প্রকৃতিকে সম্মান দেখালে রোখা যাবে মহামারী

থমাস ই. লাভজয়

দুনিয়ার আর সবার মতো কভিড-১৯ থেকে বাঁচতে আমিও এক জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। এটা আমার জীবনে দেখা প্রথম কোনো মহামারী নয়। আমি এর আগে ভ্যাকসিন-পূর্ব পোলিও মহামারীর অভিজ্ঞতাও লাভ করেছি, যখন বাবা-মায়েরা ভয়ংকর রোগের নাম শিশুদের সামনে সরাসরি উচ্চারণ না করে বানান করে বলত, তারা ভাবত বাচ্চারা হয়তো এতে ভয় পাবে না। এই বাবা-মায়েদের অনেকেই আবার ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছিলেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ভয়ে ভয়ে এশিয়া, আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্যে আঘাত করা ইবোলা, সার্স মার্সের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও লাভ করেছি।

একমাত্র পোলিও ছাড়া বাকি সব রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। এসব রোগের বেশির ভাগ বাহক প্রাকৃতিক চক্রের অংশ ছিল, যা কেবল প্রাণীদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে কারণ, প্রকৃতি কোনো না কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছিল। এখানে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।

নতুন নতুন রোগের এমন উত্থানে আমাদের অবাক হওয়া উচিত নয়। যদি মানুষ প্রকৃতি ধ্বংস অব্যাহত রাখে তবে মহামারীর আশঙ্কা রয়েই যাবে।

ইয়েলো ফিভারের ঘটনা

ইয়েলো ফিভার বা হলুদ জ্বর এটি একটি ধ্রুপদি উদাহরণ। কিন্তু সম্ভবত সময়ে কমই পরিচিত। ব্রাজিলসহ অনেক আমেরিকান দেশ এর হুমকিতে পড়েছিল, যেখানে আমি আমার ক্যারিয়ারে জীববিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছি। আফ্রিকার জঙ্গলে অনেক আগে হলুদ জ্বর বিকাশ লাভ করে। পরে সতেরো শতকে ক্রীতদাসবাহী জাহাজে করে এটি আমেরিকায় আসে। সেখানে আফ্রিকার মতোই ঘনবসতিপূর্ণ একটি নাগরচক্র শুরু হয়েছিল। যেখানে রোগ ছড়িয়ে পড়ে মশার মাধ্যমে, যা কিনা আমাদের সঙ্গে বাস করার জন্য মানিয়ে নিয়েছে। সম্ভবত এই মশাও জাহাজের মাধ্যমে আফ্রিকা থেকে এসেছিল। তবে বিশ শতকের শুরুর দিকে মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থান ধ্বংস করে এই রোগকে নির্মূল করা গিয়েছিল। ১৯৩৭ সাল থেকে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে এটিকে পুরোপুরি তাড়ানো সম্ভব হয়। ব্রাজিলে হলুদ জ্বরের সর্বশেষ প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল ১৯৪২ সালে যদিও রোগ একেবারে হারিয়ে যায়নি। আফ্রিকার মতো এটি দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলেও স্থান করে নিয়েছে। সেখানেও ভাইরাসটি প্রাণীদের ওপর আক্রমণ করে। এমনকি ব্রাজিলে ভ্যাকসিনেশন শুরু হওয়ার পরও প্রতিবার বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসার সময় কোনো ব্যক্তি জঙ্গল ইয়েলো ফিভারে আক্রান্ত হতো। অনেক দিন ধরে এটা রহস্যময় হতবুদ্ধিকর ছিল যে কীভাবে মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে।

তবে পরে রহস্য উন্মোচিত হয়। কলম্বিয়ান গবেষক জর্জ বোশেল দেখেন, একজন কাঠুরে কলম্বিয়ার জঙ্গলে একটি গাছ কেটে নামিয়ে আনার পর তার আশপাশে প্রচুর মশা। যে মশাগুলো কিনা হলুদ জ্বরের জন্য দায়ী। এই মশাগুলো সাধারণত বানরকে কামড়ায়। কিন্তু নিচে আসার পর এসব মশা মানুষকে কামড়ানোর সুযোগ পেল, কারণ মানুষ তাদের আবাস ধ্বংস করেছে। ঘটনাই বলছে বারবার প্রকৃতিকে বিরক্ত করার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছি।

কেবল হলুদ জ্বরই নয়, আমাজনের বনাঞ্চল ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আমরা ম্যালেরিয়া স্কিসস্টোসোমিয়াসিসের মতো রোগ সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছি। অবশ্য এটি কেবল ব্রাজিলের সমস্যা নয়। কভিড-১৯ দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী রোগজীবাণু ছড়িয়ে দিতে পারে।

প্রকৃতিকে অসম্মান বিপজ্জনক

এপিডেমিওলজিস্ট ভাইরোলজিস্টদের জন্য কভিড-১৯ কোনো বিস্ময়কর কিছু না। এটি সার্স ভাইরাসের আত্মীয়। এটি বাদুড় থেকেই বিকশিত হয়েছে। পরে যা প্রাণী থেকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত চীনের উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার থেকে ভাইরাসটি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যে ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে চীনে বন্য প্রাণী ক্রয়-বিক্রয়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় (সম্প্রতি উহানে বন্যপ্রাণী খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে) তবে নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী করা হবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। অবশ্য কভিড-১৯-এর কারণে প্রতিটি মৃত্যুই যেন জোর দিচ্ছে চীন, দক্ষিণ এশিয়া আফ্রিকায় বন্যপ্রাণী খাওয়া নিষিদ্ধ করার ওপর। যেহেতু বন্যপ্রাণীর মাংসের বিকল্প মানুষের রয়েছে, তাই আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বাস্থ্যের বিষয়টি সবার ওপরে স্থান দিতে হবে। তাই বন্যপ্রাণী পাচার বন্ধ করে তাদের আবাস রক্ষা করতে হবে।

প্রকৃতি আমাদের রক্ষা করে। এই মহামারী থেকে প্রকৃতির শিক্ষা হচ্ছে একে ভয় পাওয়া যাবে না, বরং প্রকৃতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। এখান থেকে কীভাবে সুবিধা নেয়া যায় তা বুঝতে হবে।

সমস্ত জীববৈচিত্র্য সমাধানের বিশাল এক লাইব্রেরি, যা কিনা প্রাকৃতিক নির্বাচন বিবর্তনের বিভিন্ন জৈবিক চ্যালেঞ্জের কাছে প্রমাণিত। যেমন বাদুড়ের আইডিসিঙ্ক্রেটিক বায়োলজি বলছে, তারা কোনো না কোনোভাবে করোনাভাইরাস থেকে ইমিউন। যা কিনা মানুষের চিকিৎসার জন্য কাজে আসত। আমাদের নিজেদের লাইব্রেরিগুলোর ওপর আমাদের শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। এখন প্রকৃতির যে লাইব্রেরি তার ওপরও আমাদের একই রকম শ্রদ্ধা যত্ন থাকতে হবে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন