সিল্করুট

সমতটের আজীবিক সম্প্রদায়

একটি অজানা ইতিহাস

ড. শহিদুল হাসান


...প্রায় দেড়শত বছর পরই (সপ্তম শতকের দ্বিতীয় পাদে) য়ুয়ান-চোয়াঙ বলিতেছেন (বৈশালী, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট ও কলিঙ্গে) দিগম্বর নির্গ্রন্থ জৈনদের সংখ্যা ছিল সুপ্রচুর। দিগম্বর নির্গ্রন্থদের এই সুপ্রাচুর্য ব্যাখ্যা করা কঠিন। বাংলাদেশ এক সময় আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল এবং এ তথ্য সুপরিজ্ঞাত যে, বৌদ্ধদের চোখে আজীবিকদের সঙ্গে নির্গ্রন্থদের আশন-বসন-আচারানুষ্ঠানের পার্থক্য বিশেষ ছিল না। সেই হেতু বিদ্যাবদান গ্রন্থে দেখিতেছি, নির্গ্রন্থ ও আজীবিকদের নির্বিচারে একে অন্যের ঘাড়ে চাপাইয়া তালগোল পাকানো হইয়াছে। য়ুয়ান-চোয়াঙের সময়ে, বোধ হয় তাহার আগেই, অন্তত বাংলাদেশে আজীবিকেরা নির্গ্রন্থ-সম্প্রদায়ে একীভূত হইয়া গিয়েছিলেন এবং তাহাদের সংখ্যা পুষ্ট করিয়াছিলেন, অথবা বিদ্যাবদানের মতো যুয়ান-চোয়াঙও আজীবিক ও নির্গ্রন্থদের পার্থক্য ধরিতে না পারিয়া সকলকেই নির্গ্রন্থ বলিয়াছেন। কিন্তু একথাও স্মর্তব্য যে, প্রাচীন বাংলায় আজীবিকদের স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্বের প্রমাণ নাই। 

(বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা ৫০২) 

প্রায় সাত দশক আগে প্রাচীন বাংলার পুরোধা ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিটির শেষাংশ গত দশক পর্যন্ত বাংলার আদিপর্বের ধর্ম-সংস্কৃতির ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য উপসংহার হিসেবে গবেষক মহলে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশে বিশেষত বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসংবলিত প্রাচীন সমতট জনপদে জৈন নির্গ্রন্থ সাধুদের অস্তিত্ব ইতিহাসে সুবিদিত হলেও আজীবিকদের উপস্থিতির কোনো লিখিত, স্থাপত্যিক কিংবা মূর্তিতাত্ত্বিক প্রমাণ ছিল না। ২০১৬ সালে নিপ্পন দেশীয় লিপিবিশারদ রিয়োসুকে ফুরুই Ajivikas, Manibhadra and Early History of Eastern Bengal: A New Copperplate Inscription of Vainyagupta and its Implications নামক একটি গবেষণা প্রবন্ধ জার্নাল অব দ্য রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এ প্রবন্ধ নীহাররঞ্জন রায়ের উদ্ধৃতির শেষ বাক্যটিকে নাকচ করে পাঠকের দরবারে তুলে ধরে সমতট এলাকায় পঞ্চম ষষ্ঠ শতকে আজীবিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতির আকাট্য প্রমাণ। মান্যবর ফুরুই বাংলাদেশের একজন সংগ্রাহকের (যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কাছে থাকা রাজা বৈন্যগুপ্তের ইস্যুকৃত একটি তাম্রশাসনের সংস্কৃত পাঠ ও ইংরেজি অনুবাদ তুলে ধরেন। তিনি ২০০৯ সালে প্রথম এই তাম্রশাসনটির ছবি তোলেন। এরপর আরো দুইবার (২০১১ ও ২০১৩) তিনি এটির চিত্রগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে আবদুল মমিন চৌধুরী, রণবীর চক্রবর্তী, সুস্মিতা বসু মজুমদার প্রমুখ গবেষকের লেখায় এ তাম্রশাসনের নানা তথ্য ব্যবহৃত হয়। তবে সবাই রিয়োসুকে ফুরুই কর্তৃক প্রদত্ত পাঠকেই মোটাদাগে অনুসরণ ও গ্রহণ করেছেন। বর্তমান লেখকও একই ধারায় উল্লিখিত গবেষকদের উপস্থাপিত তথ্যাদির আলোকে সমতট জনপদে আজীবিক সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের প্রমাণ তুলে ধরার চেষ্টা করেছে মাত্র। 

ভূমিদান পত্রটি মুখ্য দিকে ২৫ লাইন এবং গৌণ দিকে ২২ লাইনে উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপির প্রকরণে সংস্কৃত ভাষায় লেখা। কিছু কিছু জায়গায় লেখা মুছে গেছে এবং কিছু অক্ষর সম্পূর্ণ পাঠযোগ্য নয়। এই তাম্রশাসনটি ছাড়াও বৈন্যগুপ্তের আরো দুটি তাম্রশাসন সমতট তথা বর্তমান কুমিল্লা অঞ্চল থেকে পাওয়া গেছে— 

(ক) ১৮৮ গুপ্তাব্দে ইস্যুকৃত গুনাইঘর তাম্রশাসন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত। 

(খ) ময়নামতির শালবন বিহারে প্রাপ্ত তাম্রশাসন, যা প্রচণ্ড ক্ষয়প্রাপ্ত এবং অধিকাংশ অংশ পাঠযোগ্য নয়। ব্যারি এম মরিসন সর্বপ্রথম তাম্রশাসনটির সংবাদ দিয়েছিলেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মুহাফেজখানায় সংরক্ষিত আছে। পূর্ব ভারতে তথা বাংলায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি তথা আর্যায়ন প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটেছিল সর্বভারতীর সাম্রাজ্যবাদী রাজশক্তি গুপ্ত শাসকদের হাত ধরে। মহারাজাধিরাজ সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদলিপিতে এটি উল্লেখ রয়েছে যে, তার সাম্রাজ্যের প্রতন্ত বা সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর একটি ছিল সমতট এবং তিনি সেখানে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই গুপ্ত বংশীয় রাজাদের মধ্যে বৈন্যগুপ্ত ছিলেন মহাদেবপাদানুধ্যাত তথা শৈবধর্মে বিশ্বাসী। রিয়োসুকে ফুরুই সম্পাদিত ১৮৪ গুপ্তাব্দের তাম্রশাসনটিতে ভূমিদান করা হয়েছিল আজীবিক শ্রমণদের সংঘের জন্য। এই ভূমিদানের আরাধ্য মন্দিরটি ছিল ভগবত মনিভদ্রের চতুর্মুখ মূর্তির আবাসস্থল। তাম্রশাসনটির সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো এটিতে মহারাজ মহেশ্বর নাথ চন্দ্র কর্তৃক পূর্ববর্তী একটি ভূমিদানের আদেশ প্রত্যক্ষরম (অক্ষরে অক্ষরে হুবহু নকল) করে উদ্ধৃত করা হয়েছে। রাজা মহেশ্বর নাথচন্দ্র ‘‌মণিভদ্রের এই চার মুখবিশিষ্ট মূর্তিটির জন্য জয়নাটনে ‘‌নাথমেট’ অভিহিত একটি আবাসস্থল নির্মাণ করেছিলেন এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ও সেখানে বসবাসরত আজীবিক সংঘের সুবিধার্যে ভূমিদান করেছিলেন।’ 

নাথচন্দ্রের ভূমিদানের সময়টি ছিল ৯১ গুপ্তাব্দ। প্রায় এক শতক বা ৯৩ বছর পর মহারাজা বৈন্যগুপ্ত নাথচন্দ্রের ভূমিদানকেই পুনঃঅনুমোদন করেছিলেন। (আবদুল মমিন চৌধুরী, ‘‌বাংলা ও গুপ্ত সাম্রাজ্য,’ ২০১৯ পৃষ্ঠা-৪৯৮) রক্তমালা তাম্রশাসনেও অনুরূপ একটি চিত্র দেখা যায়। 

কেন সমতটে একই ভূমিদানের পুনঃঅনুমোদনের প্রয়োজন হয়েছিল? এটি কি কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত? অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরীর ভাষ্যমতে,

‌পরবর্তী শাসক কর্তৃক এই পুনঃঅনুমোদনের অবশ্যই সংগত কারণ ছিল। রক্তমালা তাম্রশাসন থেকে এর কারণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বাংলায় গুপ্ত অপশাসন সম্পর্কে তথ্য এই তাম্রশাসনে বিদ্যমান। অপশাসনের এ উল্লেখ থেকে এটা মনে করা অযৌক্তিক নয় যে গুপ্ত শাসকদের দুর্বলতার কারণে বাংলায় অপশাসন ঘটেছিল। রক্তমালা এবং ফুরুই কর্তৃক সম্পাদিত তাম্রশাসনদ্বয় মূলত ইতিপূর্বে ভূমিদানের পুনঃঅনুমোদন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই দুটি ঘটনা গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি সময়ের অপশাসনের চিত্র প্রদান করে। সম্ভবত বৈন্যগুপ্তের শাসনামলের পূর্বে কোনো সময় এই অপশাসন ঘটেছিল।

(আবদুল মমিন চৌধুরী, পৃষ্ঠা, ৪৯৮) 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রক্তমালা তাম্রশাসন ১৮০ গুপ্তাব্দের এবং এটি বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে পাওয়া গেছে। তাম্রশাসনটি ভূমিদান করা হয়েছিল পুণ্ড্রবর্ধনের অধীন মধ্যম-ষণ্ডিক-বিথীতে।

সমতটের আজীবিক শ্রমণদের জন্য প্রদত্ত ভূমিদান করা হয়েছিল জয়নাটন, পায়নাটন, পূর্বমণ্ডল ও দক্ষিণ মণ্ডলে। কোথায় ছিল মনিভদ্রের চতুর্মুখ মূর্তির আবাসস্থল? বর্তমানে কোন প্রত্নস্থলটি পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীর আজীবিক শ্রমণদের উপাসনাস্থলটির স্মৃতি বহন করছে? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং আরো গবেষণা, মাঠ জরিপ ও উৎখননের দাবি করে। তবে তাম্রশাসনটির তথ্যাদি সমতটের আজীবিকদের জীবন, সংস্কৃতি, দর্শনের নানা ইঙ্গিত দেয়। বৈন্যগুপ্তের গুনাইঘর তাম্রশাসনে ২৬ ও ২৭ লাইনে দানকৃতি ভূমির সীমানা নির্দেশক শব্দগুলোর মধ্যে মনিভদ্র ক্ষেত্রম কথাটির উল্লেখ রয়েছে। এর ফলে সমতটীয় জনমানসে ও জনপরিসরে মনিভদ্রের সজীব উপস্থিতি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত।

বাংলার আদি পর্বের ধর্মীয় ইতিহাসের গবেষণাদিতে আজীবিকদের আলোচনা অত্যন্ত স্বল্প। সুস্মিতা বসু মজুমদার রচিত ‘‌বাংলাদেশ ও পূর্বভারতে আজীবিক সম্প্রদায়’ অধ্যায়টি এ বিষয়ক সর্বশেষ বা একমাত্র লেখনী। এটি অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাস আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে আদি বাংলা (আনু. ১২০০ সা. অব্দ পর্যন্ত) গ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ড সমাজ অর্থনীতি সংস্কৃতি-এ অন্তর্ভুক্ত (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১৯, পৃষ্ঠা ৩০২-৩১০)। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে আজীবিকদের উপস্থিতি পাওয়া আনুমানিক ৬০০ প্রাক সা. অব্দ-৩০০ সা. অব্দ কালপর্বে মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমিতে। সুস্মিতা বসু মজুমদার অত্যন্ত চমকপ্রদ শব্দগাঁথুনিতে সংক্ষেপে এ ধর্মের উত্থানকে নথিভুক্ত করেছেন। পাঠকের জন্য এ গবেষকের শব্দমালা কর্জ করে নিম্নে উদ্ধৃত করছি:

আদি ঐতিহাসিক পর্বে উত্তর ভারতে ষাটের অধিক প্রচলিত মতের বিরুদ্ধচারী ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল। উত্তর ভারতীয় সমভূমিতে বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজ্যের (মহাজনপদ) ও নগর কেন্দ্রের উত্থান এবং ধাতব মুদ্রা ব্যবহারের পাশাপাশি এই বৈধর্মিক গোষ্ঠীগুলির—যারা আত্মত্যাগের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল—জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এই সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বৌদ্ধ ও জৈনরা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল। এর পাশাপাশি আজীবিকদের উপস্থিতি লক্ষণীয়, যাদের উল্লেখ ধারাবাহিকভাবে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে আছে। আজীবিকরা ছিল (অগেহ) গৃহহীন সন্ন্যাসী (শ্রমণিক সম্প্রদায়ভুক্ত) যারা ‘নাস্তিক’ হিসেবে পরিচিত ছিল; কেননা তারা বেদ ও বৈদিক জ্ঞানকে ভুলের ঊর্ধ্বে মনে করত না এবং ব্রাহ্মণদের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করত। তারা ভাগ্যে বিশ্বাসী ছিল অথবা ‘সবকিছু আগে থেকে নির্দিষ্ট’—এই দর্শন বিশ্বাস করত। এর ফলে বৌদ্ধ ও জৈনদের সাথে এদের স্থায়ী বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।...আজীবিকরাও আত্মহননের চর্চা করত। তারা মৃত্যুর সময়কে নিয়ন্ত্রণ করত এবং মুক্তির জন্য কি উপায়ে এই দেহ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিত।...আজীবিকদের প্রধান দুটি যক্ষ ছিল—পুন্নভদ্র/পূর্নভদ্র ও মনিভদ্র। জৈন ঐতিহ্য অনুযায়ী, পূর্নভদ্র মৃত্যুপথযাত্রী সন্ন্যাসীকে মৃত্যুর জন্যে তার চূড়ান্ত প্রায়শ্চিত্তের পূর্বের শেষ রজনীতে পরীক্ষা করেন। (পৃষ্ঠা ৩০২-০৪)

প্রথমদিকে মৌর্য শাসনামলে আজীবিকরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠাপোষকতা পেলেও পরবর্তী সময়ে তাদের বসবাসের স্থানগুলো ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে দখল হয়ে যায়। মধ্য গাঙ্গেয় সমতল ভূমি থেকে তারা কি পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে তথা বাংলায় চলে আসে? রিয়োসুকে ফুরুই সম্পাদিত বৈন্যগুপ্তের তাম্রশাসনটি সেদিকেই ইঙ্গিত করে। সুস্মিতা বসু মজুমদারের নিম্নে উদ্ধৃত বক্তব্যটিতে বিষয়টি আরেকটু খোলাসা হতে পারে।

প্রাক সা. অব্দ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে সা. অব্দ পঞ্চম/ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত বিহারে আজীবিকদের উপস্থিতি প্রমাণিত। সা. অব্দ প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে গয়া সন্নিহিত এলাকায় আজীবিকদের আস্তানার বিষয়টি ওড়িশার শাসক খার বেলের জানা ছিল। এ প্রসঙ্গে ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমদিকের তাম্রশাসনটিতে বর্তমান বাংলাদেশের সমতট এলাকায় আজীবিকদের উল্লেখের বিষয়টি বিশদ গবেষণার দাবি রাখে। নাথচন্দ্র-বৈন্যগুপ্তের তাম্রশাসনটি আমাদেরকে আজীবিকদের মধ্যে প্রচলিত অজানা রীতি ও আচার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। তাম্রশাসনটিতে মনিভদ্রের একটি মন্দিরের (আয়তন) উল্লেখ আছে। সম্ভবত মনিভদ্র হলেন যক্ষ।... আজীবিকরাও পূজা-প্রার্থনা করত এবং আচার পালনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন গন্ধ, ধূপ, বলি, চরু ও সত্তর ব্যবহার করত। (পৃষ্ঠা ৩০৭-৩০৮)

বৈন্যগুপ্তের এই তাম্রশাসনটিতে আজীবিক শ্রমণ বা সন্ন্যাসীদের সংঘের উল্লেখ ইঙ্গিত করে যে তারাও জৈন ও বৌদ্ধদের অনুরূপ শ্রমণিক সংগঠন ও স্থাপনা বানিয়েছিল। লিপিতে উল্লিখিত অস্থাবর সম্পত্তিগুলো ষষ্ঠ শতাব্দীর সমতটের সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা উপাদানের আকর তথ্য প্রদায়ক। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে কানসশরপন (পিতল, তামা ও দস্তার শিম্রনে প্রস্তুতকৃত রান্নার বাটি), কানসগলন্তুক (পানির কলস), বলি ভাজনত্তরয় (পূজার তিনটি বাটি), তাম্রগলনতক (তামার তৈরি পানির কলস), কটোরিকা (ছোট বাটি), ছাত্রা (কাপড়ের ছাতা), দন্ত পীঠিকা (হাতির দাঁতের তৈরি মোড়া) ইত্যাদি। এছাড়া তাম্রশাসনটিতে নানা ধরনের যন্ত্রাদি, অস্ত্রাদি ও হাতিয়ারের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন বৃহঃ কান্সদিকা (বড় তূর্য), কুণ্ডালিকা (ছোটদা), কট্টারিকা (ছোট করাত), নিখাতন (নিড়ানি) ইত্যাদি।

ষষ্ঠ শতাব্দীর পর সমতটের আজীবিকদের কী হয়েছিল? তারা কী, কেন এবং কীভাবে এ এলাকা ত্যাগ করেছিল? এ-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্নের কোনো উত্তর পরবর্তী তাম্রশাসনাদি কিংবা লিখিত সূত্রাদিতে অনুপস্থিত। তামিল মহাকাব্য মনিমেকলিতে প্রাপ্ত বর্ণনার ভিত্তিতে রিয়োসুকে ফুরুই অনুমান করেন যে আজীবিকরা চমদণ্ড বা সমদণ্ড থেকে তামিলনাড়ু পৌঁছেছিল। এখানে চমদণ্ড বলতে সমতটকেই বোঝানো হয়েছে। ৫০৪ সা. অব্দে সমতটে আজীবিকদের উপস্থিত পাওয়া গেলেও ৫০৭ সা. অব্দের একটি ভূমিদান পত্রে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত মহাযানী ভিক্ষুদের অবৈবত্তিক গোষ্ঠীর একটি বিশাল বিহারের জন্য জমিদান করেছিলেন। রাজা বৈন্যগুপ্তের সময় সমতটে আজীবিক ও বৌদ্ধদের সংঘ/আশ্রম ছিল। রাজা নিজে ছিলেন শৈব ধর্মানুসারী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাম্রশাসনে অবৈবত্তিকদের প্রদেয় ভূমির সীমানায় থাকা বৌদ্ধ বিহার কিংবা তাম্রপট্টে উল্লিখিত প্রদ্যুশ্নেশ্বরের বৈষ্ণব মন্দির এই এলাকায় তিনটি ধর্মের সরব উপস্থিতির বাহক। এ যেন বহুত্ববাদী সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর আদিরূপ। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা ধর্মতত্ত্বের কায়দায় যাকে বলে Religious Pluralism বা ধর্মীয় বহুত্ববাদ। প্রাচীন সমতট যেন আধুনিক বহুত্ববাদী চেতনার অতীত তারকা, যেখানে রাষ্ট্র কাঠামোর খোলসের মধ্যেই ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ, আজীবিকদের বসবাস। বাংলাদেশের কুমিল্লা ও তৎসংলগ্ন এলাকাগুলো ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ধারণ করেছিল নানা ধর্মমতের সাধক-সন্ন্যাসী শ্রমণদের। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বহুত্ববাদী সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল।


তথ্যসূত্র

১. আবদুল মমিন চৌধুরী, ‘বাংলা ও গুপ্ত সাম্রাজ্য’, আবদুল মমিন চৌধুরী (সম্পাদিত), বাংলাদেশের ইতিহাস আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে আদি বাংলা (আনু. ১২০০ সা. অব্দ), প্রথম খণ্ড, ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১৯, পৃষ্ঠা ৪৮৯-৫০২

২. সুস্মিতা বসু মজুমদার, ‘বাংলাদেশ ও পূর্বভারতে আজীবিক সম্প্রদায়’, আবদুল মমিন চৌধুরী (সম্পাদিত), বাংলাদেশের ইতিহাস আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে আদি বাংলা (আনু. ১২০০ সা. অব্দ পর্যন্ত), দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১৯, পৃষ্ঠা ৩০২-৩১০

৩. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব, কলকাতা: নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, ১৯৮০ (২য় সংস্করণ)

৪. Ryosuke Furui, ‘Ajivikas, Manibhadra and Early History of Eastern Bengal: A New Copperplate Inscription of Vainygupta’, Journal of the Royal Asiatic Society, Series 3, 26, 4 (2016), pp. 657-681

৫. A L Basham, History and Doctrine of the Ajivikas: A vanished Religion, London, 1961

ড. শহিদুল হাসান: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]