সিল্করুট

চাচনামা

সিন্ধের প্রাচীন ইতিহাস

অনুবাদ: মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী


প্রথম দিনের যুদ্ধের বিবরণ

পরম্পরাগত মতবাদের রচয়িতাগণ বর্ণনা করেছেন যে মুহম্মদ আল্লাফি যখন পর্যবেক্ষণ ভ্রমণ থেকে ফিরে এলেন তখন রাই দাহার তার পুত্র জয়সিয়াকে যুদ্ধে পাঠালেন। জয়সিয়া মস্তবড় হাতির পিঠে চড়ে প্রচুরসংখ্যক যোদ্ধা লড়াকু হাতি সহযোগে ইসলামের সৈন্যবাহিনীর পথ রুখে দাঁড়ালেন এবং যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। তীব্র লড়াইয়ের ফলে অসংখ্য সিন্ধ সৈন্য মারা পড়ল, জয়সিয়ার সৈন্যবাহিনী পালাতে বাধ্য হলো। জয়সিয়া নিজে তার অসংখ্য সাহসী সশস্ত্র যোদ্ধা এবং দেহরক্ষীসহ ইসলামের সৈন্যবাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেল। তারা চতুর্দিক থেকে ঘোরতর লড়াইয়ের সম্মুখীন হলো। আরব সৈন্যদল জয়সিয়াকে প্রচণ্ড এক আক্রমণ করে বসল এবং তার প্রচুরসংখ্যক অনুসারীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিল। জয়সিয়ার হাতির মাহুত তখন বুঝতে চেষ্টা করলেন যে লড়াই অব্যাহত থাকবে নাকি পশ্চাদপসরণ করে এই ভয়াল বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। এজন্য তিনি তার হাতিটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওহে গজরাজ, তুমি কি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাও নাকি নিজেদের নিরাপদ রাখতে চাও? রাজা দাহার জয়সিয়ার জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন আছেন, তোমার দুশ্চিন্তার কারণ কী? নিরাপদ থাকার জন্য চল ফিরে যাই।

কথা শুনতে পেয়ে জয়সিয়া বললেন, শত্রুসৈন্য যখন আমাদের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আমাদের কোণঠাসা করে ফেলেছে তখন কীভাবে আমরা রক্ষা পাব? চতুর্দিক থেকে আমাদের ঘেরাও করে রাখা হয়েছে এবং বেরিয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনাই তো দেখছি না। সবকিছু শেষ হয়ে গেল মনে হয়।

হাতিটির মাহুত তখন উপলব্ধি করলেন যে জয়সিয়া যুদ্ধ থেকে পিছু হটে গিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে চাইছেন। তিনি রকম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুতাপও করছেন। মাহুত তত্ক্ষণাৎ হাতিটিকে সামনে যুদ্ধরত আরব অশ্বারোহী পদাতিক যোদ্ধাদের অভিমুখে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিলেন। তারা কোনোক্রমেই হাতির আক্রমণ ঠেকাতে না পেরে পথ ছেড়ে দিল। ইসলামের সৈন্যবাহিনী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল আর জয়সিয়া পালানোর জন্য একটি পথ পেয়ে গেলেন। এভাবেই তিনি যুদ্ধকে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। তার সৈন্যবাহিনীর সবাইকে কচুকাটা করা হলো। একমাত্র তিনিই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এলেন দাহারের শিবিরে। রাই দাহার হ্রদটির পূর্ব তীরে শিবির স্থাপন করেছিলেন। তিনি তার পুত্র জয়সিয়াকে দেখতে পেয়ে তার আরাধ্য দেবতার উদ্দেশে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন এবং যথারীতি প্রণাম জানালেন। জয়সিয়াকে নিরাপদে অক্ষতদেহে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি দেবতার উদ্দেশে প্রশংসাসূচক স্তব পাঠ করলেন।

ওই একই দিনে হাজ্জাজের একটি চিঠি এসে পৌঁছাল। তিনি লিখেছেন, যেখানে দাহার আছে সেখানেই তুমি পৌঁছে যাও, যেখানেই সে যাক না কেন তুমিও সেখানে চলে যাও। তুমি নিশ্চিত থাক যে আল্লাহর সহায়তায় জয় তোমারই হবে এবং শত্রুরা পরাজিত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

মুহম্মদ কাসিমের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন রাসিল

মুহম্মদ বিন আবুল হাসান মাদানির বর্ণনামতে, দাহার পুত্র জয়সিয়া যখন পালিয়ে ফিরে গেলেন এবং তার সৈন্যরা মারা গেল ঠিক তার পরই রাসিল মুহাম্মদ কাসিমের কাছে দূত পাঠিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন। রাসিলের মহামন্ত্রী রকম না করার জন্য পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, দাহার আপনার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন এবং আপনাকে তিনি অনেক বিশ্বাস করেন। রকম একটি সময়ে তার বিরুদ্ধে যাওয়াটা আপনার পক্ষে সম্পূর্ণ বেমানান হবে। এছাড়া নিশ্চিত করে এখনো এটা বলা যাচ্ছে না যে আরবগণই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে কিনা। আপনার ভাই মোকাহ্ তখন দাহারের সাথে শত্রুতাবশত ইসলামের সৈন্যবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিক থেকে দাহারকে ত্যাগ করার কোনো রকম অজুহাতও আপনার কাছে নেই।

পরামর্শ সত্ত্বেও মহামন্ত্রীর অগোচরেই রাসিল একজন আস্থাভাজন পরিচারককে একটি বার্তাসহ মুহম্মদ কাসিমের কাছে পাঠালেন। বার্তাটি ছিল রকম:

একবার আমি যে শপথ করেছি তা অবশ্যই আমার রক্ষা করা উচিত পাশাপাশি মুহম্মদ কাসিমের কাছে সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করাটা একটি লজ্জাজনক নিন্দনীয় বিষয়। আমার কর্মের কারণে আমার শত্রুপক্ষ যাতে উপহাস করতে না পারে সেজন্য আমি বিশ্বাসযোগ্য ছলনার আশ্রয়ে কাজটি করব। আমি ঘোষণা করে দেব যে আমি রাই দাহারের সাথে যোগ দিতে রওয়ানা দিচ্ছি। ঘোষণাকৃত যে রাস্তাটি দিয়ে আমি যাব আপনি সে রাস্তায় অশ্বারোহী বাহিনী পাঠিয়ে আমাকে ধরে ফেলবেন এবং আটক করবেন। এই উপায়ে আমার শত্রুরাও আমাকে নিন্দা করার সুযোগ পাবে না এবং আমার অভীষ্ট লক্ষ্যটিও অর্জিত হবে।

রকম ব্যবস্থা অনুযায়ী রাসিল তার পিতা বাসায়েকে দুর্গের শাসক নিযুক্ত করে নিজে বেত দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি তার পিতাকে বললেন, আরব সৈন্যরা আসতে পারে। তাদের সাথে যুদ্ধ করতে যাবেন না। বশ্যতা স্বীকার করেই তাদের কাছে যাবেন। তাদের মনোতুষ্টির জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন। পদক্ষেপটিই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য যুক্তিযুক্ত বলে মনে হচ্ছে কারণ এই ভূখণ্ড আরবদের হাতেই শেষমেশ অর্পিত হবে।

রকম দৃঢ়সংকল্প নিয়ে রাসিল তখন যাত্রা শুরু করলেন। মুহম্মদ কাসিম সেই মোতাবেক পাঁচশত অশ্বারোহী যোদ্ধাকে পূর্বনির্ধারিত স্থানে পাঠিয়ে দিলেন। রাসিলের কথামতো সেখানে তার হাজির হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করতে লাগলেন। যে যোদ্ধারা রাসিলের সাথে সহযাত্রী হয়েছিলেন তারা ভেবেছিলেন তাদের প্রভু রাসিল হয়তো শত্রুসৈন্যদের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। রকম ভাবনা থেকে তারা কানর্বা দুর্গ থেকে প্রায় সতের মাইল দূরে জয়নিত্রি নামক একটি স্থানে যুদ্ধে রত হলো। রাসিল পালাবার চেষ্টা করলেন না, এমনকি সে সময়ে তিনি যুদ্ধও পরিহার করলেন। তার কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্র দলকে হত্যা করা হয়েছিল। যেহেতু মুহম্মদ কাসিম সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন রাসিলকে হত্যা না করে শুধু গ্রেফতার করার জন্য, তাই তারা আঘাত করল না বটে কিন্তু তাকে তার বেঁচে থাকা সঙ্গীদের গ্রেফতার করে মুহম্মদ কাসিমের কাছে নিয়ে এল।

মুহম্মদ কাসিম তাকে কাছে ডেকে বললেন, ওহে রাসিল, আপনি কি চান আপনার ভাই মোকাহর খাতিরে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দেই? আমি অনেক আগেই বশ্যতা স্বীকার করার আহ্বান জানিয়ে আপনাকে বার্তা পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তখন আপনি আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। আর এখন আমাদের কাছে বন্দি হয়েছেন। আপনি যে কলঙ্কজনক নিন্দাকে ভয় করতেন সেটা থেকে এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। এখন সময় এসেছে, আমাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। তার ফলে আমি আপনাকে মহামূল্যবান আনুকূল্য দান করতে পারব এবং দেশের মধ্যে আপনার পছন্দের যেকোনো একটি অঞ্চলের শাসনক্ষমতা আপনাকে অর্পণ করতে পারব। রাসিল আরব সেনাপতিকে অভিবাদন জানিয়ে বশ্যতা স্বীকার করলেন এবং সম্মানসূচক পরিচ্ছদে ভূষিত হলেন।

দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ

রাসিল যখন আনুগত্য স্বীকার করার অনুষ্ঠান পালন করছিলেন এবং দৃঢ় অঙ্গীকারের ভিত্তিতে বিশ্বস্ত থাকার শপথ নিলেন তখন তিনি বললেন, বিধাতার বিধান কেউ খণ্ডন করতে পারে না। আপনি আমাকে এতটাই কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন যে মুহূর্ত থেকে আমি দৃঢ়ভাবে আপনার সেবায় রত থাকব। কখনই আপনার ইচ্ছা আনন্দের থেকে বিচ্যুত হব না। সবসময় বিশ্বস্তভাবে আপনার হুকুম পালন করব।

যেভাবেই হোক কিছুদিন এই প্রদেশটির ব্যবস্থাপনার ভার মোকাহকে বুঝিয়ে দিয়ে রাসিল মৃত্যুবরণ করলেন। রাসিল মোকাহ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন তখন তারা দুজনেই মুহম্মদ কাসিমকে পরামর্শ দিলেন নারাই নামক স্থানে যুদ্ধশিবির সরিয়ে যাবার জন্য। তখন দাহারের যুদ্ধশিবিরটি ছিল কযী যাক্ নামক স্থানে। তারা দেখতে পেয়েছিলেন যে দাহারের সেনাবাহিনী আরব সৈন্যদের মাঝখানে একটি হ্রদ ছিল। এটা অতিক্রম করা খুবই দুঃসাধ্য ছিল। রাসিল তখন আরব সেনাপতিকে বলেছিলেন, ন্যায়পরায়ণ সেনাপতি ইমাদুদ্দিন মুহম্মদ কাসিম দীর্ঘজীবী হোন! এই হ্রদটি অবশ্যই পাড়ি দিতে হবে। তার পরক্ষণেই এই উদ্দেশ্যে রাসিল একটি নৌকা জোগাড় করলেন। প্রতিবারে ত্রিশজন যোদ্ধাকে নৌকায় উঠিয়ে সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে হ্রদের অন্য তীরে নিয়ে যাওয়া হলো কিন্তু তখন একটি সংকীর্ণ গিরিখাত পার হওয়া খুবই আবশ্যক ছিল। রাসিল তখন মুহম্মদ কাসিমকে বলেছিলেন, আপনাকে আরো একটু উজানের দিকে গিয়ে জিতোর অঞ্চলের দোহারা নদীর তীরে শিবির স্থাপন করতে হবে। এই জায়গাটি ছিল মূলত শহরের উপকণ্ঠে। এই স্থান থেকে দাহারের সাথে আপনি সহজেই যুদ্ধ করতে পারবেন এবং অগ্রবর্তী পশ্চাত্বর্তী উভয় সেনা দলকেই নেতৃত্বদান করতে পারবেন। একই সময়ে আপনি তার মালামালের ওপর আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবেন এবং আপনার দখলে নিয়ে আসতে পারবেন।

মুহম্মদ কাসিম এই পরামর্শটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করলেন এবং জিতোর গিয়ে দোহারা নামক ছোট একটি নদীর পাড়ে শিবির স্থাপন করলেন। খুব শিগগিরই রাই দাহার অবগত হলেন যে আরব সৈন্যরা জিতোর পর্যন্ত চলে এসেছে। মহামন্ত্রী সিয়াকর যখন সংবাদ জানলেন তখন তার মুখ থেকে আশ্চর্যবোধক একটি কথা বেরিয়ে এল, হায়! তারা কি তাহলে জিতোর নামক শহরে চলে এসেছে! এই জিতোরকে বলা হয়ে থাকে বিজয় লাভের স্থান। আরব সৈন্যরা যখন এখানে আসতে পেরেছে তাহলে জয় তাদেরই হবে৩।

রাই দাহার ঘাড় ঘুরিয়ে কথা শোনার পর ঈর্ষার আগুনে তার মস্তিষ্ক দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। তিনি ক্রোধান্বিতভাবে বললেন, সে হা-বাড়ি নামক স্থানে ঘাঁটি গেড়েছে। এটা সেই স্থান যেখানে তাদের সবার হাড়গুলোর সমাধি রচনা হবে। দাহার তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং হঠাৎ করেই রাওয়ার দুর্গের দিকে পালিয়ে গেলেন। দুর্গের দেয়ালের ভেতরে তিনি তার অনুসারী মালপত্তর সুরক্ষিত রেখে নিজে চলে এলেন একটি গ্রামে। সেখান থেকে আরব বাহিনী প্রায় তিন মাইল দূরত্বে অবস্থান করছিল।

এখানে দাহার একজন জ্যোতিষীর সাথে পরামর্শ করলেন। তিনি বললেন, আমি শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে চাচ্ছি। আপনি দেখুন তো শুক্র গ্রহটি কোথায় অবস্থান করছে? আপনার শাস্ত্র অনুসন্ধান করে দেখুন এই দুই সৈন্যবাহিনীর মধ্যে কে বিজয়ী হবে আর কেইবা পরাজয় বরণ করবে। এর শেষ কোথায় আমাকে অবগত করুন। জ্যোতিষী তার শাস্ত্রগ্রন্থ আলোচনা করে বললেন, বিজ্ঞানভিত্তিক একটি হিসাব-নিকাশের পর দেখতে পাওয়া যায় যে ইসলামের সৈন্যবাহিনীর জন্যেই বিজয় সংরক্ষিত হয়ে আছে। কারণ শুক্র গ্রহ এদের পেছনে রয়েছে এবং আপনার সামনে অবস্থান করছে।

দাহার কথা শুনেই অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। জ্যোতিষী বললেন, মহারাজ সময়ে নিজের ওপর অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ রাখুন। মুহূর্তে একটি সোনার তৈরি শুক্রের প্রতিমা গড়ানোর আদেশ দিন। জ্যোতিষীর পরামর্শ অনুযায়ী শুক্রের অবয়বটিকে তৈরি করার পর দাহারের ঘোড়ার জিনের ফিতার সঙ্গে বেঁধে দেয়া হলো। এর ফলে আশা করা হয়েছিল শুক্র তার পেছনে থাকার ফলে বিজয় তারই হবে। মুহম্মদ কাসিম আরো কাছে অগ্রসর হলেন, ফলে এই দুই সৈন্যবাহিনীর মধ্যকার দূরত্ব রইল মাত্র দেড় মাইল।

আরবদের সাথে দাহারের তৃতীয় দিনের যুদ্ধ

পরবর্তী দিন মুহম্মদ কাসিম আরো এগিয়ে গেলেন। তিনি এবার যেখানটিতে নামলেন সেটি শত্রুসৈন্যের ঘাঁটি থেকে খুবই কাছাকাছি অর্থাৎ প্রায় দুই ডাক-এর মতো দূরত্বে। দাহার তখন তার রাজা মহারাজাদের মধ্যে একজন সেনানায়ক ঠাকুরকে ডাকলেন, তার নাম ছিল দাহির আওর৬। দাহার তাকে মুহম্মদ কাসিমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিলেন। সেই অনুযায়ী দাহির আওর তার সৈন্যদলসহ রওনা দিলেন এবং সরাসরি ইসলামের সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। ওই দিন খুব ভোরবেলা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উভয় পক্ষের সাহসী যোদ্ধাদের মধ্যে হাতাহাতি যুদ্ধ কঠিন যুদ্ধ সংঘটিত হলো। সম্পূর্ণ পরিশ্রান্ত হওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেল এবং তারপর তারা তাদের নিজস্ব শিবিরে ফিরে গেল।

পরবর্তী দিনের অর্থাৎ চতুর্থ দিনের যুদ্ধ

পরবর্তী দিন অভিশপ্ত রাই দাহার শত্রুসৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য যেপুরবাসী সেনানায়ককে আদেশ করলেন। তিনি ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা, তিনি যুদ্ধের জন্য বের হয়ে গেলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত শত্রুসৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকলেন। দাহারের বিশেষভাবে নির্বাচিত সৈন্যদের সবাই একের পর এক আরবদের তরবারির খাদ্যবস্তুতে পরিণত হলো।

মহামন্ত্রী সিয়াকর যথারীতি অভিবাদন প্রদান করার পর দাহারের কাছে এসে বললেন, ওহে মহারাজ, যে পদ্ধতিতে আপনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন সেটা একটি ভুল পদ্ধতি। বহুবার আপনার ভুল পরিকল্পনার কারণে আপনি ব্যর্থতাকে বরণ করেছেন কিন্তু এখনো পর্যন্ত আপনি অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো জ্ঞান অর্জন করেননি। এটা সত্য যে মানুষ যা ভাবে বিধাতা সেটা অন্য রকম করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও একজন শাসকের উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিপ্রসূত কর্মপরিকল্পনার কারণেই দুর্দৈবকে দূর করা যায়। আপনার উচিত ছিল খুব শুরুতেই, যখন আরব সৈন্যরা দলে দলে মোন নদ পাড়ি দিচ্ছিল তখনই তাদের বাধা দিয়ে হয়রান করে তোলার। এর ফলে আপনার বিরুদ্ধে আবারো যুদ্ধ করার ঝুঁকি নেবার সাহস তারা হারিয়ে ফেলত। এখন তারা নদীতীরে সুসজ্জিতভাবে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। যতজন সেনানায়ককে আপনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছেন, তারা প্রত্যেককেই হত্যা করেছে। আপনার এই ধরনের পরিকল্পনা কোনোভাবেই সঠিক নয়। তাদের আপনার অশ্বারোহী পদাতিক বাহিনীর সমন্বয়ে সমস্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে এক বিশাল আক্রমণ করা উচিত। যদি আপনি সফলতা পেয়ে যান তাহলে আপনার অভীষ্ট লাভ হবে এবং আপনার শত্রুদের হঠিয়ে দিতে সফল হবেন। যদি পরিকল্পনা সফল নাও হয় তবুও আপনি পরাজিত হয়েও অন্যান্য দেশের রাজাদের নিন্দার হাত থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। তারা আপনাকে ক্ষমা করবেন এবং আপনার অনুসারী সন্তান সন্ততি চিরদিন কলঙ্কমুক্ত থাকতে পারবেন। দাহার এই পরামর্শটি গ্রহণ করলেন।

দাহারের সৈন্যসমাবেশ মুহম্মদ আল্লাফির বিষয়ে জয়সিয়াকে উপদেশ দান

পরবর্তী দিন দাহারের নির্দেশে যুদ্ধদামামা বেজে উঠল এবং পতাকাগুলো উঁচু স্থানে পতপত করে উড়তে থাকল। রাজকীয় গোত্রসমূহের তরুণ বীরেরা, বিখ্যাত অশ্বারোহী যোদ্ধারা এবং বহুযুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বীরেরা দাহারের নেতৃত্বে সেদিনকার যুদ্ধে যোগ দিলেন। এদের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার, সাথে ছিল ষাটটি লড়াকু হাতি (কেউ বলেন ১০০ হাতি) এবং সম্পূর্ণ লৌহবর্ম আচ্ছাদিত কুড়ি হাজার সশস্ত্র পদাতিক যোদ্ধাও এই বাহিনীতে ছিল। এরা সবাই দাহারের সম্মুখভাগে অগ্রসর হচ্ছিল আর দাহার নিজে অতিকায় একটি হাতির পিঠের শিবিকাতে বসে ছিলেন। লৌহনির্মিত বিশাল একটি বর্ম দ্বারা এটি আচ্ছাদিত ছিল৭। তার আপাদমস্তক অস্ত্রে সজ্জিত ছিল এবং হাতে ছিল খুবই শক্তভাবে জ্যা বাঁধা একটি ধনুক৮। শিবিকাটিতে তার সাথে দুজন পরিচারিকাও ছিল, এদের একজন একের পর এক তীরগুলো এগিয়ে দিচ্ছিল আর অন্যজন তাকে পান সাজিয়ে দিচ্ছিল৯।

দাহার যখন সৈন্যবাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন তার পুত্রকে ডেকে বললেন, আমি তোমার সাথে মুহম্মদ আল্লাফিকে দিচ্ছি, আরবদের যুদ্ধের কৌশলগুলো তিনি তোমার চেয়ে অনেক ভালো জানেন। তার পরামর্শ মোতাবেক কাজ কর, অগ্রসর হওয়া বা পশ্চাদপসরণ যেকোনো বিষয়েই তাকে অনুসরণ করবে।

সেই দিনটি ছিল হিজরি ৯৩ সালের১০ রমজান মাসের তারিখ। দাহার যখন যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হলেন মুহম্মদ কাসিম তখন মুসলমানদের উৎসাহ দিতে শুরু করলেন এবং যুদ্ধের জন্য অনুপ্রাণিত করতে লাগলেন। তিনি বললেন, ওহে আরব যোদ্ধাগণ, আজকের দিনটি হলো হাতে-কলমে যাচাই-বাছাইয়ের দিন। ইসলামের মানরক্ষার জন্য ইসলামের ওয়াস্তে তোমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে...

রাই দাহারের মৃত্যুর বিবরণ

এই ইতিহাসের রচয়িতাগণ বর্ণনা করছেন যে, রাই দাহারের মৃত্যুর দিনটি ছিল হিজরি ৯৩ সালের পবিত্র রমজান মাসের দশম দিন, রোজ বৃহস্পতিবার। সময়টা ছিল সূর্যাস্তের মুহূর্ত।...

লোকেরা বলেছিল, যখন দাহার মারা যায় তখন সিন্ধবাসীরা তাঁর দেহ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খুলে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছিল। তারা দাহারের শবদেহটি যেখানে পড়ে ছিল সেখানেই নিমজ্জিত হওয়ার জন্য ফেলে রাখল।

টীকা

. তারিখ মাসুমী অনুযায়ী এই যুদ্ধটি গুজরী হ্রদের তীরে রাফিয়ান নামের গ্রামে আবদুল্লাহ্ বিন আলী সাকিফির নেতৃত্বে মুসলমানগণ লড়েছিলেন। এই যুদ্ধে সিন্ধবাসীদের পরাজয়বরণের মূল কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে দুর্ঘটনাবশত সিন্ধের সেনাপতির ঘোড়াটি তাকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছিল এবং সৈন্যদের মাঝখানে চালকবিহীন ফিরে যাওয়ার ফলে সৈনিকেরা মনে করেছিল যে তাদের নেতা হয়তো নিহত হয়েছেন। তারপর তারা পালাতে শুরু করল এবং তাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক যোদ্ধা হ্রদের জলে ডুবে মারা গিয়েছিল।

. দেখেই বোঝা যায় যে মহামন্ত্রী বুদ্ধিমানের উত্তরসূরি হিসেবে তার কার্যালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মন্ত্রী সিয়াকর কিন্তু ভান্ড উয়ির সামানি নামে কিছু আগে যে ব্যক্তির উল্লেখ আমরা পেয়েছি তিনি কোনোভাবেই মন্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা বা যাজক শ্রেণীর ব্যক্তি, কারন তার নামের উপাধিতে আমরা সামানি পেয়েছি।

. জিতান শব্দটির অর্থ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া।

. চাচনামাহ্ প্রদত্ত বিবরণ অনুযায়ী এটা মনে হতে পারে যে রাই দাহার আলোর ত্যাগ করে কিছু দূরে গিয়ে আরবদের দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু তারিখ মাসুমী অনুযায়ী গুজরি হ্রদের তীরবর্তী রাফিয়ান গ্রামে সিন্ধী সৈন্যদের পরাজিত করার পর মুহম্মদ কাসিম সরাসরি রাজধানী নগরী আলোর অভিমুখে অভিযান পরিচালিত করেন। তারপর তিনি দাহারকে দুর্গের ভেতরে অবরুদ্ধ করে রাখলেন। দুর্গে ঢোকার জন্য আরবগণ প্রচুর পরিমাণে পাথর ছোড়ার যন্ত্র অগ্নি-ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োগ করলেন কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারলেন না। মাঝে মাঝে সিন্ধের সৈন্যবাহিনী আরব সৈন্যবাহিনীর ওপর প্রবল আক্রমণ পরিচালনা করছিল কিন্তু প্রতিবারই পরাজিত হচ্ছিল। দশ দিনে দুর্গের দেয়ালের বাইরে রকম সাতটি খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হলো। তারপর স্মরণীয় ৯৩ হিজরি সালের ১০ রমজান তারিখে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বদানে দাহার স্বয়ং দুর্গের বাইরে বেরিয়ে এলেন।

. প্রায় এক মাইল দূরত্বের সমান।

. একটি পাণ্ডুলিপিতে লেখা দাহির কুঁয়ার কিন্তু সেই পাণ্ডুলিপিটিতেই পরবর্তীতে এই নামটি দাহিরাউদ বলে লেখা আছে।

. তুফাতুলকিরামের রচয়িতা সৈয়দ আলী শের কানিয়া বলেছেন যে জ্যোতিষীগণের আপত্তিকে আগ্রাহ্য করে দাহার স্বয়ং অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। তার মতানুসারে দাহার স্বয়ং সর্বশেষ দিন অর্থাৎ রমজান মাসের ১০ তারিখে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, এখানে উল্লেখিত তারিখে নয়। তার সাথে সেদিন দশ হাজার অশ্বারোহী, ত্রিশ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং অসংখ্য লড়াকু হাতি ছিল।

. তুফাতুলকিরাম গ্রন্থ অনুযায়ী দাহারের হাতে একটি ধারালো চকচকে চাক্তি ছিল।

. তারিখ মাসুমী তুফাতুলকিরাম অনুযায়ী কুমারী পরিচারিকা দুজনের একজন দাহারকে পান সাজিয়ে দিচ্ছিল, অন্যজন দিচ্ছিল পেয়ালাভরা মদ। এছাড়া হাতির পিঠের সেই শিবিকায় দাহারের পেছনে একজন ব্রাহ্মণ বসে ছিল, চাচনামাহ্ অবশ্য এর বিশদ বর্ণনা দেয়নি।

১০. ৭১১ খ্রিস্টাব্দ।­

 

[মির্জা কালিচবেগ ফ্রাদুনবেগ (১৯০০ খ্রিস্টাব্দ) কৃত চাচনামার ইংরেজি অনুবাদ থেকে গ্রন্থটি চাচনামাহ্ নামে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী। অনুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অন্বেষা প্রকাশন। অনুবাদকের অনুমতিক্রমে চাচনামাহ্র নির্বাচিত অংশ এখানে সংকলিত হয়েছে]