ভোক্তা অধিকার আইনে প্রশিক্ষণ পেলেন শিক্ষার্থীরা

ফিচার প্রতিবেদক

শীতের সকাল। তার ওপর শুক্রবার ছুটির দিন। একটু দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে কাটানো বা আসল্যে পার করার চিত্র দেখা যায় ক্যাম্পাসগুলোয়। কিন্তু গত ২০ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চিত্র ছিল আলাদা। সকাল ৯টার আগেই শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার অডিটোরিয়ামের সামনে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। লাইন ধরে নাম লিখিয়ে অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করেন ৫০০ শিক্ষার্থী

ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনসাস কনজিউমার্স সোসাইটি (সিসিএস) এবং এর যুব শাখা কনজিউমার ইয়ুথ বাংলাদেশের (সিওয়াইবি) উদ্যোগে শুক্রবার আয়োজন করা হয়েছিলকনজিউমার রাইটস অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনফারেন্সশীর্ষক প্রশিক্ষণমূলক অনুষ্ঠান। সিওয়াইবির অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে ছিল রাবি শাখা। আয়োজকদের সফল প্রচেষ্টায় সকাল ১০টা না বাজতেই কনফারেন্স রূপ নেয় মিলনমেলায়। রাবি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকার ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তরুণ-তরুণীরা এখানে হাজির হন।

কনফারেন্সে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন ন্যাশনাল ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফোরামের সভাপতি কেএম হাসান রিপন, বিডি জবস ডটকমের সিনিয়র ম্যানেজার মোহাম্মাদ আলী ফিরোজ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রাজশাহী জেলার সহকারী পরিচালক হাসান আল মারুফ, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের অ্যালামনাই রাফসানুল হক হূদয় এবং লেখক গবেষক ইমরান মাহফুজ।

সিওয়াইবির রাবি শাখার সভাপতি কাজী জহিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে কনফারেন্সে বক্তব্য দেন সিসিএসের প্রতিষ্ঠাতা সিওয়াইবির সভাপতি পলাশ মাহমুদ, রাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, আরেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া, প্রক্টর অধ্যাপক লুত্ফর রহমান, সিওয়াইবির রাবি শাখার উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধু হলের প্রাধ্যক্ষ রওশন জাহিদ, সিওয়াইবির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সোহরাওয়ার্দী শুভ, কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ইমরান শুভ্র প্রমুখ।


প্রশিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ভোক্তা অধিকার আইনের ওপর বিস্তারিত ধারণা দেন। এছাড়া বিদেশে উচ্চাশিক্ষা বৃত্তি লাভের নিয়মকানুন, চাকরির আবেদন সিভি লেখার পদ্ধতি, চাকরির মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি করপোরেট লিডারশিপ, সৃজনশীল লেখালেখি ক্যারিয়ার প্লান নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে সনদ বিতরণ করেন দুই উপ-উপাচার্য।

অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি), পাবনা বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পাবিপ্রবি), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী নিউ গভ. কলেজ, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ, জয়পুরহাট সরকারি কলেজ, গোদাগাড়ী ডিগ্রি কলেজ নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।

প্রসঙ্গত, সরকার নিবন্ধিত ভোক্তা অধিকার সংস্থা সিসিএস সিওয়াইবি দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বশেমুরবিপ্রবি, হাবিপ্রবি, যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গণবিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিএল কলেজ, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ, বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ ভোক্তা অধিকার বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

কনফারেন্সের সহযোগিতায় ছিল অনলাইন শপিংমল -ভ্যালি, ফুড পার্টনার প্রাণ অলটাইম এবং মিডিয়া পার্টনার দৈনিক বণিক বার্তা।

 

নিরাপদ খাদ্যের দেশ গড়ে তোলা সম্ভব


আনন্দ কুমার সাহা

উপ-উপাচার্য

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রমজান মাসে আমরা ঢাকায় দেখতে পাই বিভিন্ন হোটেলে মরা মুরগি খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয়। পোড়া মবিল, বিভিন্ন ক্ষতিকর রঙ খাদ্যে ব্যবহারের ফলে আমরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছি। ফরমালিনের ব্যবহার আমাদেরকে আরো ভাবিয়ে তুলছে। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ এবং আমাদের তরুণ সমাজ যদি সচেতন হয়ে এগিয়ে আসে, তবে অবশ্যই ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্যের দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের তরুণ সমাজ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান করেছে, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, ’৯০-এর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করেছে। বাংলাদেশের যদি পরিবর্তন করতে হয়, তবে এই যুবসমাজই পারবে।

আগে মানুষ বাসে, ট্রেনে ধূমপান করত। আইন প্রণয়নের পর বর্তমানে পাবলিক প্লেসে কেউ ধূমপান করে না। সরকার ভোক্তা অধিকার আইন নিরাপদ খাদ্য আইন পাস করেছে। কেউ খাদ্যে ভেজাল দিলে আমরা যেমন প্রতিবাদ করব, তেমনই আমাদেরকে অন্যদের সচেতন করার দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা যদি তা করতে পারি, তবেই নিরাপদ খাদ্যের দেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

 

দক্ষতাও অর্জন করতে হবে


কেএম হাসান রিপন

নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট

সাধারণত চাকরিপ্রার্থী মনে করেন তিনি খারাপ অবস্থায় আছেন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা যারা নেন, তারা বেশি সমস্যায় থাকেন। যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা তাদেরও দায়িত্ব। সেটি করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। যা- হোক না কেন, তাকে যোগ্য লোক খুঁজে বের করতেই হবে। এক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থী ভুল করে বসেন। তিনি নিজেকে দুর্বলভাবে উপস্থাপন করেন। মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে তরুণদের কোনোভাবেই দুর্বলতার পরিচয় দেয়া যাবে না। কারো করুণা বা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য লবিং-তদবির না করে নিজেকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করার অনুশীলন করতে হবে।

একজন শিক্ষিত তরুণ চাইলেই যেকোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। চেষ্টা আর অধ্যবসায় থাকলে চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় না। মূল কথা হচ্ছে দক্ষতা। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোটখাটো দক্ষতা অর্জন করতে হবে। চাকরিদাতা যেন বুঝতে পারেন, ছেলেটি বা মেয়েটি স্মার্ট। তাকে কোনো কাজ দিলে সে করতে পারবে। তাহলে সেই তরুণ-তরুণীকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।

 

উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করতে হবে


পলাশ মাহমুদ

নির্বাহী পরিচালক, সিসিএস

কেন্দ্রীয় সভাপতি, সিওয়াইবি

দেশে খাদ্যে ভেজালের কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। ভেজালের মহামারী দিন দিন বাড়ছে। আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠার ঘাটতির কারণে নৈরাজ্য চলছে। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার আকাঙ্ক্ষা লোভ জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা থেকে উত্তরণে শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। ভোক্তা হিসেবে প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজে সচেতন হতে হবে, অন্যকেও সচেতন করতে হবে। খাদ্যে ভেজাল সামাজিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সিসিএস সিওয়াইবি তরুণদের সচেতন করতে কাজ করছে। আজকের অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী বিষয়টি জানলেন-বুঝলেন। এখন আপনাদের দায়িত্ব নিজের পরিবার, আত্মীয় প্রতিবেশীদের সচেতন করা। এভাবে আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করা যাবে।

সিসিএসের সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তরুণদের যোগ্য দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। বর্তমানে চাকরিদাতারা বেশি বেতনে চাকরি দিতে চান। কিন্তু তারা দক্ষ বা উপযুক্ত প্রার্থী পান না। এখানে একটি বিরাট সংকট। আমরা সার্টিফিকেট অর্জন করেই চিন্তা করি আমার একটি চাকরি পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু চাকরিদাতা সার্টিফিকেট নয়, দক্ষতা দেখেন। এজন্য পড়ালেখার পাশাপাশি নানা বিষয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। এছাড়া সবাই শুধু চাকরির চিন্তা না করে উদ্যোক্তা হওয়ারও চেষ্টা করতে হবে। উদ্যোক্তা না হলে চাকরি দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে না। প্রথমে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা, ব্যর্থ হলে চাকরির চিন্তা করতে হবে।

 

অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে


হাসান আল মারুফ

সহকারী পরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকার সব ভোক্তার জন্য আট ধরনের অধিকারের কথা বলেছে। অধিকারগুলো হলো মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্যসেবা পাওয়ার অধিকার, তথ্যের অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা শিক্ষা লাভের অধিকার এবং সুস্থ পরিবেশের অধিকার। কিন্তু আমরা অধিকারগুলো না জানায় প্রতিদিন প্রতারণার শিকার হচ্ছি। ২০০৯ সালে দেশে ভোক্তা অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটি এক কথায় অনন্য। কারণ যেকোনো আইনে মামলা করতে কোর্ট ফি, আইনজীবীর প্রয়োজন হয়। কিন্তু আইনে নিজেই অভিযোগ করা যায়। অভিযোগের পর শুনানি হয়, অভিযোগ আমলযোগ্য তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীকে মোট জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ প্রণোদনা দেয়া হয়ে থাকে।

প্রতিনিয়ত ওজনে কম দেয়া, দাঁড়িপাল্লায় কারসাজি, মহিষের মাংসকে গরুর মাংস হিসেবে বিক্রি করা, নকল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা।

পণ্য ক্রয়ের সময় পণ্যের মোড়কে উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ আছে কিনা, তা খেয়াল করতে হবে। বিদেশী পণ্য ক্রয়ের সময় আমদানিকারকের সিল এবং বাংলাদেশের মুদ্রায় পণ্যের মূল্য আছে কিনা, তা লক্ষ করতে হবে। যদি না থাকে, তবে দোকান থেকে পণ্য ক্রয়ের ভাউচার সংগ্রহ করতে হবে। দোকানি যদি ভাউচার দিতে অপারগ হয়, তবে মোবাইলে ছবি বা ভিডিও ধারণ করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত অভিযোগ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন