বন্ধুত্ব টেকেনি, টেকেনি ব্যবসাও

বিনিয়োগ করে বিপাকে ৫ ব্যাংক

ওমর ফারুক চট্টগ্রাম ব্যুরো

জাহাজভাঙা শিল্পের সুদিন চলাকালে খাতের ব্যবসায় নামেন চট্টগ্রামের ছয় বন্ধু। গড়ে তোলেনসুপার সিক্স স্টার করপোরেশননামে একটি প্রতিষ্ঠান। শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই তিনজন সরে পড়লেও ব্যবসা চালিয়ে যান বাকি তিনজন। কিন্তু জাহাজভাঙা শিল্পে মন্দা দেখা দিলে ওই তিন বন্ধুর সম্পর্কেও ফাটল ধরে, বন্ধ হয়ে যায় যৌথ ব্যবসা। সেই সুপার সিক্স স্টারে বিনিয়োগ করে এখন বিপাকে রয়েছে পাঁচ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির কাছে আটকা পড়েছে ব্যাংকের ১৪৪ কোটি টাকা।

বর্তমানে সুপার সিক্স স্টার করপোরেশনের কাছে জনতা ব্যাংক লালদীঘি শাখার ৬০ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রায় ৪৯ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ২১ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক লালদীঘি শাখার কোটি সাউথ ইস্ট ব্যাংক সিডিএ শাখার কোটি টাকা আটকে আছে।

পাওনাদার ব্যাংক ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সুপার সিক্স স্টার করপোরেশন ১৯৯৪ সালে ইস্পাত খাতে ব্যবসা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির তিন অংশীদার ছিলেন মোজাহের হোসেন, শামসুল আলম ইউসুফ। তবে মূলত ব্যবসা দেখাশোনা করতেন মোজাহের হোসেন। তিন অংশীদারের মধ্যে মোজাহের হোসেন শামসুল আলমের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ার জিরি এলাকায়। অন্যজন মো. ইউসুফের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা হলেও বর্তমানে তিনি নগরীর পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় থাকেন।

সুপার সিক্স স্টার করপোরেশন নাম দিয়ে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা শুরুর আগে মোজাহের হোসেন সরকারি-বেসরকারি অকশন-টেন্ডারের ব্যবসা করতেন। এছাড়া পুরনো জাহাজের আউটফিটিংয়ের (লোহা বাদ দিয়ে তামা, পিতল, কাঠ, প্লাস্টিকসহ অন্যান্য বস্তু) ব্যবসাও ছিল তার। বর্তমানে তিনি জাহিদ অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে অকশন ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

সুপার সিক্স স্টারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে থেকে শিপ ব্রেকিং খাতে রড বিলেটের ব্যবসা করতেন শামসুল আলম। বর্তমানে আলম স্টিল নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার।  

প্রতিষ্ঠানটির অন্য অংশীদার মো. ইউসুফ আগেকর্ণফুলী ক্যাবলসনামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরনো জাহাজের কেবলের ব্যবসা করতেন তিনি। বয়স অসুস্থতার কারণে বর্তমানে কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন ইউসুফ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দুই দশক ভালোই ব্যবসা করছিল সুপার সিক্স স্টার। সমস্যাটা দেখা দেয় শিপ ব্রেকিং খাতে মন্দা নেমে আসার পর। আন্তর্জাতিক দেশীয় বাজারে দামের উত্থান-পতনে ধারাবাহিক লোকসান দিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। ব্যবসার ভালো সময়ে তিন অংশীদার মুনাফা ঘরে তুললেও মন্দার সময়ে তাদের মধ্যেও শুরু হয় সম্পর্কের টানাপড়েন। ক্রমাগত লোকসানে আটকে যাওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের দায়ভার নিতে চাননি কেউই। ফলে বছর বছর সুদ যোগ হয়ে এখন প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাঁচ ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৪৪ কোটি টাকার বেশি। তিন উদ্যোক্তার সমন্বয় না থাকায় প্রায় এক দশকেও ব্যাংকঋণ পরিশোধে কেউ এগিয়ে আসছেন না। কারণে ঋণ আদায় নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

২০১২ সালে পুরনো জাহাজ আমদানির জন্য সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয় সুপার সিক্স স্টার করপোরেশন। এরপর জাহাজ আমদানি করে তা কেটে স্ক্র্যাপ করে বাজারে বিক্রিও করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ব্যাংকের টাকা আর পরিশোধ করেনি। ১০ বছর পার হয়ে গেলেও তিন কর্ণধারের অনৈক্যের কারণে ব্যাংকের ঋণের টাকা উদ্ধার হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, গত ১০ বছর ধরে সুপার সিক্স স্টারের কাছে ব্যাংকের প্রায় ৫০ কোটি টাকা আটকে আছে। বহু চেষ্টার পরও প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করা যায়নি। ব্যাংকঋণ পরিশোধ না করে তারা একজন অন্যজনের ওপর দোষারোপে ব্যস্ত। ফলে গত বছর প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্ণধারের বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা দায়ের করা হয়। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে মামলার অগ্রগতি খুবই কম।

মামলা দায়েরের পরও সুপার সিক্স স্টারের কাছ থেকে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ঋণ আদায় নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির সীতাকুণ্ডের শিপ ইয়ার্ডের ৪১৭ শতক জমি বন্ধক থাকলেও এর মধ্যে ২০৬ শতক জমির বিএস দলিল নেই। এমনকি বন্ধক দেয়া জমির মধ্যে ৬৪ শতক জমি আগেই নিজের স্ত্রীকে হেবা করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং পার্টনার মোজাহের হোসেন। ফলে বন্ধকি সম্পত্তির মধ্যে কাগজপত্র ঠিক আছে এমন জমির পরিমাণ ২১১ শতক, যা বিক্রি করে -১০ কোটি টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। অথচ এখন ব্যাংকটির পাওনা ৪৮ কোটি ৮৫ লাখ ৪৩ হাজার ৯৮৬ টাকা।

জনতা ব্যাংক লালদীঘি শাখারও বড় অংকের ঋণ আটকে আছে সুপার সিক্স স্টার করপোরেশনের কাছে। ব্যাংকের এজিএম লালদীঘি শাখার ব্যবস্থাপক মো. নুরুল মোস্তফা বণিক বার্তাকে বলেন, সুপার সিক্স স্টার করপোরেশনের ৬০ কোটি টাকা পাওনা নিয়ে বেশ ঝামেলায় রয়েছি। কারণ প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে এক দশক আগে। ১০ বছর আগে ব্যাংকঋণ নিয়ে জাহাজ আমদানির এই কর্ণধাররা টাকাও ব্যাংকে শোধ করেননি। ঋণের টাকা উদ্ধারে এরই মধ্যে অর্থঋণ মামলা দায়ের হলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করেছে। আমরা ব্রাঞ্চ থেকে তাদের আবেদনটি প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। এখন প্রধান কার্যালয় আদেশের অপেক্ষায় আছি।

জনতা ব্যাংক সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মতোই ঋণ আদায় নিয়ে বিপাকে আছে ইস্টার্ন, প্রিমিয়ার সাউথ ইস্ট ব্যাংক। স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে ঋণ নিয়ে তা শোধ না করায় এরই মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংক প্রিমিয়ার ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্ণধারের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করেছে।

অন্যটিকে সাউথ ইস্ট ব্যাংক সিডিএ শাখার ২৪ কোটি টাকার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির দুই পার্টনার মোজাহের হোসেন শামসুল আলম কোটি টাকা শোধ করলেও মো. ইউসুফের কোটি টাকা ঋণ আটকে রয়েছে।

ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপার সিক্স স্টার করপোরেশনের তত্কালীন ম্যানেজিং পার্টনার মোজাহের হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, -১০ বছর আগেই আমরা পার্টনারশিপ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি। ওই সময় দফায় দফায় লোকসান দেয়ার কারণে ব্যাংকের ঋণের টাকা আটকে যায়। পরবর্তী সময়ে আমরা যে যার মতো নিজের ব্যবসা পরিচালনা করি। ব্যবসায়িক ব্যস্ততা পার্টনারদের মধ্যে ঝামেলার কারণে ঋণ পরিশোধে বিলম্ব হয়। তবে আমরা এরই মধ্যে একটি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছি। অন্যান্য ব্যাংকের ঋণও দ্রুত পরিশোধের চেষ্টা করছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন