খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের সিংহাসনে বসেন। মৌর্য যুগে জল ও স্থল উভয় পথেই বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চলত। বিশেষ করে মধ্য এশিয়া, চীন, তিব্বত, ব্রহ্মদেশ ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। পশ্চিমে রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্য সম্বন্ধ ছিল। ভারত থেকে সাধারণত বস্ত্র, চামর, অভ্র, মূল্যবান পাথর ইত্যাদি ওই সব দেশে রফতানি করা হতো। সেই সময় বঙ্গদেশের তাম্রলিপ্ত বন্দর একটি প্রধান সামুদ্রিক বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। প্রাচীন পুঁথিপত্র,
প্রাচীন পালি
ও সংস্কৃতি
গ্রন্থ, লিপিফলকের
বিবরণ, মেদিনীপুর
জেলায় প্রাপ্ত
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
থেকে তাম্রলিপ্তের
কথা জানা
যায়। মহাভারতে
পূর্ব ভারতের
অঙ্গ, বঙ্গ,
পুণ্ড্র ও
মগধ রাজ্যগুলোর
সঙ্গে তাম্রলিপ্ত
রাজ্যেরও নাম
আছে। মহাভারতে
ভীমের দিগ্বিজয়
প্রসঙ্গে বলা
হয়েছে, ভীম
মুদ্দগিরি, পুণ্ড্র,
বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত
রাজাদের পরাজিত
করেন। বহু
পুরাণে বিশেষভাবে
বিষ্ণু ও
মত্স্যপুরাণে তাম্রলিপ্তের
নাম বারবার
পাওয়া যায়।
জৈনদের ধর্মগ্রন্থ
‘জৈনকল্পসূত্র’,
কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’,
সোমদেবের ‘কথাসরিত্সাগর’,
বরাহমিহিরের ‘বৃহত্সংহিতা’
প্রভৃতি গ্রন্থে
তাম্রলিপ্তের উল্লেখ
আছে। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ
‘মহাবংশ’
থেকে জানা
যায়, সম্রাট
অশোক সিংহলরাজের
কাছে তার
পুত্র মহেন্দ্র
ও কন্যা
সংঘমিত্রাকে বোধিবৃক্ষের
একটি শাখাসহ
পাঠিয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব
২৪৩ সালে
তাম্রলিপ্ত বন্দর
থেকে। সেই
সময় সম্রাট
অশোক স্বয়ং
তাম্রলিপ্তে এসেছিলেন।
অশোক এখানে
২০০ ফুট
উঁচু একটি
স্তম্ভ নির্মাণ
করেন। ফা-হিয়েনের
ভারত ভ্রমণকাল
৩৯৯ খ্রিস্টাব্দ
থেকে ৪১৪
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত,
তার পরিক্রমার
দুটি বছর
তিনি এখানে
ছিলেন, সেই
সময় তাম্রলিপ্তে
তিনি ২৪টি
সাংঘারাম ও
বহু বৌদ্ধ
সন্ন্যাসী দেখেছিলেন।
ফা-হিয়েনের
২০০ বছর
বাদে হিউয়েন
সাং তাম্রলিপ্তে
১০টি বৌদ্ধমঠ
ও হাজারের
ওপর বৌদ্ধ
ভিক্ষু দেখেন।
এছাড়া তিনি
অশোক পিলার
ও বহু
হিন্দু মন্দির
এ নগরে
দেখেছিলেন। খ্রিস্টীয় প্রথম
শতাব্দীতে প্লিনি
তাম্রলিপ্তকে ‘তালুক্তি’
ও দ্বিতীয়
শতাব্দীতে টলেমি
তাম্রলিপ্তকে ‘তমালিতেস’
বলে উল্লেখ
করেছেন। ষষ্ঠ
শতাব্দীর দণ্ডীর
‘দশকুমারচরিত’
থেকে জানা
যায়, তাম্রলিপ্তের
রাজা সমগ্র
সুহ্মদেশের রাজা
ছিলেন। সপ্তম
শতাব্দীতে গৌড়শ্বের
শশাঙ্ক মেদিনীপুরের
দণ্ডুভুক্তি (বর্তমান
দাঁতন), উত্কল
ও গঞ্জাম
জেলা জয়
করেন। অষ্টম
শতাব্দীর পর
থেকে তাম্রলিপ্ত
বন্দরের পতন
ঘটতে থাকে।
অসংখ্য পুরাবস্তুর
প্রমাণে প্রত্নতাত্ত্বিকরা
অনুমান করেছেন
যে সেকালের
বিবিধ প্রাচীন
ধর্মগ্রন্থ, বিদেশী
ও চৈনিক
পর্যটকদের বিবরণে
বিভিন্ন নামে
উল্লিখিত সেকালের
সামুদ্রিক বন্দর
তাম্রলিপ্ত, তাম্রলিপ্তি,
তালুক্তি, তমালিকা,
তমালিশি, দামলিপ্ত,
তমলিটিস, তমোলিত্তি
সম্ভবত আজকের
এ তমলুক। বহু প্রাচীনকালেও
তাম্রলিপ্ত থেকে
দেশের মধ্যে
এবং সমুদ্রপথে
দেশের বাইরেও
যাতায়াত ছিল।
জাতকের গল্প
থেকে জানা
যায়, মধ্যপ্রদেশের
বণিকরা বারাণসী
বা চম্পা
থেকে জাহাজ
করে গঙ্গা-ভাগীরথীর
জলপথে তাম্রলিপ্তে
আসত। সেখান
থেকে বঙ্গোপসাগরের
কূল ধরে
তারা সিংহলে
যেত। কিংবা
উত্তাল সমুদ্র
পাড়ি দিয়ে
তারা যেত
সুবর্ণভূমি। প্রাগৈতিহাসিক
কাল থেকে
শুরু করে
রেলপথের সূত্রপাত
হওয়ার আগ
পর্যন্ত গঙ্গা-ভাগীরথী
ছিল বাংলাদেশের
সঙ্গে উত্তর
ভারতের প্রধান
যোগসূত্র। আর
প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ
ক্ষেত্রেই ব্যবহার
করা হতো
তাম্রলিপ্ত বন্দরকে।
রেশম জাতীয়
জিনিসপত্র, পান,
সুপারি, চন্দনকাঠ,
বাঁশ, কাঠ,
তেজপাতা ইত্যাদির
যাতায়াত ছিল
তাম্রলিপ্ত বন্দর
ছুঁয়ে। প্রাচীন বাংলার
সামুদ্রিক বাণিজ্য
ও বাণিজ্যপথের
সঙ্গে নানাভাবে
জড়িয়ে ছিল
তাম্রলিপ্ত বন্দর।
প্রথম শতকের
একটি পুঁথি
থেকে জানা
যায়, দক্ষিণ
ভারত ও
সিংহলের সঙ্গে
তাম্রলিপ্তের ঘনিষ্ঠ
বাণিজ্যিক সম্বন্ধ
ছিল। সপ্তম
শতকে অসংখ্য
চীন দেশীয়
বৌদ্ধ শ্রমণ
সিংহল থেকে
বাংলায় এবং
বাংলা থেকে
সিংহলে যাতায়াত
করেন। সিংহল
থেকে সমুদ্রপথ
ছিল মালয়,
নিম্ন ব্রহ্ম
সুবর্ণদ্বীপ, চম্পা,
কম্বেখা অবধি।
তাম্রলিপ্ত থেকে
চট্টগ্রাম, আরাকানের
কূল বরাবর
সুবর্ণদ্বীপ বা
নিম্ন ব্রহ্মদেশ
পর্যন্ত দ্বিতীয়
একটি সমুদ্রপথ
বিস্তৃত ছিল।
বাণিজ্য হতো
আরো একটি
পথে। তাম্রলিপ্ত
থেকে যাত্রা
করে জাহাজগুলো
সোজা এসে
ভিড়ত ওড়িশা
রাজ্যের বন্দরে।
সেখান থেকে
কোনাকুনি বঙ্গোপসাগর
পাড়ি দিয়ে
যেত মালয়,
যবদ্বীপ, সুমাত্রা
প্রভৃতি দ্বীপ-উপদ্বীপে। গঙ্গা-ভাগীরথীর
প্রবাহপথ বহুবার
বদল হয়েছে।
খুব প্রাচীন
যুগে পূর্ণিয়ার
দক্ষিণে রাজমহল
পার হয়ে
সাঁওতালভূমি, ছোট
নাগপুর, মানভূম
ধলভূমের কোল
ঘেঁষে গঙ্গা
সোজা দক্ষিণ
বাহিনী হয়ে
সাগরে পড়ত।
এই প্রবাহেই
ছিল অজয়,
দামোদর ও
রূপনারায়ণ নদীর
সঙ্গম। এ
প্রবাহের দক্ষিণ
কোণেই ছিল
তাম্রলিপ্ত বন্দর।
তরপর অষ্টম
শতকের আগেই
গঙ্গা পূর্ববর্তী
খাতের থেকে
সরে এসে
রাজমহল থেকে
মহানন্দা ও
কালিন্দীর খাতে
গৌড়কে ডানদিকে
রেখে দক্ষিণ
ও দক্ষিণ-পশ্চিমে
এসে পড়েছে
সমুদ্রে। তখনো
দামোদর ও
রূপনারায়ণের জল
এসে পড়ত
ভাগীরথীতে। তখনো
বেশ জমজমাট
ছিল তাম্রলিপ্ত
বন্দর। কিন্তু
তৃতীয় পর্যায়ে
কমতে লাগল
রূপনারায়ণের প্রবাহ,
ক্রমে ক্রমে
সোনালি দিনগুলো
ফিকে হয়ে
এল তাম্রলিপ্ত
বন্দরের। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ
রাজ্যের পূর্ব
মেদিনীপুর জেলায়
তমলুক মহকুমা
ও থানা
অঞ্চলে ভাগীরথী
ও রূপনারায়ণ
নদীর সঙ্গমস্থল
থেকে রূপনারায়ণ
নদী ধরে
একটু এগোলেই
ছিল অতীতের
তাম্রলিপ্ত বন্দর,
যার বর্তমান
নাম হয়েছে
তমলুক। অতীতের
বন্দরের কোনো
চিহ্ন এখানে
আর নেই।
কিন্তু সেই
সময়ের কিছু
মন্দির বা
স্থল অতীতের
কথা মনে
করিয়ে দেয়।
বন্দরের দিন
শেষ হয়ে
যাওয়ার পরেও
তমলুকের নানা
কার্যকলাপ বর্তমানকে
সমৃদ্ধ করেছে।
তমলুকের জিষ্ণুহরি
মন্দির পুরাকীর্তির
এক অন্যতম
নিদর্শন। মহাভারতে
আমরা তাম্রলিপ্তের
উল্লেখ দেখতে
পাই। তাম্রলিপ্ত
ছিল রাজা
তাম্রধ্বজ্যের রাজধানী।
অশ্বমেধযজ্ঞের সময়
পাণ্ডবদের অশ্ব
এই তাম্রধ্বজ
ধারণ করেন
এবং মহাবীর
অর্জুনের সঙ্গে
তার ভয়ানক
যুদ্ধ হয়।
তার বীরত্বে
প্রীত হয়ে
কৃষ্ণ ও
অর্জুন তার
সঙ্গে সখ্যসূত্রে
আবদ্ধ হন।
কৃষ্ণ ও
অর্জুনের যে
মূর্তি রাজা
প্রতিষ্ঠা করেন
তাই জিষ্ণুহরি
নামে পূজিত
হচ্ছে। মন্দিরের
পাশের বিজ্ঞপ্তি
থেকে জানা
যায় এটি
দ্বাপর যুগের
মন্দির। আসলে
দ্বাপর যুগের
মন্দির অনেক
আগেই রূপনারায়ণের
গর্ভে বিলীন
হয়ে গেছে।
প্রায় ৫০০
বছর আগে
এক গোপাঙ্গনা
বর্তমান মন্দিরটি
নির্মাণ করে
দেন। মন্দিরের
গর্ভগৃহে রয়েছে
দুটি প্রাচীন
মূর্তি। এ
মূর্তিদ্বয়ই জিষ্ণুনারায়ণ
নামে খ্যাত।
মূর্তি দুটি
অতি সুন্দর
ও দেখেই
মনে হয়
বেশ প্রাচীন।
আমরা সচরাচর
যে রকম
বিষ্ণুমূর্তি দেখি
এগুলো ঠিক
সে রকম
নয়, একটু
আলাদা ধরনের।
অন্য আরেকটি
প্রাচীন স্থান
হলো কপালমোচন
তীর্থ। ব্রহ্মপুরাণ
অনুযায়ী সতীর
দেহত্যাগের পর
ক্রুদ্ধ মহাদেব
প্রজাপতি দক্ষের
মস্তক ছিন্ন
করলেন। কিন্তু
ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপের
জন্য দক্ষের
মাথা মাটিতে
না পড়ে
শিবের হাতে
জুড়ে যায়।
মহাদেব মহা
মুশকিলে পড়ে
গেলে দেবতারা
নানা তীর্থ
ভ্রমণের পরামর্শ
দিলেন। শেষে
বিষ্ণু বললেন
ভারতবর্ষের পূর্বে
তমোলিপ্ত নামে
মহাপুরীতে স্নান
করলে মুক্তি
পাবেন। মহাদেব
তখন তাম্রলিপ্ত
এসে জিষ্ণুনারায়ণ
ও বর্গভীমা
মন্দিরের কাছের
জলাশয়ে স্নান
করে ওঠার
সঙ্গে সঙ্গেই
দক্ষের মাথা
তার হাত
থেকে খসে
পড়ল। তীর্থের
নাম হলো
কপালমোচন তীর্থ।
সেই সরোবর
হয়তো আর
নেই কিন্তু
বর্গভীমা মন্দির
থেকে কাছে
একটি বাঁধানো
ঘাটওয়ালা জলাশয়কে
মানুষ কপালমোচন
তীর্থ বলে
মনে করে। তমলুকে মন্দিররাজির
মধ্যে দেবী
বর্গভীমার মন্দিরটি
বেশ প্রাচীন।
এতটাই প্রাচীন
যে মার্কণ্ডেয়
পুরাণ, দেবী
পুরাণ ও
ব্রহ্ম পুরাণেও
এটির উল্লেখ
আছে। ১৪৬৬
খ্রিস্টাব্দে মুকুন্দরামের
লেখা চণ্ডীমঙ্গল
কাব্যেও ‘গোকুলে
গোমতী নামা
তাম্রলিপ্তে বর্গভীমা’র
উল্লেখ রয়েছে।
দেবী বর্গভীমাকে
তাম্রলিপ্তের অধিষ্ঠাত্রী
দেবী হিসেবে
মান্যতা দেয়া
হয়। তমলুকের
মূল রাস্তার
পাশে নদী
থেকে প্রায়
৩০ ফুট
উঁচু ভিত্তিভূমির
ওপর দেবীর
মন্দির। স্তূপ
আকৃতির এ
জায়গায় ২৬টি
সিঁড়ি অতিক্রম
করে মূল
মন্দিরে যেতে
হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহে
অধিষ্ঠিতা দেবীর
মূর্তি এক
শিলাপাথরের। পাথরের
সামনের দিকে
দেবীর মূর্তি
খোদিত। দেবী
চতুর্ভুজা, দক্ষিণ
হস্তদ্বয়ে খড়্গ
ও ত্রিশূল
আর বাম
হস্তে খর্পর
ও নরমুণ্ড।
দেবী ভক্তদের
ধর্ম, অর্থ
কাম, মোক্ষ
এই চতুর্বর্গ
দান করেন
বলে দেবীর
নাম বর্গভীমা।
মূর্তিটি অসাধারণ,
চোখ ফেরানো
যায় না।
পাথরের পেছনে
রয়েছে দেবীর
গুহ্য শিলামূর্তি।
শিবজায়া সতীর
বিষ্ণুচক্রে খণ্ড-বিখণ্ড
দেহের বাম
গোড়ালি এখানে
পড়ে ছিল।
সেই কারণে
এটি একান্ন
পীঠের অন্যতম।
তন্ত্রশাস্ত্রে উল্লেখ
আছে, কপালিনী
ভীমারূপা বামগুলফো
বিভাষীকে। এই
বিভাষকই হচ্ছে
প্রাচীন তাম্রলিপ্ত
বন্দর। এটি
তাই বিভাষ
তীর্থ। বহু ঐতিহাসিকদের
মতে, দেবী
সমুদ্র, নদ-নদীর
উপকূলবর্তী কোনো
আদিম জনগোষ্ঠীর
আরাধ্য দেবী
থেকে বৌদ্ধ
যুগে উগ্রতারায়
পরিণত হয়েছেন
এবং অবশেষে
হিন্দু রূপ
ধারণ করেছেন।
অশোকের সময়ের,
ফা-হিয়েন
ও হিউয়েন
সাঙয়ের দেখা
অশোক পিলার,
বৌদ্ধ স্তূপ
বা বৌদ্ধবিহারের
কোনো চিহ্নই
আজ আর
নেই। কিন্তু
অনেকে মনে
করেন সম্রাট
অশোক তাম্রলিপ্তে
যে স্তূপ
নির্মাণ করেছিলেন
পরবর্তীকালে সেই
স্তূপের ওপর
মন্দিরটি নির্মিত
হয়। প্রায়
১০০ বছর
আগে ত্রৈলোক্যনাথ
রক্ষিতের ‘তমলুকের
ইতিহাস’ বই
থেকে কিছুটা
অংশ তুলে
দেয়া হলো
যাতে ব্যাপারটি
আরো পরিষ্কার
হয়—‘ইহার
বাহিরের গঠন
প্রণালী উড়িষ্যাঞ্চলের
মন্দিরের ন্যায়
হইলেও ভিতরের
গঠন বৌদ্ধবিহারের
সদৃশ এবং
অবিকল বুদ্ধগয়ার
মন্দিরের অনুরূপ।
প্রবেশদ্বারের সম্মুখে
প্রধান বা
মূল বিহারের
অনুকরণে একটি
ক্ষুদ্র বিহার
রহিয়াছে। তদ্দৃষ্টে
অনুমান হয়
ওইরূপ ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র বিহার
অন্যান্য দিকেও
ছিল যাহাতে
ভিক্ষুগণ একা
একা নির্জনে
উপাসনা করিতেন
এবং সম্ভবত
প্রধান বিহারে
শিষ্যগণকে ভগবান
বুদ্ধদেবের মুখে
পদ্মবিনিঃসৃত (সর্ব-ধর্ম-সার)
উপদেশ প্রদান
করতেন। পরে
হিন্দুগণ অধিকার
করিয়া পূর্বদিকের
প্রধান দ্বারসহ
পার্শ্বের অন্যান্য
ক্ষুদ্র বিহার
ভগ্ন করিয়া
মধ্যের মূল
বিহার ও
পশ্চিম দিকের
ক্ষুদ্র বিহারে
উপর পশ্চিমদ্বারী
করিয়া এক
মন্দিররূপে নির্মাণ
করিয়াছেন। ইহা
একটি উচ্চ
বেদির উপর
সংস্থিত এবং
উক্ত বেদির
উপরেও মন্দিরটি
৫০ ফুট
উচ্চ দেখিতে
পাওয়া যায়।’
ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিত
১০০ বছর
আগে যা
অনুমান করেছিলেন
বর্তমান গবেষকরা
তা যথার্থই
বলে মনে
করেন। তমলুকের রাজবাড়ি
বহু পুরনো।
সর্বপ্রথম রাজা
হিসেবে ময়ূরধ্বজের
নাম পাওয়া
যায়। বর্তমানে
ভাঙা, পরিত্যক্ত
অবস্থায় বটগাছের
বড় বড়
ঝুরি নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে।
রাজবাড়ির মধ্যে
রয়েছে রাবণমাধব
ও রাধারমণ
মন্দির। গৌরাঙ্গ
মহাপ্রভুর সহচর
ছিলেন বাসুদের
ঘোষ। চৈতন্যদের
অন্তর্ধানের পর
বাসুদেব শোকে
ঘুরতে ঘুরতে
তাম্রলিপ্তে এসে
মহাপ্রভুর মূর্তি
নির্মাণ করে
মন্দির বানান।
তাম্রলিপ্ত সংগ্রহমালা
ও গবেষণা
কেন্দ্রটি একটি
উল্লেখযোগ্য স্থান।
তাম্রলিপ্ত থেকে
পাওয়া পুরাবস্তু
দিয়ে তৈরি
হয়েছে মিউজিয়াম। তাম্রলিপ্তের দৃষ্টান্তমূলক
ভূমিকা ছিল
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা
আন্দোলনে। ১৯৩০
খ্রিস্টাব্দে তমলুকে
লবণ আইন
অমান্য আন্দোলন
বেশ জোরদার
হয়েছিল। এখানে
বেআইনি ৯টি
লবণ কেন্দ্র
খোলা হয়েছিল।
বহু মহিলা
লবণ সত্যাগ্রহে
অংশগ্রহণ করেছিলেন
এবং কারাদণ্ডপ্রাপ্ত
হয়েছিলেন। জনসাধারণের
প্রতিরোধ ভাঙতে
এ সময়
ভোলায় ৩৯
জন পুলিশের
গুলিতে মৃত্যুবরণ
করেন। ১৯৪২
সালে ভারত
ছাড় আন্দোলনের
বড় আন্দোলন
হয়েছিল তাম্রলিপ্তে।
২৯ সেপ্টেম্বর
তমলুক থানা
আক্রমণের সময়
পুলিশের গুলিতে
৭৩ বছরের
মাতঙ্গিনী হাজরাসহ
১০ জনের
মৃত্যু হয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
ঘটনা ছিল
‘তাম্রলিপ্ত
জাতীয় সরবরাহ’
গঠন। এ
সরকারের সর্বাধিনায়ক
ছিলেন সতীশচন্দ্র
সামন্ত, অর্থসচিব
অজয় কুমার
মুখোপাধ্যায় এবং
সমর ও
স্বরাষ্ট্র সচিব
ছিলেন সুশীল
কুমার ধাড়া।
এই সরকার
১৯৪২-এর
১৭ ডিসেম্বর
থেকে ১৯৪৪-এর
১ সেপ্টেম্বর
পর্যন্ত তাম্রলিপ্তকে
স্বাধীন করে
রেখেছিল ইংরেজদের
থেকে। গান্ধীজির
নির্দেশে তারা
১৯৪৪-এর
১ সেপ্টেম্বর
আত্মসমর্পণ করেন।
প্রাচীনকাল থেকে
সাম্প্রতিক কাল
পর্যন্ত তাম্রলিপ্ত
বা তমলুক
বাংলার ইতিহাসে
এক উজ্জ্বল
ঘটনার সাক্ষী
হয়ে আছে।
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য: ইতিহাসের শিক্ষক, ভ্রামণিক ও লেখক