ক্রিপ্টোগ্রাফির টাইমলাইন

ইবনে মোতালিব

খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০০ বছর আগে সুমেরীয়রা কিউনিফর্ম এবং মিসরীয়রা হায়ারোগ্লিফিকস লিখন আবিষ্কার করে। খ্রিস্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগে ফোনেশীয়রা বর্ণমালা আবিষ্কার করে, ৭০০ থেকে ৫০০ বছর আগে হিব্রু পণ্ডিতরা এক বর্ণের সাইফার বের করেন, ৪০০ বছর আগে স্পার্টানরা স্কাইটেল ব্যবহার করে। ওই সময় হেরোডটাস জানান, গ্রিস থেকে পারস্য পর্যন্ত স্টেগানোগ্রাফির (বর্ণের ভেতর লুকানো) ব্যবহার ছিল (ন্যাড়া মাথার ট্যাটু হিসেবেও তা উপস্থাপিত হতো)।
স্কাইটেলের কথা প্লুটার্কও (৫০-১২০ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন। চামরার আবরণে সিলিন্ডার আকৃতির দণ্ড ঢেকে তার ওপর সংকেত বার্তা লেখা হতো। একই ধরনের রডে পেঁচিয়ে বার্তা গ্রাহক একে ডিসাইফার করে পড়তেন। কিন্তু খুব সহজে বার্তা রহস্য ভেদ করা সম্ভব ছিল বলে শত্রুরা সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। খ্রিস্টের জন্মের ৪৪০ বছর আগের স্টেগানোগ্রাফ বার্তার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ বার্তা দেখতে সাধারণ, ছদ্মবেশধারী। দক্ষ গ্রাহক সঠিক বার্তাটি আহরণ করতে জানতেন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে স্বৈরাচারী গ্রিক রাজা হিস্টিয়াস তার বিশ্বস্ত এক ভৃত্যের মাথা ন্যাড়া করে তাতে বার্তাটি বসিয়ে চুল উঠে বার্তাটি ডেকে দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর তার অধীন করদরাজা অ্যারিস্টাগোরাসের কাছে পাঠিয়ে তাকে ভৃত্যের মাথা আবার ন্যাড়া করার হুকুম জারি করেন। হুকুম পালনের পর অ্যারিস্টাগোরাস মাথার খুলি থেকে বার্তাটি উদ্ধার করেন। স্টেগানোগ্রাফির বার্তা লুকানো থাকে অন্য কোনো বার্তার ভেতরে।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে উদ্ভাবিত হয় রোমান সংকেতলিখন সিজার সাইফার, যা জুলিয়াস সিজারের নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। সামরিক ও অন্যান্য দাপ্তরিক নির্দেশাবলি সিজার সাইফারে পাঠানো হতো। রোমাদের শত্রুরা অশিক্ষিত হওয়ায় প্রায় ৮০০ বছর নির্দ্বিধায় সিজার সাইফার ব্যবহূত হয়। কিন্তু নবম শতকে মুসলমান দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, চিকিত্সক আবু ইউসুফ আল-কিন্দি সহজ গাণিতিক বিশ্লেষণে সিজার সাইফার ভেদ করার রহস্য আবিষ্কার করেন এবং আ ম্যানুস্ক্রিপ্ট অন ডিসাইফারিং ক্রিপ্টোগ্রাফিক মেসেজেস নামক গ্রন্থে সাংকেতিক বার্তা উদ্ধারের প্রক্রিয়া লিপিবদ্ধ করেন। এ গ্রন্থই ক্রিপ্টোগ্রাফির অন্তর্গত রহস্য ফাঁস করে দেয় এবং পণ্ডিতরা আল-কিন্দিকে অনুসরণ করে সংকেতলিখনের রহস্য উন্মোচন করতে থাকেন। এ গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমেই ক্রিপ্টোন্যালাইসিস বিজ্ঞানের সূচনা হয়। আল-কিন্দি এ শাস্ত্রের অন্যতম জনক। তার আগে মুসলিম ভাষাবিজ্ঞানী এবং আরবি ভাষার প্রথম অভিধান প্রণেতা আল খালিল (৭১৮-৭৮৬) গুপ্ত বার্তা উন্মুক্ত করার কিছু মৌলিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। মূলত তার কাজকে সূত্র ধরেই আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩) তার স্মরণীয় গ্রন্থটি রচনা করেন।

খ্রিস্ট জন্মের পরবর্তী উদ্ভাবন
১০০-১ খ্রিস্টাব্দ: সিজার সাইফার প্রচলন
৮০১-৮৭৩: আল-কিন্দির আ ম্যানুস্ক্রিপ্ট অন ডিসাইফারিং ক্রিপ্টোগ্রাফিক মেসেজেস।
১৩৫৫-১৪১৮: ইবনে আল-দুরেহিমের (১৩১২-৬১) ক্রিপ্টোগ্রাফিক রচনাবলিসহ মিসরীয় গণিতজ্ঞ ও বিশ্বকোষ প্রণেতা শিহাব আল-দিন আল কালকাশান্দি (১৩৫৫-১৪১৮) ১৪ খণ্ডের সুবাহ আল আশা ফি সিনাত আল ইনশা (অন্ধের ভোরবেলা) গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতেই প্রথম পলিঅ্যালফাবেটিক সাইফার গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাখ্যা করেন।
১৪৬৬: ইতালির লেখক লিওন বাতিস্তা আলবার্তি পলিঅ্যালফাবেটিক সাইফার যন্ত্র আবিষ্কার করেন, এটিই প্রথম যান্ত্রিক পদক্ষেপ।
১৫১৮: জার্মান ঐতিহাসিক, ধর্মবেত্তা, ভাষাবিদ ও অভিধান লেখক ইউহানেস ট্রিথেমিয়াস ‘ক্রিপ্টোলজি’ গ্রন্থ রচনা করেন।
১৫৫৩: ইতালির ক্রিপ্টোলজিস্ট জিওভান বাতিস্তা বেলাসো ভিজেনার সাইফার আবিষ্কার করেন।
১৫৮৬: রানী প্রথম এলিজাবেথের মুখ্য সচিব স্কাই মাস্টার হিসেবে খ্যাত ক্রিপ্টোগ্রাফার স্যার ফ্রান্সিস ওয়ালসিংহাম স্কটল্যান্ডের কুইন মেরির একটি ষড়যন্ত্র (রানী প্রথম এলিজাবেথকে উত্খাত ও হত্যা) উদ্ঘাটন করে কুইন মেরিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর বন্দোবস্ত করেন। এটি মূলত ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট বৈরিতার একটি বহিঃপ্রকাশ।
১৬৪১: উইলকিন্স লিখিত মার্কারি বুক অন ক্রিপ্টোলজি প্রকাশিত।
১৭৯৫: টমাস জেফারসন জেফারসন ডিস্ক সাইবার আবিষ্কার করেন।
১৮৩৫: স্যামুয়েল মোর্স টেলিগ্রাফিক মোর্স কোড আবিষ্কার করেন।
১৮৫৪: চার্লস হুইটস্টোন প্লেফেয়ার সাইফার আবিষ্কার করেন
১৮৫৫: ক্রিমিয়া যুদ্ধের সময় চার্লস ব্যাবেজ ইংরেজদের পক্ষে ডিজেনার সাইফার ডিকোড করে দেন।
১৮৮৫: টমাস জে বিলসের বিল সাইফার প্রকাশিত।
১৮৯৪: ফ্রান্সের ড্রেফাস কলঙ্ক উন্মোচনে ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার ও অপব্যবহার প্রকাশিত হয়। জার্মানির কাছে সামরিক তথ্য পাচারের অভিযোগে ক্যাপ্টেন আলফ্রেড ড্রেফাস অভিযুক্ত হন এবং তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দ্বীপান্তর সাজা হয়। কিন্তু তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। পরবর্তী সময়ে তার ভাইয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রমাণিত হয় ড্রেফাস কিছুই জানতেন না, কিন্তু তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মেজর ফার্দিনান্দ এসথারহেজি জার্মানিকে তথ্য সরবরাহ করেছেন। কিন্তু ড্রেফাসকে ফাঁসাতে ভুয়া ক্রিপ্টোগ্রাফিক বার্তা তৈরি করা হয়। শেষ পর্যন্ত মেজর ফার্দিনান্দ পালিয়ে যান, ড্রেফাস মুক্ত হন। ততদিনে বিশ্বও বার্তা পেয়ে গেছে ক্রিপ্টোগ্রাফিক বার্তার অপব্যবহার রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।
১৯১৬-১৯২২: উইলিয়াম ফ্রিডম্যান ও এলিজাবেথ স্মিথ ফ্রিডম্যান ক্রিপ্টোন্যালাইসিসে পরিসংখ্যানের ব্যবহার শুরু করেন।
১৯১৭: আর্থার জিমারম্যানের টেলিগ্রামটি মাঝপথে রোধ করা হয়, ডিকোড করে প্রথম মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ত্বরান্বিত করা হয়।
১৯১৯: এডওয়ার্ড হেবেন প্রথম মোটর সাইফার মেশিন আবিষ্কার করেন।
১৯৩১: দ্য আমেরিকান ব্ল্যাক চেম্বার প্রকাশনার মাধ্যমে হার্বার্ট ইয়ার্ডলে আমেরিকান ক্রিপ্টোগ্রাফির অনেকাংশ ফাঁস করে দেন।
১৯৩২: জার্মান ক্রিপ্টোগ্রাফি এলিগমা পোলিশ গণিতজ্ঞ মারিয়ান রেজেভস্কি ডিকোড করে ফেলেন।
১৯৪০: জাপানের গার্পল ক্রিপ্টোগ্রাফি ফাঁস হয়ে যায়।
১৯৪১: যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রকে হতভম্ব করে দেয়। তারা জানত জাপানি ক্রিপ্টোগ্রাফি তারা ধরে ফেলেছে।
১৯৪৩: ম্যাক্স-নিউম্যান, উথাইন-উইলিয়ামস, অ্যালান টুরিং সাইফার ব্রেকিং মেশিন উদ্ভাবন করেন।
১৯৪৯: ক্লদ শ্যামনের কমিউনিকেশন থিউরি অব সিক্রেসি সিস্টেম প্রকাশিত।
১৯৫০: শুরু হয় অত্যাধুনিক কম্পিউটারনির্ভর ক্রিপ্টোগ্রাফির যাত্রা।

ইবনে মোতালিব: লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন