মাটি কেটে নিচ্ছে ইটভাটা

দোফসলি থেকে বন্ধ্যায় চট্টগ্রামের ধইল্ল্যা বিল

ওমর ফারুক চট্টগ্রাম ব্যুরো

এক সময় দুই ফসল ফলত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ধইল্ল্যা বিলে। বিলটির ৭০০ হেক্টর জমির উৎপাদিত ধানে আশপাশের সাত ইউনিয়নের বাসিন্দাদের চালের চাহিদা মিটতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ওই বিলে গড়ে ওঠা ইটভাটার আগ্রাসী ভূমিকায় বর্তমানে বিলটির প্রায় অর্ধেক জমিই বন্ধ্যায় পরিণত হয়েছে। এখনই ইটভাটার বিস্তার থামানো না গেলে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহৎ এ বিল পুরোটাই আবাদের অযোগ্য হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতকানিয়া উপজেলায় বর্তমানে বৈধ-অবৈধ মোট ৬৪ ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টির বেশি গড়ে উঠেছে ধইল্ল্যা বিলে। এসব ইটভাটার বেশির ভাগেরই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেই। কোনোটার অনুমোদন থাকলেও পরিবেশ ছাড়পত্রের হালনাগাদ নেই। আইন অমান্য করে প্রতিটি ইটভাটা বিলটির পাশের কিংবা দূরের জমি থেকে মাটি খনন করে ইট তৈরি করছে।

পরিবেশবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ইট তৈরির জন্য জমির টপ সয়েল আহরণ সম্পূর্ণ বেআইনি। এতে কৃষক বা জমির মালিক মাটি বিক্রি করে সাময়িকভাবে লাভবান হলেও সুদূরপ্রসারী কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। কোনো জমি থেকে ১০০ থেকে ১২০ ফুট পর্যন্ত মাটি উত্তোলন করলে ওই জমিতে কোনো ফসল উৎপাদন সম্ভব না। কিন্তু দিনে-রাতে সাতকানিয়ার ইটভাটাগুলো পার্শ্ববর্তী জমি থেকে টপ সয়েল নিয়ে যাচ্ছে। সাতকানিয়া উপজেলায় ইটভাটাকে ঘিরে মাটি-সন্ত্রাস চলছে। ইটভাটাগুলো যেভাবে জমি থেকে টপ সয়েল তুলে নিয়ে যাচ্ছে অচিরেই পুরো সাতকানিয়া উর্বর জমিহীন হয়ে পড়বে।

গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার মৌলভীর দোকান থেকে কেরানীহাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। সড়কের পশ্চিম পাশে সারি সারি ইটভাটার চুলা থেকে ধোঁয়া আকাশে উড়ছে। মহাসড়কের পূর্ব পাশের জমিতে আমন ধান কাটার পর সরিষা, আলু, ফুলকপিসহ নানা ধরনের রবিশস্যের চাষ হয়েছে। কিন্তু সড়কের পশ্চিম পাশে, যেখানে ইটভাটা গড়ে উঠেছে, পুরো বিল ডোবা বা জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকায় বিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা যাচ্ছে না।

স্থানীয় লোকজন ও ইটভাটা মালিকদের তথ্যমতে, বছরের পর বছর বিলের জমি থেকে মাটি নিয়ে যাচ্ছেন ইটভাটা মালিকরা। এতে একসময়ের দোফসলি জমি এখন অনাবাদি জলাশয়ে পরিণত হয়েছে।

সাতকানিয়ার কেউচিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা এসএম রানা বলেন, প্রতিটি ইটভাটা বিল থেকে জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নিয়ে ইট তৈরি করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমির মালিক সাময়িকভাবে আর্থিক লাভবান হতে মাটি বিক্রি করছেন। আবার কোনো কোনো জমির মালিক ইটভাটাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী বাহিনীর চাপে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

তার ভাষ্য, এখানে রাতের আঁধারে মাটি কেটে নিয়ে যায় ইটভাটার মালিকের লোকজন কিংবা ইটভাটাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী গ্রুপ। এসব ইটভাটা মালিক ও সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন এমনকি ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের সঙ্গেও ভালো যোগাযোগ রয়েছে। যে কারণে বছরের পর বছর এভাবে উর্বর জমির মাটি কেটে নিয়ে ইট তৈরি করছেন ইটভাটা মালিকরা।

জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, ‘আসলেই পুরো উপজেলা বিশেষ করে মহাসড়কের (কেরানীহাট-মৌলভীর দোকান) পাশে ইটভাটার অবস্থা খুবই ভয়াবহ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইটভাটাগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। তাছাড়া অনেকগুলো ইটভাটায় হাইকোর্টের রিট রয়েছে। যে কারণে চাইলেও সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায় না। তার পরও যখনই কোনো এলাকায় ফসলি জমির মাটি উত্তোলনের খবর পাই, সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিই। সর্বশেষ গত সপ্তাহেও ধইল্ল্যা বিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাম্পার ও এক্সক্যাভেটর আটক করেছি।

স্থানীয়রা জানান, একটি ইটভাটা গড়ে ওঠার পর আশপাশের জমি থেকে চড়া দামে মাটি কিনে নেন ইটভাটা মালিক। কয়েক বছরের মধ্যে ওই জমিগুলো থেকে ১০০-১২০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নেয়ার পর পাশের জমিগুলোতে ফসল ফলানোর সময় আর পানি থাকে না। ফলে পাশের জমির মালিকরাও বাধ্য হন ইটভাটা মালিককে তার জমির মাটি বিক্রি করে দিতে। এভাবে একরের পর একর জমি নিজের কবজায় নিয়ে মাটি উত্তোলন করেন ইটভাটা মালিকরা।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় অঞ্চলের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ইটভাটার কারণে সাতকানিয়াসহ চট্টগ্রামের তিন উপজেলার অবস্থা খুবই মারাত্মক। অনুমোদনহীন ইটভাটাগুলোতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আইনি ব্যবস্থা নিই। জমি থেকে টপ সয়েল নিয়ে মাটি তৈরির সঙ্গে 

ইটভাটার মালিক, জমির মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ অনেকেই সংশ্লিষ্ট। ফলে ইচ্ছে থাকার পরও জনপ্রতিনিধিদের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হয় না।

ফসলি জমি থেকে মাটি উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতকানিয়া ব্রিকফিল্ড মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল আলম বলেন, এলাকার জমিগুলো অনুর্বর ছিল। আমরা প্রথম দিকে অনুর্বর মাটি থেকে মাটি উত্তোলন করি। পরবর্তী সময়ে আশপাশের জমির মালিকরাও মাটি বিক্রি করতে ইটভাটার মালিকদের কাছে আসেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন