বেবি কর্ন চাষ আমাদের দেশে নতুন হলেও
থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, তাইওয়ান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা,
নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো
প্রভৃতি দেশ এর উৎপাদন ও বাজারজাতে জড়িত। থাইল্যান্ড বর্তমানে বিশ্বের প্রধান বেবি
কর্ন উৎপাদক দেশ এবং বিশ্ব রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। গবেষণায়
দেখা গেছে, থাইল্যান্ডে ধানের চেয়ে বেবি ভুট্টা চাষ অধিকতর লাভজনক। বিশ্বের উন্নত
দেশগুলো প্রধানত বেবি কর্নের ভোক্তা হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোই এর উৎপাদক। বাংলাদেশে
আমদানীকৃত বেবি কর্নের পুরোটাই ক্যানিং করা থাকে। এ দেশে উৎপাদিত বেবি কর্ন
খোসাবিহীন অবস্থায় পলিব্যাগে বাজারজাত করা হয়, যার প্রধান ক্রেতা চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলো।
বেবি কর্নের উপাদেয় ও সুমিষ্ট স্বাদ ভোজনরসিকদের কাছে একে সমাদৃত করেছে। বেবি
কর্নকে সবজি হিসেবে বা স্যুপ তৈরির উপাদান হিসেবে যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনি
টাটকা বেবি কর্ন সালাদ হিসেবে বা আচার তৈরিতে ব্যবহূত হয়। তাছাড়া সীমিত আকারে
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিমায়িত বেবি কর্ন প্রায়ই বিভিন্ন খাবার তৈরির উপাদান
হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশে থাইল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত
হাইব্রিড জাত প্যাসিফিক ৪২১-এর সীমিত চাষ হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) উদ্ভিদ
প্রজনন বিভাগ কয়েক বছর ধরে বেবি কর্নের উপযোগী জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ করছে।
থাইল্যান্ড থেকে আনা কিছু হাইব্রিড ও মুক্ত পরাগায়িত জাত হতে বাছাইয়ের মাধ্যমে
দুটি মুক্ত পরাগায়িত জাত (বিবিসি ০১ ও বিবিসি ০২) বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভালো বলে চিহ্নিত করা
হয়েছে। তবে কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য ছাড়করণের আগে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার
প্রয়োজন রয়েছে।
বেবি কর্নের চাষাবাদ অর্থাৎ জমি তৈরি, বীজ
বপনের সময়, আন্তঃপরিচর্যা, কীটপতঙ্গ, রোগ ও বালাই দমন সাধারণ ভুট্টা চাষের অনুরূপ। তবে জমিতে গাছের ঘনত্বের
ওপর বপন পদ্ধতি, সারের মাত্রা ও বীজের পরিমাণের তারতম্য হয়ে থাকে। এছাড়া স্বল্পমেয়াদি
বলে বছরে একই জমি থেকে কমপক্ষে তিনটি ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব। বেলে ও ভারী এঁটেল
মাটি ছাড়া অন্য সব মাটি বেবি কর্ন চাষের উপযুুুক্ত হলেও পানি নিষ্কাশনের
ব্যবস্থাযুক্ত উর্বর বেলে দোঁআশ বা দোআঁশ মাটিই উত্তম। মাটি তিন-চারটি আড়াআড়ি
চাষ ও মই দিয়ে বীজ বপনের আগে ঝুরঝুরে ও সমান করে নিতে হয়, যাতে
সেচ ও বৃষ্টির পর জমিতে পানি না দাঁড়ায়। খরিপ মৌসুমে উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি
নির্বাচন করতে হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় প্রায় সারা বছরই বেবি কর্ন চাষ করা গেলেও
রবি মৌসুমে ফলন বেশি হয়। সাধারণ ভুট্টার মতো রবি (অক্টোবর-নভেম্বর), খরিপ-১ (১৫
ফেব্রুয়ারি-১৫ মার্চ) ও খরিপ-২ (জুলাই-আগস্ট) মৌসুমে বীজ বপন করা সম্ভব। অতিবৃষ্টিতে বীজ পচে যেতে পারে ও নিম্ন
তাপমাত্রায় অঙ্কুরোদ্গমে সমস্যা হয় বিধায় এ সময় বীজ বপন না করাই উত্তম। সারি থেকে
সারির দূরত্ব ৫০-৬০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১৫-২০ সেমি অনুসরণ করা যেতে
পারে। সারিতে ২.৫-৩.০ সেমি গভীরে প্রতি গোছায় এক-দুটি বীজ বপন করতে হবে।
ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট, বরিক
অ্যাসিড যথাক্রমে ২২০-৩৫০, ১৪০-২২৫, ১০০-১৬০, ৭৫-১২০, ১০-১৪, ৫-৮ কেজি হেক্টরপ্রতি। বীজ রোগবালাইমুক্ত করার জন্য বপনের আগে শোধন করা
উচিত, যা চারা গাছকে প্রাথমিকভাবে রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। জমিতে গাছের
ঘনত্ব ও জাতভেদে হেক্টরপ্রতি ৩৫-৬০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে অঙ্কুরোদ্গম ৯০
শতাংশের কম হলে আনুপাতিক হারে বীজের পরিমাণও বাড়বে। রবি মৌসুমে মাটিতে রসের
তারতম্যভেদে এক-দুবার সেচের প্রয়োজন হতে পারে। বীজ বপনের আগে জো না থাকলে হালকা সেচ
দিয়ে জো হওয়ার পর বীজ বপন করলে অঙ্কুরোদ্গম ভালো হবে। বীজ গজানোর ২০-২৫ দিন পর
প্রথম সেচ ও ৫০-৫৫ দিন পর দ্বিতীয় সেচ প্রয়োগ করা যেতে পারে
জাতভেদে ও প্রতি হেক্টরে গাছের
সংখ্যার ওপর ফলন অনেকটা নির্ভর করলেও সুষ্ঠু পরিচর্যা ভালো ফলন পেতে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। সুষ্ঠু পরিচর্যা হলে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৮-১১ টন খোসাসহ মোচা পাওয়া
যায়। সাধারণত ১০ কেজি খোসাসহ মোচা থেকে ১.৫-১.৮ কেজি খোসাবিহীন মোচা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে বাছাইকৃত জাতগুলো হতে হেক্টরপ্রতি খোসাসহ তিন-সাত টন এবং
খোসাবিহীন অবস্থায় ০.৬-১.৮ টন পর্যন্ত মোচা পাওয়া গেছে। এছাড়া একই সঙ্গে গোখাদ্য
হিসেবে হেক্টরপ্রতি ১৫-২৫ টন সবুজ গাছ পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে বেবি কর্নের চাষকৃত জাত
থাইল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত এবং বাজারমূল্যও অনেক। সুতরাং বিভিন্ন উৎস থেকে জার্মপ্লাজম
সংগ্রহ ও মূল্যায়ন, সংকরায়ণের মাধ্যমে উপযোগী নতুন জাত সৃষ্টি এবং কৃষক পর্যায়ে তা সহজলভ্য
করতে পারলে বীজ আমদানিতে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। সম্প্রসারণের
মাধ্যমে বেবি কর্ন হতে তৈরি বিভিন্ন খাবার ও প্রস্তুতপ্রণালি সাধারণ মানুষের নজরে
আনার ও খাবার হিসেবে একে গ্রহণযোগ্যর চেষ্টা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কৃষকদের
মাঝে প্রচলিত অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেবি কর্ন চাষে অর্থনৈতিক লাভ তুলে ধরতে পারলে
তা এর জনপ্রিয়তা বাড়াতে সহায়ক হবে।
ড. মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম মতিন
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মহাপরিচালকের
দপ্তর, বারি