সিল্করুট

কিতাব আত তাসরিফের অনুবাদ

এসএম রশিদ


আবুল কাসিম খালাফ ইবনে আব্বাস আল জাহরাভির নাম ইউরোপের মধ্যযুগের মানুষেরা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেনি। ঠিক যেমন এখনো তারা প্রাচ্যদেশীয় নাম তাদের ইংরেজি উচ্চারণে করে থাকে। তো সব মিলিয়ে জাহরাভিকে মধ্যযুগের ইউরোপের টেক্সটে পাওয়া যাবে আলবুকাসিস নামে। নাম যেভাবেই উচ্চারণ করা হোক দিন শেষে জাহরাভি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি নাম। ত্রিশ খণ্ডে তিনি রচনা করেন কিতাব আত তাসরিফ লিমান আজিজা আনিত তালিফ। আরবি ভাষার রচনার ইংরেজি অনুবাদ করাটা সহজ ছিল না; আক্ষরিকভাবে করতে গেলে সেটা এমন হয়দ্য বুক অব এনাবলিং হিম টু ম্যানেজ হু ক্যান নট কোপ উইদ দ্য কমপাইলেশনস। নাম থেকে বোঝা যায় লেখক বইটি তৈরি করেছেন একটি গাইডবুক হিসেবে, যেটি দেখে কেউ চাইলে সে মতো চিকিৎসা করতে পারবেন, তাকে অন্য কোনো বই ঘাঁটতে হবে না। বইয়ের প্রথম খণ্ডে আছে বিভিন্ন ওষুধ তৈরির সূত্র এবং শরীর গঠনবিদ্যার আলোচনা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন রোগের লক্ষণ চিকিৎসা পদ্ধতি। অংশটি তুলনামূলক অন্য খণ্ডগুলোর চেয়ে বড়, পুরো বইয়ের এক-পঞ্চমাংশ। দুটি খণ্ড ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে হিব্রু, তারপর লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়। ১৫১৯ সালে লাতিন অনুবাদটি জার্মানির অগসবার্গ শহরে প্রকাশিত হয়।

ছাব্বিশ নম্বর অধ্যায়টি রোগ অনুযায়ী রোগীর খাবার-পথ্য এবং সুস্থদের জন্যও খাবার তালিকা। উনত্রিশতম অধ্যায়ে আছে বিভিন্ন ভাষায় কোনো ওষুধের নাম, বিভিন্ন উপাদানের ব্যাখ্যা, সেগুলোর পরিমাণ। বাকি যে পঁচিশটি অধ্যায় আছে সেগুলোয় আলোচিত হয়েছে ম্যাটেরিয়া মেডিকা, ওষুধ, পিল, মলম, প্লাস্টার বানানোর পদ্ধতি। এগুলো বইটির ছেচল্লিশ শতাংশজুড়ে আছে। আটাশ নম্বর অধ্যায়ে আছে ওষুধের গুণগত মানোন্নয়ন, বিভিন্ন খনিজ পাথর উত্তপ্তকরণ এর ব্যবহার। ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে অধ্যায়টি হিব্রু হয়ে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়। অংশটি লাইবার সার্ভিটোরিস নামে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অধ্যায়টি লাতিন ভাষায় প্রথম ছাপা হয় ভেনিসে ১৪৭১ সালে, নিকোলাস জেনসনের উদ্যোগে। এরপর এটি আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কিতাব আত তাসরিফের সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ গ্রন্থের শেষ অধ্যায়টি। অর্থাৎ ত্রিশতম অধ্যায়, যেটি লিখিত হয়েছে সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা নিয়ে। ইতিহাসে শল্যচিকিৎসা বিদ্যার প্রথম বিজ্ঞাননির্ভর, পূর্ণাঙ্গ এবং অলংকৃত রচনা। জাহরাভি লিখেছেন প্রাচীনদের শিখিয়ে যাওয়া শল্যচিকিৎসার জ্ঞানকে তিনি পুনরুজ্জীবিত করতে চান। রচনায় তিনি হিপোক্রেটিসকে যেমন এনেছেন, তেমনি উল্লেখ করেছেন পউলাস এজিনেটার শিখিয়ে যাওয়া বিদ্যা। এই দুই পণ্ডিতের মাঝে ফারাক কিন্তু এগারোশ বছর। জাহরাভির সাধনা হয়তো তথ্যটি থেকে অনুমান করে নেয়া যায়। তিনি তার অতীত গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন ধর্ম-জাতীয়তা নির্বিশেষে। তিনি নিজে একজন চিকিৎসক ছিলেন। অতীতের পণ্ডিতদের সঙ্গে তিনি তার কাজের অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করে রচনা তৈরি করেন।   

কিতাব আত তাসরিফের ত্রিশতম অধ্যায়টির খ্যাতি খুব দ্রুত ইসলামী দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে টলেডোর জেরার্ড অব ক্রেমোনা ল্যাটিন ভাষায় এটি অনুবাদ করেন। শিরোনাম ছিল লাইবার আলশাহরাভি ডে কিরুরগিয়ে। অনুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ইতালীয় ফরাসি শল্যচিকিৎসকদের ওপর গ্রন্থের প্রভাব ছিল ব্যাপক। প্রসঙ্গে ত্রয়োদশ শতকের উইলিয়াম ডি স্যালিসেটো এবং চতুর্দশ শতকের গাই ডি শলিয়াকের নাম করা যায়। এরা ছিলেন তাদের যুগের বিখ্যাত সার্জন। তারা জাহরাভিকে হিপোক্রেটিস গ্যালেনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

মধ্যযুগের আরেক বিখ্যাত সার্জন ফ্যাব্রিসিয়াস অ্যাব অ্যাকুয়াপেনডেন্ট (১৫৩৩-১৬১৯) তিন জাতির তিনজন লেখকের নাম উল্লেখ করেছেন যাদের কাছে তিনি ঋণীএকজন রোমান, একজন গ্রিক এবং আরেকজন আরব; সেলসাস, পউলাস এজিনেটা আলবুকাসিস বা আমাদের জাহরাভি। টলেডোর জেরার্ড অব ক্রেমোনার লাতিন অনুবাদটি ছাপা হয় ভেনিসে, ১৪৯৭ সালে। এরপর আরো কয়েকটি সংস্করণ ভেনিসের লুকানটোনিও ডি জিয়ানটা দ্য ফ্লোরেন্টিন প্রেস থেকে ১৫২০, ১৫৩২ এবং ১৫৪০ সালে প্রকাশিত হয়।

পঞ্চদশ শতকে প্রকাশিত হয় জাহরাভির আত তাসরিফের তুর্কি অনুবাদ। শিরোনাম ছিল জারাহিয়ে--ইলখানিয়ে। অনুবাদ করেন সাবুনজু-ওঘলু শারাফ আল-দিন আলি আল-হাজ্জ ইলিয়াস। অনুবাদ সংস্করণটি একটি কারণে ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছে। এতে স্থান পেয়েছে অসংখ্য অলংকরণ। এর মধ্যে আছে বইয়ে উল্লেখ করা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। আছে রোগী চিকিৎসকের চিত্র, আরো আছে চিকিৎসক বিভিন্ন অপারেশন করছেন এমন অলংকরণ।

জাহরাভির বইয়ের প্রথম আধুনিক সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ সালে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় লাতিন অনুবাদের সংস্করণটি প্রকাশ করে। অনুবাদ করেন জন শ্যানিং। দুই খণ্ডে প্রকাশিত অনুবাদের শিরোনাম ছিল আলবুকাসিস ডি শিরারজিয়া, অ্যারাবিক অ্যাট লাতিন। সংস্করণে পাওয়া যায় নতুন কিছু যন্ত্রপাতির চিত্র, যেগুলো আগের কোনো লাতিন অনুবাদে ছিল না। ফুটনোটে নতুন সংযোজনের সূত্র পাওয়া যায়। এখানে শ্যানিং জানিয়েছেন তিনি আলেপ্পোতে থাকা বা সেখান থেকে পাওয়া একটি পাণ্ডুলিপি থেকে সংযোজন করেছেন। অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি পুরনো অনুবাদের সহায়তা নিয়েছিলেন। তিনি নিজে চিকিৎসক ছিলেন না। তাই অনেক ক্ষেত্রে গাই ডি শলিয়াকের মতামতের ওপর নির্ভর করেছেন। তবে জনের পিতা চিকিৎসক ছিলেন। সে সূত্রে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে কিছু ধারণা রাখতেন। ১৭২৬ সালে তিনি সোসাইটি অব অ্যাপোথেক্যারিসের সদস্য হন। সোসাইটি থেকে তিনি একটি ডিগ্রিও নেন ১১৭১ সালে। সময়ের মধ্যে ক্যানন অব ক্রাইস্টচার্চের আরবি হিব্রু ভাষার অধ্যাপক ডা. থমাস হান্টের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ধারণা করা যায় ডা. হান্টের কাছে থেকেই তিনি আরবি ভাষা শিখেছিলেন। বিদ্যাই তিনি কাজে লাগান জাহরাভির অনুবাদে। ১৭৬৪ সালে শ্যানিংকে ক্রাইস্ট চার্চের শিক্ষার্থী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এখানেও ছিল ডা. হান্টের সুপারিশ। দু বছর তিনি এক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। সেটি দেখে কর্তৃপক্ষ আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং ১৭৭৪ সালে ইউনিভার্সিটি প্রেসের কর্মকর্তার শ্যানিংয়ের আলবুকাসিস ডি শিরারজিয়া প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। এক্ষেত্রে তারা বই প্রকাশে শ্যানিংয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নেন। দুই ফরম্যাটে বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। রয়াল কাগজে ছাপা হবে ১০০ কপি যার ২৫টি যাবে শ্যানিংয়ের কাছে আর মধ্যম মানের কাগজে ২৫০ কপি যার ২৫টি পাবেন অনুবাদক। দুঃখের বিষয় ১৭৭৫ সালে শ্যানিং মারা যান। বইটি প্রকাশ হয়েছিল ১৭৭৮ সালে।

আধুনিক ভাষারীতিতে ত্রিশতম অধ্যায়ের প্রথম অনুবাদ ছিল লুসিয়ে লেককার্কের ফরাসি সংস্করণ, প্রকাশিত হয় প্যারিস থেকে ১৮৬১ সালে। ১৯০৮ সালে আরবি ভাষার একটি লিথোগ্রাফ প্রকাশ হয় ভারতের লক্ষে থেকে। লন্ডনের দ্য ওয়েলকাম ইনস্টিটিউট অব দ্য হিস্ট্রি অব মেডিসিন থেকে ১৯৭৩ সালে আরবি টেক্সটের সমান্তরাল একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন এম এস স্পিংক জি এল লুইস। বিভিন্ন জায়গার সাতটি পাণ্ডুলিপি যাচাই করে অনুবাদ সম্পন্ন হয়।

 

এসএম রশিদ: লেখক