আজিমপুরে বাবার কবরেই চিরনিদ্রায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

বণিক বার্তা অনলাইন

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা যান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই অধ্যাপক। পরে তার শরীরের নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তার দাফন সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয় বলে গতকাল রাতেই জানান ড. আনিসুজ্জামানের পুত্র আনন্দ জামান।

আজ সকালে সিএমএইচ থেকে কাফন পরানো থেকে সব রীতি সম্পন্ন করে মারকাজুল দল। পরে তাকে নিয়ে আসা হয় আজিমপুর কবরস্থানে। সেখানে সাড়ে ১০টার দিকে তার জানাজা পড়ানো হয়। জানাজা পড়ান মাওলানা ফরিদউদ্দিন আহমেদ।

এসময় ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। গার্ড অব অনার দেন জেলা প্রশাসনের পক্ষে ধানমন্ডি রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রবিউল আলম । সেখানে  ঢাকা দক্ষিণ সিটির সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক আব্দুর রহমান, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বাবর আলী মীর উপস্থিত ছিলেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানে বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ২৭ এপ্রিল বরেণ্য এ শিক্ষাবিদকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তার হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, উচ্চরক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতা ছিল। এর আগেও গত মাসের প্রথম সপ্তাহে একবার তিনি আরেকটি হাসপাতালে ভর্তি হন। গত শনিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তিনি মারা যান।

 ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ সমাজের বিশিষ্টজনরা শোক প্রকাশ করেছেন।

কলকাতায় জন্ম আনিসুজ্জামানের, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭। পিতার নাম এটিএম মোয়াজ্জেম। তিনি ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিণী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই। বাবা ছিলেন ডাক্তার, মা গৃহিণী, লেখালেখিতেও উৎসাহ। শৈশবের দিনগুলো কেমন কাটত শহর কলকাতায়, নানা সাক্ষাত্কার নানা লেখায় অনেকবার বলেছেন আনিসুজ্জামান। কেবল গল্প নয়, সাক্ষাৎ ইতিহাসের উপাদান সে সব কাহিনী। ১৯৪৬-এর দাঙ্গা তিনি দেখেছিলেন চোখের সামনে। বাবা প্রথমে মানতে চাননি কলকাতা থেকে বাস ওঠানোর প্রস্তাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভবিতব্য মানতেই হলো। বাবা-মা চলে এলেন পূর্ব বাংলায়, কিন্তু কাকারা থেকে গেলেন পশ্চিম বাংলায়। বাবার সঙ্গে প্রথমে এলেন খুলনায়, কলকাতার কাছাকাছি, যদি পরিস্থিতি পাল্টায় সেই আশায়। তারপর আস্তে আস্তে ঢাকা। কলকাতার পার্ক সার্কাস স্কুলে সপ্তম শ্রেণী, খুলনা জেলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণী, তারপর ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে। তিনি সেই স্কুলের শেষ ব্যাচ। তার পরই স্কুলটি সরকারি হয়ে যায়, নাম পাল্টে হয় নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সে সময় বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও শিক্ষক ছিলেন মুনীর চৌধুরী। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলা একাডেমির গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারায় ১৭৫৭-১৯১৮ বিষয়ে পিএইচডি শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল বিষয়ে পোস্টডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালের জুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন এবং পরবর্তী সময়ে ভারত গমন করে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডাক পেলেন নবজাত দেশের সংবিধান তৈরির কাজে। সংবিধানের ইংরেজি খসড়া করবেন ড. কামাল হোসেন, বাংলায় অনুবাদ করেন ড. আনিসুজ্জামান। ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন। ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়া তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করে। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে। তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দ পুরস্কার’, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন