আস্থা ও অবকাঠামো ব্যবস্থা ইত্যাদির অভাবের কারণে এদেশে স্বাস্থ্য বীমা খুব একটা জনপ্রিয় নয়।

স্বাস্থ্য তথ্য সেবা (এইচ আই এস) এখনও পুরোপুরি উন্নত নয়। এ কারণে সাধারণ জনগণ এর মধ্যে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা সেবা, প্রতিরোধমূলক সেবা ইত্যাদির সঠিক জ্ঞান নেই এবং এ কারণেই এই মহামারী চলাকালীন লোকজনের মধ্যে ব্যাপক অসেচতনতা দেখা যায়। ওষুধ শিল্পে তদারকির অনেক অভাব রয়েছে এবং শীর্ষ ১০টি প্রতিষ্ঠানই প্রায় ৭০ শতাংশ ওষুধের জোগান দেয়। যথাযথ চিকিৎসাকর্মী এবং সরঞ্জামের  অভাব উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সুবিধা জরিপ ২০০৯ অনুসারে গড়ে ৩০ শতাংশেরও বেশি মৌলিক সরঞ্জাম স্বাস্থ্য সেবায় অনুপস্থিত। প্রতি এক হাজার লোকের জন্য শূন্য দশমিক ৩০ চিকিৎসক, শূন্য দশমিক ২৮ নার্স বা ধাত্রী ও শূন্য দশমিক ২০ দন্ত চিকিৎসক আছেন।

মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলির সাথে জনসংখ্যার পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সহায়তার অভাব অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যেহেতু মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে ঘিরে বাংলাদেশে নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত আছে এ কারণেই প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ০ দশমিক ৪৯ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রয়েছে। অথচ প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের প্রায় ১৬ শতাংশই কোন না কোন মানসিক রোগে ভুগছেন। অপর্যাপ্ত চিকিৎসা কেন্দ্র, সচেতনতার অভাব ও পরবর্তীতে ফলো-আপের দুষ্প্রাপ্যতাই এ খাতের মূল বাধা।

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবেই খুবই অদক্ষ। প্রশাসনিক এবং নিয়ন্ত্রক সমস্যাগুলি নীতি নির্ধারণ এবং পরিকল্পনার জন্য সচিবালয়কে পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয় না। এছাড়াও, সচিবালয়ের কর্মকর্তাদেরও স্বাস্থ্য খাতে নির্দিষ্ট জ্ঞান বা প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। প্রতিটি সংস্থার ভূমিকাকে যথাযথ সম্মান প্রদান, সেগুলো মেনে চলা- এ জাতীয় কোন আনুষ্ঠানিক সমন্বয় ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি ক্ষেত্রেই গ্রথিত হয়ে রয়েছে দুর্নীতি। সরকারি পদ ক্রয়, ঔষধ অপব্যবহার, সরকারি তহবিল থেকে অর্থ পাচার ইত্যাদি এ খাতের বৃহৎ কিছু সমস্যা এবং এগুলোর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। 

প্রথম ফেনোমেনোলজিকাল স্টাডির ক্ষেত্রে সাতজন চিকিৎসক যারা বর্তমানে এ ক্ষেত্রে কর্মরত আছেন এবং করোনা পরিস্থিতিতে ফ্রন্টলাইনে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের অভিজ্ঞতাগুলো জানার চেষ্টা করা হয়। এখান থেকে ৬৮টি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি উঠে আসে এবং এগুলোকে ১৬টি ক্লাস্টারে থিম অনুযায়ী ভাগ করা হয়। এতে জানা যায় সকলেরই কিছু কমতি থাকা সত্ত্বেও মেডিকেল কলেজে একটি সুন্দর শেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে, মহামারীর আগে ও পরে স্বাস্থ্য প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত সম্পদের অভাব, জনবলের অভাব এবং রোগীদের অতিরিক্ত বোঝা নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ছিল। প্রাথমিক বছর গুলিতে আর্থিক সুযোগের অভাব এবং সুরক্ষার অভাবের কারণে তারা কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিলেন। স্বাস্থ্য প্রশাসনের দুর্নীতির স্বীকারও হতে হয়েছে তাদের। এছাড়াও, পিপিই এর গুণগত মান, টেস্টিং এর সুবিধা, আইসিইউ এর অভাবের ফলে চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক দুর্ভোগের কথাও জানান তারা। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে করোনা নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়ানোর কারণেও রোগীদের সামাল দিতে বেশ বিপাকে পড়তে হয় চিকিৎসকদের।

দ্বিতীয় স্টাডির ক্ষেত্রে চারজন চিকিৎসা গ্রহণকারীর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা যায়। এখানে, ৭৬টি বিবৃতিকে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ থিমের অধীনে ভাগ করা হয়। রোগীদের অভিজ্ঞতায় করোনা চিকিৎসা প্রদানকারী হাসপাতাল গুলোতে বেশ কিছু সমস্যা ছিল। যথেষ্ট পরিমাণ সেবাদাতার অভাব, সিটের অভাব এবং কখনো কখনো সেবাদাতাদের কাছ থেকে কিছুটা অবহেলার স্বীকার হয়েছেন। আরো জানা যায় বেসরকারি হাসপাতাল্গুলোতে চিকিৎসার খরচ বেশি হলেও সেবার মানও এক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল গুলোর চেয়ে ভাল ছিল। এছাড়াও, করোনা টেস্ট, সময়মতো আইসিইউ সুবিধা পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তাদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। উত্তরদাতারা এটিও জানান অনেক ক্ষেত্রেই আইসিইউ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক যোগসাজশের প্রয়োজন হয়। 

ইকোনমিক্স স্টাডি সেন্টার আশা করে এই গবেষণা প্রবন্ধটি বাংলাদেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার ত্রুটি বিশ্লেষণের একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করবে এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে গুণগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাকে সকলের সামনে তুলে ধরবে।

লেখক পরিচিতি

- শেখ রাফি আহমেদ
  পি আর অ্যান্ড কমিউনিকেশন সেক্রেটারি, ইকোনমিকস স্টাডি সেন্টার
- নহলী নাফিসা খান
  সহ সভাপতি, ইকোনমিকস স্টাডি সেন্টার
- সাফা তাসনিম
  অ্যাসোসিয়েট মেম্বার, ইকোনমিকস স্টাডি সেন্টার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন