সিল্করুট

সোহরাওয়ার্দী ও ভেরা তিশেঙ্কো দম্পতিকে নিয়ে শায়িস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামুল্লাহ

‘তারা খুবই ভিন্ন মানুষ ছিলেন’

আসরার আবেদিন


কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো জানেন তার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কে যুক্ত ব্যক্তিরা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু তাকে তার ঘনিষ্ঠজনরাই ভালো করে চিনতেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন বেগম শায়িস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামুল্লাহ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তার ফুপাতো ভাই। শায়িস্তা সোহরাওয়ার্দীর জন্ম ১৯১৫ সালে। তিনি পাকিস্তানের মুসলিম সমাজের পর্দাপ্রথা থেকে বেরিয়ে আসা প্রথম নারীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে পিএইচডি করেছিলেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি মরক্কোয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি লেখালেখির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে প্রকাশিত হয় তার বই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী: বায়োগ্রাফি।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। কিন্তু এর সঙ্গে তার রাজনৈতিক জীবনে তৈরি হয়েছিল বেশকিছু বিতর্ক। কিন্তু তাতে তার গুরুত্ব কখনো ফুরায়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে বাঁকবদল, সময়ের কারণে তাকেও আড়ালে পড়তে হয়। এরপর দেশ থেকে দূরে বৈরুতে মৃত্যু। এর আগে ভেরা তিশেঙ্কোর সঙ্গে বিয়ে। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাদ দিয়েও সোহরাওয়ার্দীর কিছু ব্যক্তিগত বিষয়ও কৌতূহলোদ্দীপক। শায়িস্তা সোহরাওয়ার্দীর লেখায় এসব উঠে এসেছে। তিনি চাইতেন ভাইকে নিয়ে একটি বই লিখতে। তার বইয়ের ভূমিকায় নিজেই বলেছেন, আমি তাকে বারবার জিজ্ঞেস করতাম, শহীদ ভাই, অপনি সেখানে কী করেছিলেন? আপনি ওই সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছেন? এমনকি অনেক জরুরি সময়েও এসব প্রশ্ন করতাম।

শায়িস্তা সোহরাওয়ার্দীর লেখায় এসেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একাকী জীবন দ্বিতীয় বিয়ের প্রসঙ্গ। তিনি লিখেছেন, শহীদ ভাইয়ের জীবন ছিল একাকী দুঃখপূর্ণ। সব মহৎ মানুষের ক্ষেত্রেই তা হয়, তবে শহীদ ভাইয়েরটা আরো বেশি ছিল। তার সত্যিকারের কোনো গার্হস্থ্য জীবন ছিল না। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর পরই তিনি স্যার আবদুর রহীমের মেয়েকে বিয়ে করেন। আমার মনে আছে, শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী একজন সুন্দরী রুচিশীল নারী ছিলেন। তাদের একটি ছেলে একটি মেয়ে হয়। কিন্তু সে (শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্ত্রী) তিন বছর পর মারা যায়। শহীদ ভাইয়ের মা এরই মধ্যে মারা যাওয়ার কারণে তার সন্তানদের নানির তত্ত্বাবধানে বড় করা হয়। তার জীবনে কারণে ছিল না কোনো ভালোবাসা, ঘরে শিশুদের অনুপস্থিতি, সঙ্গীর অভাব। বহুদিন এমন অবস্থা চলতে থাকে।

সোহরাওয়ার্দী অবস্থায় থাকাকালীন তার সঙ্গে ভেরা তিশেঙ্কোর পরিচয় হয়। বিয়েও হয় তার সঙ্গে। শায়িস্তা লেখেন, তিনি বহু বছর ধরে বিয়ে করেননি, কেননা সে সময় সাধারণত পরিবার থেকেই বিয়ের আয়োজন করা হতো আর তার তেমন কোনো আয়োজক ছিল না। তার মা মারা গিয়েছিলেন এবং তাকে রাজি করানোর মতো কেউ বর্তমান ছিল না। তার আত্মীয়রা খুবই খুশি হতেন যদি তিনি পুনরায় বিয়ে করতেন। তাকে বলাও হতো কিন্তু তিনি হেসে উড়িয়ে দিতেন। তিনি বুঝেছিলেন যতটা সময় একটা সম্পর্কে দেয়া প্রয়োজন তা তার পক্ষে সম্ভব না। দীর্ঘ ১৮ বছর বিপত্নীক থাকার পর তিনি একজন রাশিয়ান রিফিউজিকে বিয়ে করেন। ভেরা তিশেঙ্কোর দুরবস্থা তাকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু বিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ভেঙে যায়। তারা খুবই ভিন্ন মানুষ ছিলেন। একত্র সহাবস্থান সম্ভব ছিল না। সম্পর্ক ভাঙার ব্যাপারটি শহীদ ভাইয়ের দুশ্চিন্তার কারণ হওয়ার পাশাপাশি এটি থেকে তিনি আমরা (পরিবার) স্বস্তি পেয়েছিলাম। স্বস্তির নাম ছিল শহীদ ভাইর দ্বিতীয় পুত্ররাশেদ। পরিবারে সেই একমাত্র পুরুষ যে মুসলিমদের জন্য কাজ করার পাশাপাশি পাকিস্তানের কাজে এসেছিল।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর খবরটিও তিনি পেয়েছিলেন রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে। এক শীতের সকালে রাশেদ লন্ডনে এসে যখন তাকে খবরটি দেয় তখন আসলে রাশেদের কিছু বলতে হয়নি, শায়িস্তা বুঝে নিয়েছিলেন কী হয়েছে। তিনি লিখেছেন, আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে কী কথা হচ্ছিল আমি জানি না। ভেরা, রাশেদের মা এসেছিল সকালে আর আমরা পরস্পরকে বিদায় জানিয়েছিলাম। আমি কিছু ফুল এসে তার কেবিনে রাখার ব্যবস্থা করি। ভেরার বিদায়ের পর মোহম্মদাবাদের রাজা সাহেব এসে দেখা করেন আমার সঙ্গে। আমি আনমনে বলেছিলাম, জানি না, রাশেদ কীভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সব কাজ করবে। রাজা সাহেব খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, চিন্তা করবেন না। বৈরুত একটি মুসলিম দেশ। তারা কোনো সমস্যা ছাড়াই সব ব্যবস্থা করবে। এরপর তিনি আমার কোরআন শরিফের আলগা পাতায় একটি আয়াত লিখে বিদায় নেন।

সেদিন ঠিক ১২টার সময় শায়িস্তার মনে হয়েছিল শেষ বিদায়ের সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে না থাকাটা তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তিনি দুপুরেই পিআইএতে খোঁজ নিয়ে বিমান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইলেন। তিনি পিআইএতে ফোন করে করাচির একটি টিকিটের ব্যবস্থা করেন। শায়িস্তা লিখেছেন যে তিনি যাওয়ার সময় বিভিন্ন পত্রিকায় সোহরাওয়ার্দীর বিদায় শিরোনামে খবর দেখছিলেন। তিনি মূলত তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে সোহরাওয়ার্দী মারা গিয়েছেন। তাই লিখেছেন, আপন মনেই বলে উঠলাম সত্যিই ঘটনাটি ঘটেছে

বিমানটি বৈরুত হয়ে করাচি গিয়েছিল। শায়িস্তা লেখেন, আমি বৈরুত বিমানবন্দরে নামলাম। আমি ওয়েটিং রুমে ছিলাম, সেখানে হামিদ নওয়াজকে দেখি। তিনি লেবাননে পাকিস্তানের দূত ছিলেন। এরপর রাশেদ শহীদ ভাইয়ের জামাতা আহমেদকে চোখে পড়ে। রাশেদ আমার কাঁধে হাত রাখল আর আমরা সবাই টারমাকে দাঁড়ালাম। সেখানে শহীদ ভাইয়ের কফিন আনা হচ্ছিল। আমার মনে হলো কফিনটি ছোট। দাঁড়িয়ে থেকে আমার শেকসপিয়ারের তিনটি লাইন মনে পড়ল

Oh mighty Caesar! dost thou lie so low?

Are all thy conquests, glories, triumphs, spoils,

shrunk to this little measure? 

আসরার আবেদিন: প্রাবন্ধিক