বিশেষ সংখ্যা

ভাষা আন্দোলনের বইটি কোনো লোককে উৎসর্গ করিনি উৎসর্গ করেছি বাংলাদেশের জনগণকে

ছবি: সালাহউদ্দিন পলাশ

আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৫০ সালে। আপনার ভাষা আন্দোলনকে দেখার স্মৃতি শুনতে চাই।

আমরা পশ্চিম বাংলার বর্ধমানের মানুষ। ১৯৫০ সালে আমরা ঢাকায় এলাম। সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমি যেহেতু রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, তাই ছেলেবেলা থেকেই রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ ছিল। ঢাকায় আসার পর যত সভা-সমাবেশ হতো; মিছিল-মিটিং হতো, সেগুলোয় যেতাম। বিশেষত ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবিধানের ওপরে একটি আন্দোলন হয়েছিল। লিয়াকত আলী খান একটি প্রস্তাব করেছিলেন পাকিস্তানের সংবিধান নিয়ে। সে সময় তার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন হয়। এটাকে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রথম অভিজ্ঞতা বলা যেতে পারে। লিয়াকত আলী খান তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করেছিলেন এবং আন্দোলন থেমে গেল। এরপর থেকেই ঢাকা শহরে নানা রকম আন্দোলন হতো। বলা চলে যেকোনো ইস্যুতেই তখন ঢাকা শহরে সভা, সমাবেশ, মিছিল হতো। তখন সভা-সমিতি হতো ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন আমি দেখিনি। তখন ঢাকায় ছিলাম না। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দেখেছি। আমি ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই লেখার সময় কোথাও ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করিনি। কারণ আমি ইতিহাস লিখছি। এখানে ‘আমি’ বলার কোনো সুযোগ নেই। অনেকেই আমাকে বলে যে আপনি ভাষা আন্দোলনে অনেক কিছু করেছেন। আমি বলি আমি কিছুই করিনি। ভাষা আন্দোলনে আমি কোনো কর্মী ছিলাম না, নেতা তো নই-ই। আমি ছিলাম একজন অবলোকনকারী। প্রত্যক্ষদর্শী বলা যেতে পারে, যেখানে যা ঘটেছে দেখেছি। এ রকম শত শত আরো প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, আমি তাদের মতো একজন। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির কথা আমি লিখেছি আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ বইয়ে। আমি কী দেখেছি, কী করেছি তার বর্ণনা। আমার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সম্পর্কে কিছু জানতে হলে আমার আত্মজীবনী পড়তে হবে।

কখন মনে হয়েছিল বা আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে কাজ করবেন? আর সে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণটা কী ছিল?

১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভেবেছিলাম ১৯৪৭ থেকে পাকিস্তানের ঘটনাবলি, তৎকালীন ইতিহাসের ওপরে একটি বই লিখব। সেজন্য তথ্য সংগ্রহ করার সময় আমি খেয়াল করলাম প্রচুর তথ্য রয়েছে এ বিষয়ে (ভাষা আন্দোলন)। ভাষা আন্দোলন নিয়েই একটি আলাদা বই হতে পারে। প্রথমে ভাবলাম একটি ১০০-১৫০ পৃষ্ঠার বই হবে। পরে দেখলাম একটি বড় বই হয়ে গেল। বইয়ের ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম, ভেবেছিলাম একটি ছোট বই কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রথম খণ্ড লেখার পর আরো একটি খণ্ডও লাগবে। কিন্তু বই লিখতে গিয়ে এমন পরিস্থিতি হলো দ্বিতীয় খণ্ডেও শেষ হলো না। এত তথ্য ছিল তিন খণ্ডে ভাষা আন্দোলনের বই লেখা হলো।

আপনি কি পেশাদার ইতিহাসবিদ হিসেবে কাজ করবেন এমন ভাবনা কখনো মনে এসেছিল?

বই লেখার সময় আমি কোনো পেশাদার ইতিহাসবিদ হিসেবে কাজ করব এমনটা মনে করিনি। এখনো আমি কোনো পেশাদার ইতিহাসবিদ নই। আমি অনেক তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক বিষয়ও লিখেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেমন পেশাদার হয় তেমনটা না। আমি ইতিহাসের ওপর বলা চলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইও লিখেছি। পেশা হিসেবে আমাকে ইতিহাসবিদ বলা যাবে না। ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, তত্ত্বচর্চাকারী ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মী—অনেকভাবেই আমি কাজ করেছি। কোনো একটি পরিচয় দিয়ে আমাকে চিহ্নিত করা যাবে না। তবে মূলত আমি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি। আমি লিখেছি অনেক কিন্তু আমি কোনো সাহিত্যিক নই। আমি যা কিছু লিখেছি সবই মূলত রাজনৈতিক কারণে লিখেছি। আমি সমাজটিকে পরিবর্তন করতে চেয়েছি। তাই আমার জায়গা থেকে একটি লড়াই করেছি। অর্থনৈতিকভাবে যদি দেখা যায় শিক্ষকতা একটি পেশা ছিল আমার। ১৯৬৮ সালে আমি তা ছেড়ে দিয়েছি। তারপর আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জড়াইনি।

‘‌পূ্‌র্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থ রচনার প্রস্তুতি পর্বটি কেমন ছিল? তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা পদ্ধতি নির্ধারণ করতে কি শুরুতেই পরিকল্পনা করে নিয়েছিলেন?

তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে আমি অনেক জায়গায় লিখেছি। এ কাজ খুব কঠিন ছিল। একটি বিষয় লিখতে গেলে গবেষকরা তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে লাইব্রেরির সাহায্য নেন। সেসব তথ্য ব্যবহার করেন। কিন্তু ইতিহাস লেখার সময় আমি মধ্যযুগ বা প্রাচীন কোনো অতীতের ইতিহাসের বই তেমন লিখিনি। মূলত আমি কন্টেম্পরারি হিস্টোরিয়ান বা সমকালীন ইতিহাসবিদ। ভাষা আন্দোলনের সময়ে বিশেষত খবরের কাগজের সংখ্যাও খুব সামান্য ছিল। মাত্র দু-তিনটি খবরের কাগজ ছিল, সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। এছাড়া অন্য কোনো লেখালেখি ছিল না।

আমি ১৯৭০ সালে আমার বইটি যখন প্রথম প্রকাশ করেছিলাম তার আগ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কোনো বই লেখা হয়নি। কেবল লেখা হতো ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল, ছাত্ররা গুলি খেয়ে মারা গেছে, ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। দেখানো হতো এটি ছিল মূলত শিক্ষিত লোকদের আন্দোলন। ভাষা শিক্ষিত লোকদের ব্যাপার। সেখানে অন্য কারো কথা একেবারেই আসেনি। মনে করা হতো কৃষক বা শ্রমিক ও যারা শিক্ষিত নয় তাদের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ একটি ভুল চিন্তা। কারণ ভাষা জিনিসটি গরিবের জন্য আরো অনেক বেশি দরকার। যারা মধ্য শ্রেণীর শিক্ষিত লোক তাদের টাকা-পয়সা আছে, শিক্ষা আছে। তাদের অনেকেই ইংরেজি জানে, তখন অনেকে উর্দুও জানত। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক তাদের বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই ভাষার ওপর আক্রমণ শিক্ষিত লোকের ওপর যত না পড়ে, গরিব লোকের ওপর তার চেয়ে অনেক বেশি পড়ে। সেজন্যই ব্যাপকভাবে গরিব লোকেরা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। আমি এর বিস্তৃত রিপোর্ট নিতে পারিনি, নেয়া সম্ভবও নয় একজনের পক্ষে। বিভিন্ন জায়গা নিয়ে যেমন গ্রামাঞ্চলে যে আন্দোলন হয়েছিল তার জন্য আলাদা একটি ইতিহাস লেখা হতে পারে। আমার বইয়েও কিছু উদাহরণ আছে, যেখানে গরিব লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে। ১৯৭০ সালে আমিই প্রথম বললাম যে ভাষা আন্দোলনের উত্থান, গণঅভ্যুত্থানে সারা দেশের কৃষক-শ্রমিকদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। যদি না থাকত তাহলে এত বিশাল পরিসরে আন্দোলন হতে পারত না।

আমার বইয়ে আলাদা দিনের ওপর লেখা আছে। সেখানে দেখা যাবে ২১ তারিখে ছাত্রদের আন্দোলন ও গুলির বর্ণনা। কিন্তু ২১-২২ তারিখের বর্ণনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকায় সেদিন একটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। এ আন্দোলনে যেভাবে পুরান ঢাকার লোকজন যোগ দিয়েছিল সেগুলোর বর্ণনা আছে। সেখানে ছাত্রদের ভূমিকা থেকে তাদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৪৮ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, তখন পুরান ঢাকার লোকেরা সে ভাষা আন্দোলনের বিরোধী ছিল। কারণ পুরান ঢাকার লোকেরা বাংলা নয়, এক ধরনের উর্দুই বলত। তারা মনে করত উর্দু ইসলামিক ভাষা। কিন্তু তারপর দেখা গেল মুসলিম লীগের নির্যাতন ইত্যাদির ফলে ’৫২ সালে তারা ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেছিল। ’৪৮ সালে রেললাইন পার হলেই ছাত্রদের মারধর করত পুরান ঢাকার লোকেরা। সেখানে ’৫২ সালে পুরান ঢাকার লোকেরাই গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল।

ভাষা আন্দোলনের সম্পর্ককে আমি অন্যভাবে উপস্থাপন করেছি। এই যে পার্থক্য—১৯৪৮-১৯৫২ সালের মধ্যে—জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এটি কেন ঘটেছিল, সে বিষয়টিও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন ছিল। এটি ব্যাখ্যা করতে গিয়েই আমি পূর্ব পাকিস্তানে এ সময়কালে কী ঘটেছিল খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ থেকে শুরু করে মানুষের ওপর নির্যাতন, চাকরির অভাব ও সব ধরনের অরাজক অবস্থা, মানুষের ওপর জুলুম নিয়ে লিখেছি। সবাই ভেবেছিল পাকিস্তান হলে এখানে এখানে একটি বেহেশত হবে। এখানে মানুষ খেয়ে পড়ে বাঁচবে, লেখাপড়া শিখবে। তার জায়গায় কৃষকরা কিছুই পেল না। আমি ‘বাঙলাদেশের অভ্যুদয়’ বইটিতে লিখেছি, কৃষক সমাজের উপলব্ধি হয়েছিল যে পাকিস্তানে তাদের কোনো লাভ হয়নি এবং পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা করা দরকার। কিন্তু তখন পর্যন্ত তারা পাকিস্তান ফেলে দেয়ার কথা ভাবেনি। ভেবেছিল পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে থেকেই সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কথা। ১৯৪৮-৫২ সাল পর্যন্ত সরকারের নির্যাতন দেখে জনগণের অবস্থার পরিবর্তন হলো। জনগণ সরকারবিরোধী হয়ে উঠছিল। ফলে ১৯৪৯ সালে যখন প্রথম উপনির্বাচন হলো শামসুল হকের কাছে সরকারি প্রার্থী শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়েছিল। এর আগে আর কোনো নির্বাচন উপনির্বাচন হয়নি। ১৯৪৮-৫২-এর মধ্যে যে পার্থক্য, এ পার্থক্যের বিষয়ে ব্যাপক আলোচনার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিষয়গুলো নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি মানুষকে জানানোর। সেজন্যই বই লিখেছি। জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে আন্দোলনকে আমি উপস্থিত করার চেষ্টা করেছি। ভাষা আন্দোলন শুধু ছাত্র, শিক্ষক বা শিক্ষিতদের নয়। এটি একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। এর সঙ্গে যে শিক্ষা নীতি অন্য সরকারি নীতিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আছে এটি প্রমাণ করতে আমি নানা রকম তথ্য সংযুক্ত করেছি। এ তথ্যগুলো আমি বহু লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছি। কারো থেকে একটি-দুটি লিফলেট পেয়েছি ও পুস্তিকা নিয়েছি। এমনকি আমি তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে তার ডায়েরিও নিয়েছিলাম। তখন যে কয়টি পত্রিকা ছিল সেগুলো থেকে তথ্য নিয়েছিলাম। ঢাকায় ছিল তমদ্দুন মজলিসের সৈনিক আর সিলেট থেকে বের হতো মাহমুদ আলীর নও বেলাল। এ দুটো পত্রিকা খুবই সাহায্য করেছিল। এছাড়া আমি কিছুদিন কলকাতার কিছু নিউজ পেপারের লাইব্রেরিতেও কাজ করেছিলাম। সিলেটে একটি লাইব্রেরি ছিল, মুসলিম সাহিত্য সংসদের লাইব্রেরি। সেখানেও আমি কিছুদিন কাজ করেছিলাম। এভাবে আমি তথ্য সংগ্রহ করেছি। শহীদুল্লা কায়সার আমাকে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন ডকুমেন্টগুলো এনে দিয়েছিলেন। তাদের লিফলেটগুলো দিয়েছিলেন। আমাকে তিনি ’৫২ সালে ইনার পার্টি সার্কুলারগুলোর কপি এনে দিয়েছিলেন। এখন ভাষা আন্দোলনের ওপরে যে লেখালেখি হয়, তা তো প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু না। সবটাই সরকারি প্রোপাগান্ডা। সরকার চলে যাওয়ার পর আবর্জনার স্তূপে নিক্ষিপ্ত হবে। তখন কেউই আর একে ইতিহাস হিসেবে বিবেচনা করবে না। তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ভাষা আন্দোলনের ওপর আরো ভালো বই লেখা হবে। একটা বিষয়ে আমার চেয়ে বেশি সুবিধা কেউ পাবে না। প্রথমত আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছি সে সময়ে যারা অংশগ্রহণ করেছিল ভাষা আন্দোলনে, তাদের। ব্যাপকভাবেই তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারগুলো থেকে ৫৯ জনের রিপোর্ট প্রথম বের হয় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল’ বইয়ে। সাক্ষাৎকার যাদের নিয়েছি, ভবিষ্যতের ইতিহাস চর্চায় তাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার আর সুযোগ থাকবে না। কারণ তারা তো চলে গেছেন। দ্বিতীয়ত, একটা-দুটো করে লিফলেট ও পুস্তিকা আমি সংগ্রহ করেছিলাম বিভিন্ন জায়গা থেকে। নানা রকম বই, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির মতো ডায়েরি—এসব তথ্য আমি ব্যবহার করেছি। এখন আর তেমন করে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পুলিশের কাছে কিছু হয়তো থাকতে পারত। ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় কমিটি থেকে একটা পুস্তিকা বের করা হয়েছিল। বলা যেতে পারে, এ একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজটা আমি করেছিলাম। কাজী গোলাম মাহবুব সর্বদলীয় কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি আমার আব্বা আবুল হাশিম সাহেবকে বলেছিলেন একটা পুস্তিকা লিখে দিতে। আব্বা আমাকে বললেন, তুমি এটা লিখে দাও। এ প্রথম আমি লিখেছিলাম, ‘আমাদের ভাষা আন্দোলন’ বলে একটা পুস্তিকা। এক ফর্মার মতো হবে। এটাই ছিল আমার প্রথম রাজনৈতিক রচনা। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। যা-ই হোক, এটা সর্বদলীয় কমিটি থেকে ১০ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। সামান্য কয়েক কপি বিলি হয়েছিল। বাকিটা জিপে করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সিজ করে নিয়ে যায়। নিয়ে কী করেছিল জানি না, জ্বালিয়ে দিয়েছিল কিংবা তেমন কিছু। কেননা অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ আর্কাইভে এটা পাওয়া যায়নি।

তথ্যের ব্যাপারে একটা মুশকিল ছিল। বইটা তো বেরিয়েছিল ’৭০ সালে। আইয়ুব খানের সময় অনেকে তথ্য ভয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল আগুন দিয়ে। অনেক তথ্য পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। বেশির ভাগই ভয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়েছে তথ্য। এখন যে অবস্থা, কেউ ইতিহাস লিখতে গেলে মনে হয় না কোনো জায়গা থেকে একটা লিফলেট কেউ উদ্ধার করতে পারবে। সেদিক থেকে দুই ধরনের তথ্য আমি ব্যবহার করেছিলাম। সাক্ষাৎকার ও বিভিন্ন লিফলেট, পুস্তিকা ও পার্টির সার্কুলার। কমিউনিস্ট পার্টির সার্কুলারটা নষ্ট হয়ে গেছে। শহীদুল্লা কায়সার সেটা তদারক করতেন। তাকে মেরে ফেলার পর পুরো কমিউনিস্ট পার্টির সমৃদ্ধ আর্কাইভ গায়েব হয়ে গেল। একটা বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি কার কাছে এটা রেখেছিলেন, এটা কাউকে বলেননি। কেউ জানত না। যার কাছে ছিল, তিনি ভয়ে বোধহয় সব জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই ওই তথ্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমার বইটা এদিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেসব তথ্য আমি ব্যবহার করেছি, এ ধরনের তথ্য পরে অন্যদের দ্বারা পাওয়া সম্ভব না। তবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে আরো লেখা ভবিষ্যতে অবশ্যই হবে। হওয়া উচিত। নতুন প্রজন্মের যারা সত্যিকার ইতিহাস চর্চা করবে, তারা নিশ্চয়ই লিখবে। তবে সেখানে তথ্যের ব্যাপারে আমি যে সুবিধা পেয়েছিলাম, সে সুবিধা তাদের আর থাকবে না। তখন মনে হবে তারা একটা প্রাচীন ইতিহাস লিখছে।

বইটি লিখতে আপনি অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এসব সাক্ষাৎকার নেয়ার কোনো উল্লেখযোগ্য স্মৃতি আছে কি?

সাক্ষাৎকার নেয়ার স্মৃতি আমি আমার বইয়ের প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় বলেছি। সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়। সাক্ষাৎকার নিতে গেলে কখনো দেখা যায়, কোনো লোক নিজের ভূমিকাকে বাড়িয়ে বলছে। আরেকটা হলো অন্যের ভূমিকাকে ছোট করার চেষ্টা করছে। আবার দেখা যায়, সত্যিকার স্মৃতিবিভ্রম হচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করছে না, কিন্তু তার ভুল হচ্ছে। এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যার একটা আমি প্রায়ই উল্লেখ করি। আতাউর রহমান খান ’৫৭-’৫৮ সালে এখানে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। আতাউর রহমান খান সাক্ষাৎকারের সময় আমাকে বলেছিলেন, ১৯৪৮ সালে যখন জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসেছিলেন, তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা কমিটির দেখা হয়েছিল। অলি আহাদ ও শামসুল হকের সঙ্গে জিন্নাহ সাহেবের কিছু বিতর্ক হয়েছিল। জিন্নাহ সাহেব তো নামাজ পড়তেন না। কিন্তু সন্ধ্যা যখন হলো শামসুল হক জায়নামাজ চাইলেন নামাজ পড়ার জন্য। এতে জিন্নাহ সাহেব বিরক্ত হলেন। কারণ তিনি মনে করলেন, উনি যে নামাজ পড়েন না, উনাকে বিরক্ত করার জন্যই জায়নামাজ চাওয়া। যা-ই হোক, আতাউর রহমান খান এসব ঘটনা আমাকে বলেছিলেন। এসব শোনার পর আমি তাকে বললাম, আপনি এসব কথা বলছেন কিন্তু আপনি তো ওখানে ছিলেন না। উনি বললেন, আমি নিশ্চয়ই ছিলাম। আমি বললাম, আপনি ছিলেন না। দশজন যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে একমাত্র লিলি খান ছাড়া বাকি সবার ইন্টারভিউ করেছি। কেউ আপনার নাম বলেনি। তাছাড়া আপনি তো রাষ্ট্রভাষা কমিটির মেম্বারও ছিলেন না। উনি বললেন, না, আমি ছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে। জিন্নাহ সাহেব আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলছিলেন। আমি বললাম, সেটা হতে পারে। কারণ জিন্নাহ সাহেব হাইকোর্টের উকিলদের থেকে আরম্ভ করে অনেক ধরনের লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেছিলেন। সে সময় হতে পারে আপনার ঘাড়ে হাত রেখে কথা বলেছিলেন। কিন্তু ওইখানে তো আপনি ছিলেন না। তখন তিনি বললেন, না আমি ছিলাম। তিনি কামরুদ্দীন আহমদ সাহেবকে ফোন দিতে চাইলেন।

কামরুদ্দীন আহমদ সাহেব তখনকার খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক ছিলেন। তিনি প্রথমে মুসলিম লীগ করেছিলেন সাতচল্লিশের আগে। খুব পণ্ডিত লোক ছিলেন। লেখক ও সৎ লোক ছিলেন। আতাউর রহমান খানদের বন্ধুও ছিলেন। আমার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আতাউর রহমান খান আমাকে বললেন, কামরুদ্দীন সাহেবকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে দেখি তো, আমি ছিলাম কিনা। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনি জিজ্ঞাসা করুন।’ উনি কামরুদ্দীন সাহেবকে ফোন করলেন। বললেন, ‘উমর এসেছে আমার সাক্ষাৎকার নিতে। বলছে যে আমি নাকি ওই সময় ছিলাম না।’ কামরুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘না। আপনি তো ছিলেন না।’ তখন তিনি ঘাবড়ে গেলেন। তার দুই তিন মাস পরে ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকায় আতাউর রহমান খান সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, বদরুদ্দীন উমর বই লিখেছে, কিন্তু সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ভূমিকাকে খর্ব করেছে। আসলে আমি তার ভূমিকাকে খর্ব করতে যাব কেন! আমি যে তথ্য পেয়েছি, তা-ই ব্যবহার করেছি। আর আমি সারাজীবনে অনেক লিখেছি ইতিহাস বিষয়ে। আমি কোনো ক্ষেত্রেই তথ্যের বাইরে যাইনি। কেউ বলতে পারবে না, আমি যা লিখেছি, তা তথ্যের বাইরে। সবকিছু আমি তথ্যের ভিত্তিতে লিখেছি। 

এ ধরনের ঘটনা আরো আছে। 

তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অসহযোগিতা পেয়েছিলেন এমন ঘটনা হয়েছিল?

তথ্য সংগ্রহে অসহযোগিতা সাধারণত আমি পাইনি। সবাই সহযোগিতা করেছে। কিন্তু কেউ কেউ খুবই বিরোধী ছিল। আমার একজন খুব বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন—সাহিত্যিক ও গুণী লোক ছিল। কিন্তু তার কী কারণে জানি না, আমি যে ভাষা আন্দোলনের ওপর বই লিখছিলাম, এটার প্রতি তার বিরূপতা ছিল। কেন আমি লিখছি! সে আমাকে একদমই সাহায্য করেনি। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির সব ডকুমেন্টস ও লিফলেট ছাপার দায়িত্ব তার কাছেই ছিল। সে অনেক কিছুই দিতে পারত, কিন্তু দেয়নি। এ রকম ঘটনা খুব ব্যতিক্রমী। বেশির ভাগ লোকই আমাকে সাহায্য করেছিল। যতটুকু পেরেছিল, আমাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল।

অনেকেই আপনার ভাষা আন্দোলনবিষয়ক কাজকে একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করেন। আপনিই প্রথম এ আন্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্যটিকে সামনে এনেছিলেন। অন্যদের চেয়ে আপনার এ দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?

তার কারণ আমার রাজনীতি। বেশির ভাগ লেখক যারা ভাষা আন্দোলনের ওপরে লিখেছে, তারা রাজনৈতিক ব্যক্তি না। তারা কোনো না কোনো ধরনের বুদ্ধিজীবী কিংবা সাহিত্য চর্চা করে। রাজনৈতিক লোকও যারা লিখেছে, তাদের ও আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম ছিল। আমি একজন মার্ক্সবাদী, আমি কমিউনিস্ট। আমি এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ভাষা আন্দোলনের বইটি লিখেছি। প্রথম খণ্ড বের হয়েছিল ১৯৭০ সালের নভেম্বরে। দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৭৬ সালে। আর তৃতীয় খণ্ড বের হয় ১৯৮৪ সালে। তখন আমি মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এ ইতিহাস লিখেছিলাম। যে দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের মধ্যে পাওয়া যায় না।

তিন খণ্ডের গ্রন্থটি প্রকাশে আপনাকে বেশ অনেক বছর কাজ করতে হয়েছে। এর মধ্যে আপনি সক্রিয় বিপ্লবী রাজনীতি করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্মৃতি যদি কিছুটা শোনান আমাদের।

এ ধরনের গবেষণামূলক বই লিখতে হলে লাইব্রেরিতে কাজ করতে হয় বছরের পর বছর। থিসিস করতে হয়। আমার তো সেটা ছিল না। আমি তো ৬৮ সালে রাজশাহী থেকে চলে আসার পর বরাবরই সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কাজ করেছি। বেশির ভাগ সময়ই রাজনৈতিক কাজ করতে হয়েছে। নানা রকম ট্যুর করতে হয়েছে, সাংগঠনিক কাজ করতে হয়েছে। তার মধ্যেই আমি কাজটি করি। ভাবলে আমি নিজেও বিস্মিত হই, কীভাবে কাজটি করেছিলাম। তার মধ্যেই এত তথ্য সংগ্রহ করেছি। তার মধ্যেই লোকজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তার মধ্যেই লেখালেখি করেছি। আমার লেখালেখির কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকেনি। যেকোনো সময় আমি লিখেছি। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা, রাতে—যখনই সুযোগ পেয়েছি, লিখেছি। তবে আমি ঘোরাঘুরির সময় লেখালেখি করিনি। আমার অভ্যাস হচ্ছে, আমি বাইরে বা ট্যুরে থাকার সময় পড়াশোনা করতে পারি না। লেখালেখি তো করতেই পারি না। কাজে আমি যখন বাইরে যাইনি, ঢাকাতে ছিলাম, সে সময় আমি বই লিখেছি। সেজন্য ১৯৭০ সারে প্রথম খণ্ড, ১৯৭৬ সালে দ্বিতীয় খণ্ড। ১৯৭৬ সালে যখন বইটা বেরিয়েছে, তখন আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম। ১৯৭৬ সালের বইটা মোটামুটি আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার সময় বের হয়েছিল। তারপর তৃতীয় খণ্ড বের হয়েছে ১৯৮৪ সালে। এ সময়ের মধ্যে আমি ভীষণ রাজনৈতিকভাবে কর্মব্যস্ত ছিলাম। এ ব্যস্ততার মধ্য থেকেই এ কাজ করেছি। বলা চলে, আমি রাজনৈতিক কাজ করেছি বলেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যেভাবে আমি লিখেছি, সেভাবে লেখা সম্ভব হয়েছে। আমি যদি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না থাকতাম। রাজনৈতিক কাজে যদি নিজেকে নিযুক্ত না রাখতাম। মানুষের সঙ্গে সেভাবে মেলামেশা না করতাম। তাহলে কিন্তু যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বইটি লেখা হয়েছে, একটা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের দিক থেকে সেটা হতো না। সেজন্য আমি ভাষা আন্দোলনের বইটি (পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি) কোনো লোককে উৎসর্গ করিনি। উৎসর্গ করেছি বাংলাদেশের জনগণকে। যারা আসলে এ সংগ্রাম করেছিল। সংগ্রামের মূল বীজ ছিল। কিন্তু এখন যে ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আলোচনা হয়, সেখানে জনগণের কোনো খবর নেই। ভাষা আন্দোলন হয়ে গেছে একজনের আন্দোলন। যার ভূমিকা প্র্যাকটিক্যালি অতিসামান্য ও অনুল্লেখযোগ্য ছিল। এ ধরনের যে লেখালেখি বা প্রোপাগান্ডা, এগুলো তো ইতিহাস হিসেবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে না। তথ্যের কষ্ঠিপাথরে যাচাই হয়ে বাকি সবই আবর্জনার স্তূপে নিক্ষিপ্ত হবে। ইতিহাসের এত বিকৃতি খুব কমই হয়েছে। ভারতে এখন করছে। কিন্তু এ দেশে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তর অভ্যুত্থান ও একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে যেসব তথ্য এখন ছাড়া হচ্ছে, সেগুলোর কোনো ঐতিহাসিক মূল্য নেই। এগুলো ইতিহাস হিসেবে বিবেচনার যোগ্য না। নিশ্চয়ই এদেশের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের ইতিহাসবিদরা লিখবে। এটাই আশা করি।