রাজধানীর মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডের ফুটপাতে নতুন টাইলস বসানো হয়েছিল ২০১৮ সালের শেষ দিকে। এক বছরও টেকেনি সেগুলো। কোথাও ভেঙে এবড়োখেবড়ো পড়ে আছে। কোথাও টাইলস সরে গিয়ে তৈরি হয়েছে বড় গর্ত। এ দুর্দশা থেকে বাদ যায়নি প্রধান বিচারপতির বাসভবনের উল্টোপাশের ফুটপাতও। উদ্দেশ্য ছিল ফুটপাত উন্নয়ন করে মানুষকে স্বস্তিতে হাঁটার সুযোগ করে দেয়া। বাস্তবে স্বস্তি তো দূরের কথা, হাঁটার সময় সামান্য অসতর্কতা দুর্ভোগ বয়ে আনছে। যদিও এ দুই সড়কসহ ১৯ ওয়ার্ডের ছয়টি সড়কে টাইলস, ড্রেন ও নর্দমা উন্নয়নে পৌনে ১০ কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
ঢাকার অন্যতম অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি। বছর দুয়েক আগে এ এলাকাতেও ফুটপাত উন্নয়ন করে ডিএসসিসি। ১৫ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের ফুটপাত উন্নয়ন, ড্রেন ও নর্দমা পরিষ্কার প্রকল্পে ব্যয় করা হয় সাড়ে ৮ কোটি টাকা। তবে ফুটপাতে টাইলস বসানোর কিছুদিন পরই সেগুলো ভাঙতে শুরু করে। ড্রেন পরিষ্কার করে সেগুলোর ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর কথা থাকলেও তা সবখানে করা হয়নি। ভাঙন দেখা দিয়েছে ড্রেনের স্ল্যাবগুলোতেও। ফলে সামান্য বৃষ্টি কিংবা অতিরিক্ত প্রবাহ হলেই রাস্তার ওপরে উঠে আসছে ড্রেনের ময়লা পানি।
আরো কয়েকটি সড়কের মতো ধানমন্ডির ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব সড়কের (সড়ক নম্বর ১০) বিভিন্ন স্থানে রাস্তার ওপর ময়লা পানি উঠছে। বিঘ্নিত হচ্ছে মানুষের চলাচল। তবে ড্রেন বেয়ে রাস্তায় ময়লা পানি উঠে আসার দায় ঢাকা ওয়াসার ওপর চাপাচ্ছেন ডিএসসিসির প্রকৌশলীরা। তারা বলছেন, ওয়াসার ময়লা পানির লাইন ১০ নম্বর রোডের ডিএসসিসির ড্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তায় ময়লা পানি উঠে আসার দায় ঢাকা ওয়াসার।
১৭ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে ধানমন্ডির একাংশ, গ্রীন রোড, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাব, এলিফ্যান্ট রোড, পিলখানার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে এ দুই ওয়ার্ডে ফুটপাত নির্মাণ, ড্রেন পুনর্বাসন ও নর্দমা পরিষ্কারের কাজ করে ডিএসসিসি। হোসেন ট্রেডিং করপোরেশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব উন্নয়ন কাজ করে। তবে কিছুদিনের মধ্যে ভাঙতে শুরু করে এ প্রকল্পের টাইলসও। টাইলসের পাশাপাশি রাস্তার আইল্যান্ড যেমন ভাঙতে শুরু করেছে, তেমনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সদ্যনির্মিত ড্রেনও।
প্রায় ১৬ কোটি টাকা খরচ করে ১, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ১২ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের রাস্তা, ফুটপাত ও ড্রেনেজ পুনর্বাসনের কাজ করেছে ডিএসসিসি। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে সাড়ে ৫ কোটি টাকার ফুটপাত ও ড্রেন উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে। ৩৫ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে ফুটপাত, ড্রেন ও নর্দমা উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে ৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। মালিবাগ থেকে কাকরাইল পর্যন্ত সড়ক, ড্রেন ও ফুটপাত উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে আরো ২৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। শান্তিনগর ইন্টারসেকশন থেকে রাজারবাগ ইন্টারসেকশন পর্যন্ত এবং কাকরাইল ইন্টারসেকশন থেকে ফকিরাপুল ইন্টারসেকশন পর্যন্ত সড়ক, ফুটপাত ও নর্দমা উন্নয়নে ব্যয় হয় ২৫ কোটি টাকা।
২০১৭ সালের পর থেকে ডিএসসিসি ঢাকার মোট ৩৭ কিলোমিটার ফুটপাত ও ১৪২ কিলোমিটার ড্রেন উন্নয়ন করেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ২৬টি প্যাকেজের মাধ্যমে এসব কাজ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যয় করা হয়েছে ১৯৬ কোটি টাকা।
ফুটপাত, ড্রেন ও নর্দমা উন্নয়নে গত তিন বছরে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হলেও এসব অবকাঠামোতে আদতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। টাইলস ভেঙে যাওয়া, ড্রেন-নর্দমা উপচে পড়ার মতো বিষয়গুলো তো আছেই। উপরন্তু যেসব জায়গায় ফুটপাত বহাল তবিয়তে আছে, সেগুলোও মসৃণভাবে বসানো হয়নি। ফলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মানুষের সুবিধার বদলে অসুবিধাই তৈরি করেছে বেশি।
অভিযোগ উঠেছে ফুটপাত, ড্রেন ও নর্দমার এই বেহাল দশার জন্য দায়ী নিম্নমানের নির্মাণকাজ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের এসব বেহাল দশার বিষয়ে গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করে মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ফোন রিসিভ করেননি ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. ইমদাদুল হক ও সচিব আকরামুজ্জামান।
পরে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। কাজটি খুব সম্ভবত ডিএসএসসির আগের মেয়রের সময় হয়েছে। নিম্নমানের নির্মাণকাজের কারণে ফুটপাত ও ড্রেনের বেহাল অবস্থা হলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। যত দ্রুত সম্ভব আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টির খোঁজ-খবর নেব। এতে নিম্নমানের নির্মাণকাজ বা কারো দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও আমরা নেব।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় সংশোধিত) ওপর সম্প্রতি একটি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। সেখানেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সদ্য নির্মাণ করা ফুটপাতের বেহাল দশার কথা উঠে এসেছে।