করোনায় মৃত্যুহারে সবাইকে ছাড়িয়ে যুক্তরাজ্য

বণিক বার্তা ডেস্ক

বছরের শুরু থেকে নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল চীন। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই চীন ছাড়িয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে করোনা মহামারী। শুরুর দিকে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর পরও ইউরোপীয় এসব দেশে মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব হয়নি। তবে ওই সময় মহামারীকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি যুক্তরাজ্যের নীতিনির্ধারকরা। তবে মহামারীর ছোবল এড়াতে পারেনি দেশটি। যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে আড়াই লাখের বেশি মানুষ। আর কভিড-১৯ রোগে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ৬০ হাজার ছুঁই ছুঁই। তবে প্রতি মিলিয়ন বা ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যায় রেকর্ড ছুঁয়েছে যুক্তরাজ্য। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তুলনামূলক ভালো বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা থাকার পরও যথাসময়ে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার অভাবে যুক্তরাজ্য করোনায় মৃত্যুহারে অন্যান্য দেশকে ছাড়িয়ে গেছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে ১৯টি দেশের করোনাসংক্রান্ত সরকারি তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহারে যুক্তরাজ্য এখন পর্যন্ত বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। মূলত গত মার্চের শেষ নাগাদ যুক্তরাজ্য করোনার বিরুদ্ধে জোর লড়াই শুরু করে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিংবা এর উপসর্গ নিয়ে ৫৯ হাজার ৫৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে করোনায় মৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে ৮৯১ জনে। ইউরোপের অন্যান্য দেশ এমনকি চীন, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার করোনা আক্রান্ত দেশগুলোর তুলনায় হার অনেক বেশি। 

যদিও নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের পরে যুক্তরাজ্যের অবস্থান। তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মিলিয়ন মানুষের বিপরীতে করোনায় মৃত্যুর হার ২০০ জনের সামান্য বেশি। যদিও দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এরই মধ্যে লাখ ছাড়িয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত মৃত্যুর হিসাবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম জার্মানি। তবে কোনো দেশই প্রতি মিলিয়নের বিপরীতে মৃত্যুহারে যুক্তরাজ্যের ধারেকাছে নেই। ইউরোপের এসব দেশে প্রতি মিলিয়ন জনসংখ্যার বিপরীতে মৃত্যুহার ৪০০-৮০০-এর মধ্যে। যুক্তরাজ্যে করোনায় মৃত্যুহার দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, চিলি, পেরুর চেয়েও অনেক বেশি।

যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় মৃত্যুহারের চিত্র খুবই ভয়াবহ। কেননা, আক্রান্তের সংখ্যায় যুক্তরাজ্যের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল রাশিয়া এগিয়ে রয়েছে। মৃতের সংখ্যায় সবার ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এসব দেশের মোট জনসংখ্যা যুক্তরাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি। কারণে প্রতি মিলিয়নে মৃত্যুহার কম। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে জনসংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও মৃত্যুর মিছিল বেশ দীর্ঘ। 

বিষয়ে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড স্পেইগেহাল্টার বলেন, কম জনসংখ্যার বিপরীতে যুক্তরাজ্যে করোনায় মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। এটা ঘটেছে করোনা মহামারীতে সঠিক সময়ে কার্যকর নীতি গ্রহণের অভাব তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যর্থতার কারণে। 

মূলত শুরুর দিকে করোনভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে জনগণকে সঠিকভাবে বোঝাতে পিছিয়ে ছিল যুক্তরাজ্য সরকার। নরওয়ে, ফ্রান্সের মতো ইউরোপের অন্যান্য দেশ যখন লকডাউন দিয়ে মানুষকে ঘরবন্দি করে ফেলেছিল, তখনো যুক্তরাজ্য সরকার মহামারীকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর নীতিনির্ধারকদের টনক নড়ে। জনসন সুস্থ হয়ে ফিরলে করোনা মোকাবেলায় কঠোর হয় দেশটি। তবে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে মত জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকদের।

লেবার পার্টির ছায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী জোনাথন অ্যাশওয়ার্থ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে বয়স্ক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশি মারা গেছে। তবে যুক্তরাজ্যে তরুণদের মধ্যে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। এটাও আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। আমরা সংক্রমণের সময় তরুণদের ঘরে আটকে রাখতে পারিনি। এটা আমাদের নীতিগত ব্যর্থতা। ব্যর্থতা মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ করেছে। যুক্তরাজ্যের ভালো বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

এদিকে ২৬ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের তালিকা সংশোধন করেছে যুক্তরাজ্যের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস (ওএনএস) ফলে এক ধাক্কায় দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ওই দিন পর্যন্ত দেশটির সরকারি হিসাবে করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার ৯৯৬। তালিকা সংশোধনের পর তা ৪৬ হাজারে উন্নীত হয়েছে। ওএনএস যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তিদের মৃত্যুসনদ দেয়ার কাজে নিয়োজিত।

যুক্তরাজ্যে হঠাৎ করে করোনাভাইরাসে মৃত্যের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে ওয়েলস, নর্দান আয়ারল্যান্ড স্কটল্যান্ড। দেশটির সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৫ থেকে ২০ মের মধ্যে এসব জায়গায় করোনায় মৃতের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল তাতে কিছুটা সংশোধন এনেছে ওএনএস। কারণে যুক্তরাজ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা এক ধাক্কায় বেড়েছে।

মৃতের তালিকায় সংশোধনের পর যুক্তরাজ্য করোনায় মৃতের সংখ্যায় বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। লাখ ৪৬৭ মৃত্যু নিয়ে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে লাখ ৬৮ হাজার ৬২০। আক্রান্তের হিসাবে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল রাশিয়ার পর চতুর্থ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন