বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট দৈনন্দিন
জীবনের একটি মৌলিক চাহিদায়
পরিণত হয়েছে। নিত্যদিনের
যোগাযোগ, তথ্য জানা ও
আদান-প্রদান করা, বৈদ্যুতিক মিটার
রিচার্জ করা, মোবাইল আর্থিক
সেবা গ্রহণ, ব্যাংকিং, বিভিন্ন এয়ারলাইনসে
বিমানের সিট বুকিং, বিমানবন্দরে লাগেজ
ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি প্রয়োজনীয় নানা
পরিষেবা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে
পরিচালিত হয়। ব্যবসার
ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক যোগাযোগ, আর্থিক
লেনদেন, ই-বাণিজ্য, (ফেসবুক
ও সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর)
এফ-বাণিজ্য এবং
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে
দরকারি যোগাযোগ, সাপ্লাই
চেইন তদারকি, আমদানি-রফতানির
হালনাগাদ খবর ইন্টারনেট পরিষেবার
ওপর নির্ভশীল। কোনো
কারণে ইন্টারনেট বন্ধ
থাকলে ব্যক্তিগত কাজ
বা সাংসারিক কাজ বাধাগ্রস্ত
হওয়ার কারণে যেমন জনজীবনে
ভোগান্তি তৈরি হয়।
সেই সঙ্গে ব্যবসায়িক ও
প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি
হওয়ার কারণে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক
ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। একজন মুমূর্ষু রোগীর
অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেয়া
হলে তার যে অবস্থা
হতে পারে, বর্তমান সময়ে
ইন্টারনেট বন্ধ হলে আমাদের
ব্যক্তিগত, সামাজিক, ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক অবস্থা
সে রকম বেগতিক দশার মধ্যে
পড়ে যায়।
ইন্টারনেট বহুবিধ প্রযুক্তি, বহুমাত্রিক চিন্তাধারা
এবং বিপুল সম্পদের সমন্বয়ে
গড়ে ওঠা অসংখ্য নেটওয়ার্কের
একটি সামষ্টিক সর্বজনীন নেটওয়ার্ক। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট তথ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে
রাষ্ট্র, ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত, সুশীল সমাজ
এবং অসংখ্য ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ
অবদান এবং ভূমিকা রয়েছে। ইন্টারনেট সারা পৃথিবীর
মানুষের সর্বজনীন একটি সম্পদ, যা
বিভিন্ন দিক দিয়ে আমাদের
জীবন অনেকভাবে সমৃদ্ধ এবং
সহজতর করে তুলেছে।
ইন্টারনেট পরিষেবা প্রচলিত যোগাযোগ
ও সম্প্রচার, যেমন টেলিফোন, প্রচারমাধ্যম,
ই-মেইল
ইত্যাদির সম্মিলিত সুবিধা গ্রাহকের
হাতের নাগালে এনে দিয়েছে। এভাবে ইন্টারনেট এখন
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য
অংশ হয়ে উঠেছে।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার পাশাপাশি
ইন্টারনেট পরিষেবা এখন মানুষের
দৈনন্দিন একটি মৌলিক চাহিদা।
সম্প্রতি ইন্টারনেট বন্ধের
নেতিবাচক ফলাফল আমরা ভোগ
করেছি। বিগত সরকার
বলপ্রয়োগ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র
আন্দোলন দমন করতে উদ্যত
হলে,
তৎপ্রেক্ষিতে সংঘটিত হতাহতের ঘটনার
তীব্র প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার
প্রবল বিক্ষোভ ঠেকানোর কৌশল
হিসেবে গত ১৭ জুলাই
রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট
এবং পরের দিন ১৮
জুলাই রাত থেকে ব্রডব্যান্ড
ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া
হয়। পাঁচদিন পর
২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং
১০ দিন পর ২৮
জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট সচল
করা হয়। জনপ্রিয়
অ্যাপ যেমন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব আরো
তিনদিন পর্যন্ত বন্ধ রাখা
হয়। সে সময় সরকারি
দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন ইন্টারনেট
পরিষেবা বিচ্ছিন্ন করার
নির্দেশ দেয়ার কথা জনগণের
সামনে স্বীকার করেনি।
বরং ডাটা সেন্টারে আগুন
লেগে ইন্টারনেট অবকাঠামো
ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ মানুষকে বোকা
বানানোর মতো নানা অজুহাত
সামনে তুলে ধরা হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে
এ ধরনের অবান্তর অজুহাত
দেখিয়ে মানুষের ওপর যথেচ্ছা
দমনপীড়ন করা অত সহজ
নয়।
ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকায়
মানুষ ব্যাপক দুর্ভোগের মুখে
পড়ে। ব্যাংক লেনদেন
বন্ধ থাকার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের
ক্ষতি হয়। আন্তর্জাতিক
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার
ফলে আমদানি-রফতানিসহ আন্তর্জাতিক
বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়। সার্বিকভাবে পাঁচ-দশদিন ইন্টারনেট
বন্ধ থাকার ফলে অর্থনীতির
ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, শুধু তা-ই
নয়,
আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি
ক্ষুণ্ন হয়েছে, যা কখনই
প্রত্যাশিত হতে পারে না।
ইন্টারনেট
শাসন-নীতি ও মানবাধিকার: প্রয়োজন অনুযায়ী যোগাযোগ
করা এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার অভিন্ন
বিশ্বব্যাপী মাধ্যম ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ, অংশগ্রহণমূলক জনসংযোগ, সংগঠিত হওয়ার গণতান্ত্রিক চর্চা এবং মতামত
গঠন ও প্রকাশ করার মৌলিক অধিকার অতি সহজে কার্যকর করা যায়। আন্দোলনরত ছাত্রদের ন্যায্য দাবি দমনপীড়নের
মাধ্যমে বন্ধ করতে চেয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরমতম দৃষ্টান্ত তৈরি করে
বিগত সরকার।
ইন্টারনেট
শাসন-নীতি সম্পর্কিত মানবাধিকার
সুরক্ষার অঙ্গীকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর
প্রস্তাবগুলো উল্লেখ করা যায়। ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফর্মেশন সোসাইটির (ওয়াইসিস) দ্বিতীয়
সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, জনগণকেন্দ্রিক
উন্নয়নমুখী অন্তর্ভুক্তিমূলক তথ্য-সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রত্যাশা পুনরায় ব্যক্ত
করা যাচ্ছে যে, জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং বহুপক্ষীয় সমঝোতার আলোকে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সর্বত্র জনগণের তথ্য ও জ্ঞান উৎপাদন, আদান-প্রদান, গ্রহণ এবং ব্যবহার করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তাদের আত্মবিকাশের সমূহ সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা (ইউএনএইচআরসি) কর্তৃক ২০১২ সালে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘অফলাইনে মানুষের যেসব অধিকার রয়েছে, অনলাইনেও সেগুলো সুরক্ষা, বিশেষত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনিসেফ) ডিজিটাল প্লাটফর্ম পরিচালনা নির্দেশিকায় (গাইডলাইনস ফর দ্য গভার্ন্যান্স অব ডিজিটাল প্লাটফরমস) উল্লেখ করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী মানবাধিকারের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং মানবাধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব; রাষ্ট্রের পক্ষ হতে ডিজিটাল প্লাটফর্ম-সংশ্লিষ্ট অনিয়ম এবং/অথবা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার আইন অনুযায়ী বিধিমালা গ্রহণ করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে বিধিবহির্ভূত
ও সামঞ্জস্যহীন
শাসন-নীতি বর্জন করতে হবে।
বিভিন্ন
আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব দেশে গণতন্ত্র সুসংহত নয় অথবা আইনের শাসন যথাযথ নিশ্চিত নয়, সেই সব দেশের সরকার নিজেদের সুবিধা অনুসারে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। সরকার ইন্টারনেট পরিষেবা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে জনগণের তথ্য জানা ও মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করে এবং জনগণের ওপর দমনপীড়ন চালানোর রাস্তা তৈরি করে।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বিধি: ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনেক
আগে থেকেই নানা ধরনের উদ্যোগ
এবং আইনি কাঠামো প্রণয়নের
পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতিসংঘের
বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থার
তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৯২
দেশের মধ্যে অন্তত ১৩৭টি
দেশে ব্যক্তিগত তথ্য
সুরক্ষা বা তথ্যের গোপনীয়তা
সম্পর্কিত দেশীয় আইন প্রণীত
হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০২৩ সালের নভেম্বরে
মন্ত্রিপরিষদের একটি বৈঠকে প্রস্তাবিত ‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন
২০২৩’ নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। ব্যক্তিগত
উপাত্ত সুরক্ষা আইনের ধারা ১০(২)(ঘ)
অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষা বা কোনো অপরাধ প্রতিরোধ, শনাক্ত
ও তদন্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ
সংস্থা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের নিকট হতে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত
পদ্ধতিতে, প্রয়োজনীয় কোনো ব্যক্তিগত উপাত্ত সংগ্রহ করা যাবে।
ওই আইনের খসড়া প্রস্তুত করার
সময় থেকে বিভিন্ন অংশীজন ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সংশয় প্রকাশ করে বলা হয়, বিনা
তদারকিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে ব্যক্তিগত উপাত্ত সংগ্রহ করার বিধি আইনের
অন্তর্ভুক্ত রাখা হলে ওই আইন অপব্যবহারের সম্ভাবনা থেকে যায়। আইনজ্ঞ, সুশীল
সমাজ এবং অংশীজনদের মতে,
যেকোনো ব্যক্তিগত উপাত্ত সংগ্রহবিষয়ক অনুরোধের সঙ্গে
নির্দিষ্ট কোন প্রকার এবং কত সময়ব্যাপী উপাত্ত সংগ্রহ করা যাবে, কী
কাজে তা ব্যবহৃত হতে পারবে,
অন্য কোনো পক্ষের কাছে তা প্রকাশযোগ্য কিনা, কত
মেয়াদকালের জন্য তা ধারণ করা যাবে এবং উপাত্তধারীর অধিকারের বিষয়গুলো আইনে স্পষ্ট
করা অতীব জরুরি।
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে
জনস্বার্থের বিষয় বিবেচনায় রেখে মানবাধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ
দায়িত্ব। অনুরূপভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জনগণের
মৌলিক অধিকার খর্ব
হওয়ার মতো ঘটনা আমাদের দেশে আর কখনো যেন ঘটতে না পারে সে বিষয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং
সোচ্চার থাকা সব অংশীজন,
সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং ব্যক্তির একান্ত
দায়িত্ব।
টিআইএম নূরুল কবির: ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং
প্রযুক্তি বিশ্লেষক