আগস্টের মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থছাড়ের নির্দেশনা

পরিপালনে ব্যাংকগুলোর আরো সক্রিয়তা কাম্য

চলমান কভিড-১৯ মহামারী সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে অর্থনীতির দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করছে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ওপর। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আলোচ্য প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর দিক থেকে কিছুটা শৈথিল্য দৃশ্যমান। বিশেষত তারা বৃহৎ প্রতিষ্ঠিত শিল্পের জন্য অর্থছাড়ে যতটা আগ্রহী, এসএমই শিল্পের জন্য ততটা নয়। ফলে প্যাকেজের সুবিধা বড়রা পেলেও ছোটরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে। অবস্থায় চলতি জুলাইয়ের মধ্যেই সিংহভাগ এবং আগস্টের মধ্যে উপযোগী সব পর্যায়ের উদ্যোক্তার জন্য প্যাকেজের অর্থ ছাড় দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এমন নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থনীতির বৃহত্তর কল্যাণে আলোচ্য নির্দেশনার পরিপালন নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোর আরো উদ্যোগী ভূমিকা কাম্য।  

দেশের ব্যাংকিং খাত অবশ্য ভালো অবস্থায় নেই। বহু বছরের উচ্চ অনুৎপাদনশীল ঋণ, খেলাপি ঋণের বিস্তার, নগদ অর্থের প্রবাহজনিত দুর্বলতাসহ কিছু বাস্তব সমস্যা বিরাজমান খাতে। আবার গত এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদ শতাংশ বেঁধে দেয়ায় ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় হারিয়েছে। এছাড়া আমানতে সুদহার কমায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র আমানত খরায় ভুগছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপকতর হচ্ছে তারল্য ঘাটতি। ফলে ইচ্ছা থাকলেও প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। কাজেই প্যাকেজ বাস্তবায়নের আগে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আগে সমাধান করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক শুরু থেকে অবশ্য ব্যাংকিং খাতের তারল্য বৃদ্ধিতে সঞ্চিতি প্রবিধান শিথিল, রেপো রেট কমানোসহ বিভিন্ন নীতি পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতে অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। তারল্য জোগানে আর কী কী উদ্যোগ নেয়া যায়, সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে প্যাকেজ বাস্তবায়নে কাঙ্ক্ষিত গতি আসবে না।

প্যাকেজের অর্থ ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে ছাড়ের কারণে চূড়ান্ত দায় পড়ছে ব্যাংকগুলোর ওপর। সংগত কারণেই তারা অযথা ঝুঁকি নিতে চাইছে না। সেজন্য ক্ষতিগ্রস্ত যেসব বড় ব্যবসায়ী তথা উদ্যোক্তার সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক ভালো, নিয়মিত ঋণ পরিশোধের ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে, তাদের প্রতি ব্যাংকগুলোর মনোভাব ইতিবাচক। তাদের পক্ষে প্যাকেজভুক্ত ঋণ সুবিধা পেতে সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হলো কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট মাঝারি শিল্পের তথা সিএমএসএই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মনে করছে, ছোট উদ্যোক্তারা ঠিক সময়ে ঋণ ফেরত দিতে পারবেন না। তদুপরি পরিচালনা খরচ বেশি হওয়া, দূরবর্তী এলাকায় অবস্থানসহ কিছু বাস্তব কারণে ব্যাংকগুলো এসএমই উদ্যোগের ঋণে তহবিল খরচ পোষাতে পারবে না। ফলে কুটির ক্ষুদ্র শিল্পের গ্রাহকরা আগ্রহ দেখালেও তেমন সাড়া দিচ্ছে না ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তি অনেক বেশি দুষ্কর হয়ে উঠছে। অবস্থা থেকে উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ নজরদারি বৃদ্ধি জরুরি। ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে সম্প্রতি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম (সিজিএস) চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তা অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যাংকগুলোর ঋণ ঝুঁকি কমানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে এটি। এছাড়া আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর সরকারের অতিনির্ভরতা, অব্যাহতভাবে ঋণ নিতে থাকায় ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ছে, যার প্রকাশ তারল্য সংকটের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত। সুতরাং ব্যাংকগুলোকে প্যাকেজ বাস্তবায়নে সক্ষম করে তুলতে এটিও বিবেচনায় রাখা চাই। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসএমই খাত। মার্চ-এপ্রিলের অঘোষিত লকডাউনে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে খাতে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়েছে। আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন এসএমই খাত। খাতকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সচল করা যাবে ততই অর্থনীতির পুনরুদ্ধার দ্রুততর হবে। ছোট ছোট উদ্যোগ হওয়ায় খাতের উদ্যোক্তাদের খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে না। কারো হয়তো এককালীন লাখ দুয়েক টাকা, কারো হয়তো এর চেয়ে কিছু বেশি অর্থ লাগবে। প্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। এসএমইর ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি কর্মসংস্থান দুটোর জন্যই দরকার। কাজেই বিষয়টি আমলে নিয়ে খাতে ঘোষিত সুবিধা নিশ্চিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি ব্যাংকগুলোকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে বৈকি। সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত প্রয়াসে প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হোক, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন