নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও যানবাহন চলাচল সীমিত করে আনায় বাজারে গ্রীষ্মকালীন ফলের সরবরাহ অব্যাহত রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন চাষীরা। চলতি মাসের শুরুতে সব খুলে দেয়া হলেও এখনো ফলচাষীদের সংকট কাটেনি। যানবাহন চলাচল কমে যাওয়ায় পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি চাহিদা কম থাকায় মূল্যের নিম্নমুখিতার কারণে দীর্ঘদিন পর বড় ধরনের লোকসানের কবলে পড়তে যাচ্ছেন পার্বত্যাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যক্তি ও বাণিজ্যিক খাতের উদ্যানচাষীরা।
দেশের গ্রীষ্মকালীন ফলের একটি বড় অংশের উৎপাদন হয় তিন পার্বত্য জেলায়। এছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলেও ফলের আবাদ হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লিজ নিয়ে কিংবা খামার পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব পাহাড়ে আম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন গ্রীষ্মকালীন ফল উৎপাদন করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চাহিদা কমার কারণে দ্রুত পচনশীল এসব ফলের উৎপাদনকারীরা বড় ধরনের লোকসানে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (রাঙ্গামাটি অঞ্চল) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ মৌসুমে দেশে ৪৫ প্রজাতির প্রায় ১৭ লাখ টন ফল উৎপাদন হয়। চলতি মৌসুমে উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ১৯ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৫ টন। এর অর্ধেক অর্থাৎ ১০ লাখ টন আসবে পার্বত্য তিন জেলা থেকে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বিপুল পরিমাণে এসব মৌসুমি ফল বাজারজাত করার চলতি মৌসুমে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
চট্টগ্রামে লিচুর জন্য বিখ্যাত এলাকা বাঁশখালীর কালীপুর। লিচুর মৌসুমে প্রতি বছর চট্টগ্রাম থেকে কালীপুর, সাধনপুর, পুকুরিয়াসহ বাঁশখালীর এ অঞ্চলে ফল কিনতে আসেন ব্যবসায়ীরা। এ সময় সাধারণত স্থানীয় বাজার ও ফলের বাগানগুলোয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু এ বছর লিচুর বাম্পার ফলন হলেও ব্যবসায়ীরা না আসায় দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। স্থানীয় ব্যাপারীদের উদ্যোগে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ফল বাজারজাত শুরু হলেও যানবাহনের ভাড়া আগের তুলনায় বেশি হওয়ায় আড়তে ফল পাঠিয়ে লাভ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার আদিবাসী কৃষক উশেথোয়াই মারমা। তিনি নিজস্ব পাহাড়ি জমিতে জুম চাষের পাশাপাশি উদ্যান ফসলও চাষ করছেন ১০ বছর ধরে। প্রায় এক মাস আগেই গাছ থেকে কাঁঠাল পাড়া শুরু হলেও যানবাহনের অভাব ও ব্যাপারীরা না আসায় চট্টগ্রাম ও ঢাকায় তা পাঠাতে পারছেন না তিনি। বর্তমানে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হলেও বিভিন্ন সাপ্তাহিক বাজারে ব্যাপারীদের আনাগোনা কম। এ কারণে বিগত বছরগুলোর চেয়ে অর্ধেক দামে কাঁঠাল বিক্রি করতে হচ্ছে তাকে। প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ না থাকায় গ্রীষ্মকালীন ফল উৎপাদনে এ বছর বড় অংকের লোকসানে পড়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।
এক সময় পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে চাষ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিকভাবে জুমের জমিতে উদ্যান ফসলের চাষ বাড়াচ্ছেন তিনি। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার পাশাপাশি সারা দেশে পাহাড়ি ফলের চাহিদা থাকায় প্রতি বছর ভালোই আয় করেন তিনি। তবে চলতি বছর কাঁঠাল, লিচু ও আনারসের চাষে লোকসানে পড়েছেন তিনি। দেড় মাস ধরে সাপ্তাহিক হাটে শহর থেকে ব্যাপারী না আসায় কম দামে ফলগুলো বিক্রি করতে হচ্ছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রীষ্মকালীন ফল কাঁঠাল, লিচুর অধিকাংশ ফলনই উত্তোলন শুরু হবে পুরোদমে। ব্যবসায়ীদের পার্বত্য বাজারগুলোতে আসার সুব্যবস্থা না করলে মাঠের ফল নষ্ট করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
অনুকূল আবহাওয়ার কারণে বাঁশখালীর পাহাড়ি অঞ্চলে এ বছর লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে স্থানীয় বাজারে লিচুর দাম কম থাকায় বাগান মালিকরা হতাশ। সরেজমিনে বাঁশখালীর গুনাগরি, রামদাশ হাট ও বৈলছড়ি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আকার ভেদে ১০০টি দেশী লিচু ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছরও এ লিচুর দাম ছিল ৮০-১০০ টাকা। এছাড়া বাজারে চায়না-৩ জাতের লিচু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০০-১২০ টাকায়। গত বছর উন্নত জাতের সুস্বাদু এ লিচু বিক্রি হয়েছিল ২০০-২৫০ টাকায়।
কালীপুর সবুরার দোকান এলাকার লিচু বাগানের মালিক মো. মোর্শেদের বাগানে ৪০০ লিচু গাছ রয়েছে। তিনি বলেন, এ বছর লিচুর উৎপাদন খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু দাম পাচ্ছি না। গত বছর ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাগানে এসে ফল পাকার আগেই পুরো বাগান কিনে নিয়েছিলেন। এ বছর তারা আসেননি। বাজারে নিজে বিক্রি করতে গিয়েও দাম পাচ্ছি না।
স্থানীয় গুনাগরি বাজারের ফল ব্যবসায়ী আবুল মনছুর জানালেন, করোনার ভয়ে শহরের ব্যবসায়ীরা এ বছর বাঁশখালীতে আসতে পারেননি। স্থানীয় ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কিছু ফল কিনে ব্যবসা চালাচ্ছি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে লোকজন বাড়িতে আটকে থাকায় বেচাবিক্রি কম।
চট্টগ্রামের বিআরটিসি পাইকারি ফলমন্ডি বাজারে দেখা গেছে, আম বিক্রির আড়তগুলোয় মানভেদে কেজিপ্রতি হিমসাগর ৪০-৪৫ টাকা, ল্যাংড়া ৩৫-৪০ ও লক্ষণভোগ ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমের এ সময় অন্যান্য বছর আমের দাম থাকে ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে বাজারে সবচেয়ে ভালো মানের হিমসাগর বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৫ টাকার নিচে। ২৫ টাকায়ও আম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
পাইকারি ফল ব্যবসায়ী মেসার্স মোহছেন আউলিয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জমির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশীয় ফলের ভর মৌসুম এখন। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল থেকে ঈদের পর থেকে মৌসুমের পাকা আম ও লিচু আসা শুরু হয়েছে বাজারে। কিন্তু বেচাকেনার অবস্থা খুবই খারাপ। বাজারে পাইকার ও ছোট ব্যবসায়ীরা আসছেন কম। ফলে আম ও লিচুর দাম একদম কম।
চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক খান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশী ফলের মৌসুমে আড়তে পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীতে ভরপুর থাকে ফলমন্ডি। কিন্তু এ বছর ফল এলেও নগরী ও বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ব্যবসায়ীরা বাজারে আসছেন না। ফলে আগের যেকোনো বছরের চেয়ে অনেক কম দামে আম ও লিচু বেচাকেনা হচ্ছে। নগরীর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এসে কয়েক টুকরি করে ফল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মানুষ ঘর থেকে কম বের হওয়ায় তারাও বেশি দাম পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বাগান মালিকরা, যারা এ মৌসুমটির জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (রাঙ্গামাটি) অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) কাজী শফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, উদ্যানচাষীরা এ বছর বড় ধরনের সংকটে রয়েছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের উৎপাদিত ফল বাজারজাত, পরিবহন ও বিক্রির বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ফলের চাহিদা তুলনামূলক কম। ফলে বিগত বছরগুলোর তুলনায় কৃষক ও বাণিজ্যিক চাষীদের এ বছর লোকসানে পড়ার আশঙ্কা বেশি।
