কভিড-১৯-এর প্রভাব

যশোরের অর্থনীতিতে হাজার কোটি টাকা ক্ষতি

আবদুল কাদের যশোর

দেশের চামড়া খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে যশোরের শিল্প শহর নওয়াপাড়ায় অবস্থিত এসএএফ টানা ৩২ বছর ধরে ফিনিশড চামড়া রফতানি করছে প্রতিষ্ঠানটি পর্যন্ত চারবার জাতীয় রফতানি ট্রফি অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি বছরে ৪০০ কোটি টাকার চামড়াজাত দ্রব্য রফতানি করে তারা তবে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে

অন্যদিকে যশোরের অর্থনীতির একটি বড় বাজার হলো মোটরপার্টস শহরের ক্লোডস্টোর এলাকার ফারিয়া মোটরস বড় গাড়ির জন্য ভারত থেকে আমদানীকৃত ইঞ্জিন বিক্রি করে সারা দেশের ক্রেতারা তাদের কাছ থেকে ইঞ্জিন কিনে নিয়ে যান আগে যেখানে প্রতিদিন কমপক্ষে একটি বা দুটি ইঞ্জিন বিক্রি হতো, সেখানে প্রায় তিন মাস ধরে কোনো ক্রেতাই নেই

শুধু এসএএফ ফারিয়া মোটরস নয়, উৎপাদনমুখী ব্যবসাবহুল যশোরে অন্যান্য খাতেও এসেছে নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) আঘাত একমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আর কোনো ব্যবসায় যেন গতি নেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা আবাসিক হোটেলগুলো

একই অবস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীতে গড়ে ওঠা উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও যশোর শহরের পাশেই ঝুমঝুমপুরে ৫০ একর জমির ওপর ১৯৬২ সালে গড়ে ওঠা শিল্পনগরীতে মোট ১১৮টি ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ১১৫টি ইউনিটেই শিল্প-কলকারখানা চালু রয়েছে এসব শিল্প-কারখানায় হাজার ৯১৮ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে উৎপাদনমুখী পণ্যের ক্রেতা সংকটে ব্যবসা না হওয়ায় শ্রমিকদের বেতন অন্যান্য খরচ দিতে গিয়ে হিশশিম খাচ্ছে নগরীর প্রতিষ্ঠানগুলো

এছাড়া জেলাটিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪০০-এর মতো হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান যেখানে কাজ করেন প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক ফলে কাজ না থাকায় তারাও বেকার হয়ে পড়েছে সব মিলিয়ে যশোরের উৎপাদনমুখী শিল্প সেবা খাতের ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে যেসব খাত নিয়ে যশোরের অর্থনীতি চাকা সচল থাকত, তার বেশির ভাগই এখন রীতিমতো বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে সব মিলিয়ে যশোরের অর্থনীতিতে হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা

বিসিকে অবস্থিত গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার স্বত্বাধিকারী আকতার হোসেন জানান, তিন মাস ধরে তাদের কোনো ক্রেতা নেই অর্ডার না থাকায় যন্ত্রাংশ উৎপাদন করতে পারছেন না তারা এতে শ্রমিকদের বেতন দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের 

যশোর বিসিকের প্রতিষ্ঠান এমইউসিইএ ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, আমরা হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করি ১৯টি দেশে এর মধ্যে এখন রফতানি হচ্ছে মাত্র পাঁচটি দেশে অন্য দেশগুলোও অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন আমাদের ব্যবসা অর্ধেকে নেমে এলেও বিসিকের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না কোনো সার্ভিস চার্জ মওকুফ করা হয়নি 

যশোর বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মোস্তফা আলী বলেন, বিসিকের সব প্রতিষ্ঠান কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অথচ বিসিক কর্তৃপক্ষ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি কোনো ধরনের চার্জ তারা মওকুফ করছে না এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা বেকায়দায় পড়েছেন

ফিনিশিং চামড়া রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এসএএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেখ মোমিন উদ্দিন বলেন, তারা ইউরোপ চীনসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করেন কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস সব শেষ করে দিয়েছে ব্যবসার যে অবস্থা, তাতে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে টিকে থাকা কষ্ট হয়ে পড়ছে

খুলনা বিভাগের মধ্যস্থল হিসেবে পরিচিত জেলাটিতে রয়েছে বিমানবন্দর, দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দর, নওয়াপাড়া নৌ-বন্দর, পাশে মোংলা সুমদ্রবন্দর ভোমরা স্থলবন্দর আছে ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা যশোর থেকে ১৮টি রুটে চলে পরিবহন এছাড়া যশোর বিমানবন্দর ব্যবহার করছে খুলনা, মাগুরা, ঝিনাইদহ কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সেই সুবাদে যশোরে পাঁচ তারকা মানের আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের আতঙ্কে যশোরের আবাসিক হোটেলগুলোয় চলছে চরম মন্দা অবস্থা পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে তিন মাসে অনেকেই হোটেল বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা

যশোর শহরে বর্তমানে পাঁচটি আবাসিক হোটেল রয়েছে এর মধ্যে চারটি ব্যবহার উপযোগী ম্যাগপাই হোটেলটি সেকেলে হওয়ায় অনেক আগেই ব্যবসা হারিয়েছে অন্য হোটেলগুলো হলো জাবের হোটেল ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ওরিয়ন, হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল হোটেল সিটিপ্লাজা কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে শুরুতেই হোঁচট খেয়েছেন জেলার হোটেল ব্যবসায়ীরা গ্রাহক না থাকলেও হোটেলগুলোর কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা আবার অনেকেই হোটেল বন্ধ করে দিয়েছেন 

জাবের হোটেল ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল ম্যানেজার রাকেশ কুনার বলেন, খুলনা বিভাগের একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল এটি ১৬ তলাবিশিষ্ট হোটেলে ৯৬টি আধুনিক রুম রয়েছে, যার ভাড়া হাজার থেকে সর্বোচ্চ হাজার টাকা নেয়া হয় খাবারের মান ভালো হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে হোটেলটি তবে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে হোটেল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি

হোটেল ওরিয়নের স্বত্বাধিকারী যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সহসভাপতি সাজ্জাদুর রহমান সুজা বলেন, সাড়ে চার বিঘা জমির ওপর পাঁচ তারকা মানের আবাসিক হোটেল গড়ে তুলেছিলাম ১৫ তলা ভবনের হোটেলটিতে রয়েছে ১২১টি রুম, যার মধ্যে ৩০টি ডাবল রুম ৩০টি কাপল রুম রয়েছে কিন্তু এখন হোটেল ব্যবসা বন্ধ করা ছাড়া উপায় দেখছি না

একই অবস্থা উৎপাদনমুখী শিল্পেরও যশোর মোটরপার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু জানান, দেশের মধ্যে মোটরপার্টসের সবচেয়ে বড় বাজার যশোর এখানে দেশের বিভিন্ন জেলার গাড়ির মালিকরা আসেন ইঞ্জিন খুচরা যন্ত্রাংশ কিনতে বছরে এখানে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে বর্তমানে ক্রেতা নেই বললেই চলে দোকানিরা ব্যাংকঋণ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন

যশোর জেলা উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তনুজা রহমান মায়া জানান, নভেল করোনাভাইরাস নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে কেবল হস্তশিল্পেই কমপক্ষে ১০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে

জেলা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে জেলার অর্থনীতি ধসে পড়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসার উপক্রম উৎপাদনমুখী শিল্পের চাকা থেমে গেছে সব মিলিয়ে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন