আজওয়াদ ফুড অ্যান্ড কনজিউমার

জালিয়াতি নথিভুক্তের পরও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

ব্যাংকিং সুবিধাসহ আমদানি প্রক্রিয়ায় নিয়মিত রাজস্ব অব্যাহতি নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে মেসার্স আজওয়াদ ফুড অ্যান্ড কনজিউমার প্রডাক্টস। আমদানিসংক্রান্ত সব এলসি (ঋণপত্র) সম্পন্ন হয় প্রিমিয়ার ব্যাংকের চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জ শাখার মাধ্যমে। সম্প্রতি জালিয়াতি উদ্ঘাটনের পরপরই প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে থাকা সব অ্যাকাউন্টের লেনদেন কার্যক্রম অপরিচালনযোগ্য (ফ্রিজ) করতে প্রিমিয়ার ব্যাংকে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট। এর পরও আর্থিক সুবিধা অব্যাহত রেখে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একের পর এক পণ্যের চালান খালাস হয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি থেকে সরবরাহ পর্যন্ত আইন ও বিধিমালা পরিপালন না করে ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ এনে আজওয়াদ ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে গত ৭ আগস্ট চিঠি দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমসের এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেট কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুবিধায় পণ্য আমদানি করে সরকারের দেয়া এটিভি (অগ্রিম কর) অব্যাহতি সুবিধা নেয়া হলেও বাস্তবে এর অপব্যবহারের অভিযোগ তোলা হয়। এছাড়া গত ৫ আগস্ট সরেজমিনে নির্ধারিত ঠিকানায় আজওয়াদ ফুডের সাইনবোর্ড ছাড়া কারখানার কোনো অস্তিত্ব না থাকার বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই তারিখে ভ্যাট কমিশনারেটের পক্ষ থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জ শাখায় চিঠি দিয়ে আজওয়াদ ফুডের হিসাব ফ্রিজ (অপরিচালনযোগ্য) করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়। চিঠিটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয় গত ৮ আগস্ট। এতে মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ধারা ২৪ মোতাবেক ব্যাংকের সার্বিক সহায়তা চাওয়া হয়।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় গত ৭ আগস্ট আজওয়াদ ফুড অ্যান্ড কনজিউমার প্রডাক্টসকে শোকজ করার পাশাপশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষকেও আমরা ব্যাংকিং হিসাব ফ্রিজ করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলাম। পরবর্তী অনুমতি ছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে কোনো আর্থিক লেনদেন ইস্যু না করার ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছে। 

তবে বণিক বার্তার অনুসন্ধানে অন্তত ১০টি চালানের তথ্য মিলেছে, যেগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুবিধা নিয়ে খালাস পেতে গত ৮ আগস্ট থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে আবেদন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে এসব চালান খালাসও নেয়া হয়েছে। আজওয়াদ ফুডের পক্ষ থেকে ইউক্রেন থেকে আমদানি হওয়া ২ লাখ ১৬ হাজার ডলার মূল্যের গুঁড়ো দুধের চালান খালাস পেতে কাস্টম হাউজে আবেদন করা হয় গত ৮ আগস্ট। পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া ১ লাখ ৩ হাজার ডলার মূল্যের ৪৮ টনের আরো একটি দুধের চালান ছাড়িয়ে নিতে আগামপত্র দাখিল করা হয় ১৯ আগস্ট।

এরপর ২১ আগস্ট চীন থেকে আমদানি হওয়া ৫৪ হাজার ডলার মূল্যের ৫৪১ টন সোডিয়াম সালফেট, ইউক্রেন থেকে আমদানি হওয়া ২ লাখ ডলার মূল্যের ১০১ টন ওজনের গুঁড়ো দুধের চালান, গুয়াতেমালা থেকে আমদানি হওয়া ৬৫ হাজার ডলার মূল্যের ১০ টনের কিশমিশের চালান, ইউক্রেন থেকে আনা ২ লাখ ১৬ হাজার ডলার মূল্যের ১০ হাজার টনের গুঁড়ো দুধের চালান, চীন থেকে আসা ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা মূল্যের ৫৩১ টন সোডা অ্যাশ লাইট এই পাঁচটি চালান খালাসে আগামপত্র দাখিল করা হয়।

পরবর্তী সময়ে আরো তিনটি চালানের মধ্যে চীন থেকে আনা ৩৫ হাজার ১০০ ডলার মূল্যের ১৩৫ টন ওজনের সোডিয়াম বাই কার্বনেট খালাস করতে ৩১ আগস্ট, চীন থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৮০ ডলার মূল্যের ৫৩৩ টনের সোডা অ্যাশ লাইট খালাসের জন্য ৩১ আগস্ট ও চীন থেকে ১ লাখ ৫৮০ ডলার মূল্যের ৫৩৪ টনের সোডা অ্যাশ লাইট খালাসের জন্য ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে আগামপত্র দাখিল করা হয়। এক্ষেত্রে ১০টি পণ্যের চালানের সবগুলোর ব্যাংকিং কার্যক্রমই সম্পন্ন হয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের খাতুনগঞ্জ শাখায়।

প্রিমিয়ার ব্যাংক চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাকারিয়া এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা ভ্যাট কমিশনারেটের পক্ষ থেকে আজওয়াদ ফুডের অনুকূলে সব হিসাব ফ্রিজ করার ব্যাপারে চিঠি পেয়েছি। আমাদের ক্লায়েন্ট হওয়ায় বিষয়টি গোপনীয়তা রক্ষার ইস্যু রয়েছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে আর কিছু বলতে রাজি হননি।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের বিগত এক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আজওয়াদ ফুড (২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন) পর্যন্ত এটিভি অব্যাহতি সুবিধা নিয়েছে প্রায় ২ কোটি ১৪ লাখ টাকার। এসব কাঁচামাল দিয়ে দুই লাখ কেজি পণ্য উৎপাদনের ঘোষণা দেয়া আছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে।

কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, আজওয়াদ ফুড সরকারি নথিতে ঠিকানা ব্যবহার করেছে ১৬০০বি/২৪৪৩, রাজাখালী রোড, বোয়ালখালী চট্টগ্রাম। নিজেকে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নথিভুক্ত করায় আমদানিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুবিধায় এটিভি সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু সম্প্রতি চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের পরিচালিত একটি তদন্তে ঠিকানা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের একটি সাইনবোর্ড ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যোগাযোগ করা হলে মেসার্স আজওয়াদ ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারি নথিতে দেখানো ঠিকানায়ই আমাদের কারখানা রয়েছে। ভ্যাট কমিশনারেট থেকে শোকজ করার পরে আমরা শুনানিতে অংশগ্রহণ করেছি। নথি জমা দেয়ার পাশাপশি কর্তৃপক্ষকে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৭ আগস্টের পর পণ্য খালাসের বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন