এডিপির অননুমোদিত ৯২৪ প্রকল্প ছিল সন্দেহজনক

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। মধ্যমেয়াদি বাজেটের সিলিং বা সীমা অতিক্রম করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা ছিল নিয়মিত ঘটনা। এ সময় শুধু রাজনৈতিক বিবেচনা ও ঠিকাদারের স্বার্থে প্রকল্প নেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগও রয়েছে। চলতি অর্থবছরের উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) চলমান প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৩২৬টি। এছাড়া সরকারি অর্থায়নে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে আরো ৯২৪টি, সংখ্যার বিচারে যা চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

অননুমোদিত এসব প্রকল্পের পেছনে প্রাথমিকভাবে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকার মতো। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের অনেক জায়গা রয়েছে। এর অনেকগুলোই তালিকায় যুক্ত হয়েছে যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়া। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং চাপের মুখে যুক্ত হয়েছে অনেক প্রকল্প। অতীতেও এ ধরনের প্রকল্পে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। আবার নানা জটিলতায় তিন বছরের প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৫ বছর লেগে যাওয়ারও নজির রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত অননুমোদিত প্রকল্পগুলো নতুন করে যাচাই করে দ্রুত একটি সিদ্ধান্তে আসা। প্রকল্পগুলোর আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, সেটিও পরখ করে দেখা জরুরি। 

বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন মেগা প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। এডিপিতে এতসংখ্যক প্রকল্প তালিকাভুক্তির বিষয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি ও লুটপাট করার জন্যই এগুলোকে যুক্ত করা হয়েছে। আদৌ প্রকল্পগুলোর প্রয়োজন আছে কিন সেটা বর্তমান সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে।’

পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক অর্থায়নের মাধ্যমে অননুমোদিত নতুন প্রকল্প রয়েছে ২৫৯টি। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য রয়েছে ৪৭টি প্রকল্প। আর সরকারি অর্থায়নে অনুমোদনের জন্য ৯২৪টি রয়েছে, যার জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অননুমোদিত প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ২৩০। নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এসব প্রকল্পের তালিকা করা হয়েছে। তবে অননুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে উচ্চ অগ্রাধিকারের সংখ্যাই বেশি। 

এডিপির অননুমোদিত প্রকল্প তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এতে বিগত সময়ের মতো যোগাযোগ পরিবহন ও অবকাঠামো খাতের প্রকল্পই বেশি। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ঢাকায় ছয়টিসহ বিভিন্ন জেলায় ১২টি পৃথক ফ্ল্যাট নির্মাণের প্রকল্প রয়েছে। ১৪টি প্রকল্প রয়েছে বিভিন্ন সার্কিট হাউজ নির্মাণের জন্য। তাছাড়া শিক্ষা খাতেও অধিকাংশ প্রকল্প নেয়া হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপিতে অননুমোদিত প্রকল্প ছিল ৮২৯টি। আগের অর্থবছরে ছিল ৬৩৩টি প্রকল্প। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৬০৩। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২৪টিতে।   

অনুমোদনহীন এসব প্রকল্প আগে যাচাই-বাছাই করা জরুরি বলে মনে করছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চলমান প্রকল্প নিয়ে এরই মধ্যে যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্পের বিষয়ে নতুন করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে।’

চলতি বছরের এডিপিতেও সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। তার পরই রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। এ দুই খাত মিলিয়ে এডিপির ৪০ শতাংশের বেশি বরাদ্দ। বিগত সরকারের আমলে অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া হলেও বর্তমান সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেবে বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের দিকেও বিশেষ নজর দেয়ার কথা বলেছেন সরকারের উপদেষ্টারা।

যথাযথ যাচাই-বাছাই না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় অধিকাংশ প্রকল্প তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এ অধ্যাপক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুর্নীতির উদ্দেশ্য সামনে রেখে অতিরিক্ত প্রকল্প তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যা এডিপিতে বোঝা তৈরি করছে। নতুন করে এসব তালিকা যাচাই করে দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিত।’

সরকার মধ্যমেয়াদি বাজেট ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে তিন বছরের জন্য প্রতিটি সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প গ্রহণের আর্থিক একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়। মূলত আর্থিক সংস্থানের বিপরীতে প্রকল্প গ্রহণের সক্ষমতার মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষায় এ নীতি গ্রহণ করেছিল সরকার। কিন্তু প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বেঁধে দেয়া এ সীমা অতিক্রম করতে দেখা যায় প্রায় মন্ত্রণালয়কেই।

মধ্যমেয়াদি বাজেটে সীমা মানা না হলে সব প্রকল্পের জন্যই বরাদ্দ ঘাটতি তৈরি হয় বলে জানান সাবেক পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সীমার অতিরিক্ত প্রকল্প গ্রহণ করা হলে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ যায়। সেক্ষেত্রে ওই মন্ত্রণালয়ের সব প্রকল্পে বরাদ্দ দিতে হয় কম।’  

গত অর্থবছরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও প্রক্রিয়াধীন প্রকল্পের বিপরীতে মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন ছিল মন্ত্রণালয়টির। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়।

আর্থিক সংস্থানের ভিত্তিতে দেশে প্রকল্প নেয়া হয় না বলে অভিযোগ করে সাবেক সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জোর করে তদবিরের মাধ্যমে প্রকল্পের নাম তালিকায় যুক্ত করা হয়। ফলে অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে তিন বছরের প্রকল্প শেষ করতে ১৫ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। এতে এসব প্রকল্প জাতির তেমন কোনো সুফল বয়ে আনে না।’ 

তিনি বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালকের গাড়ি কেনার মাধ্যমে একটি প্রকল্প শুরু হয়। দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে মাত্র ৫ লাখ টাকা নামমাত্র বরাদ্দ দিয়েও কাজ শুরু করে দেয়া হয়। পরে এসব প্রকল্প বছরের পর বছর টেনে নিতে হয়। এটা আমাদের কাঠামোগত সমস্যা। এটা এখন দূর করা প্রয়োজন।’

সিপিডির তথ্যমতে, চলমান প্রকল্পের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮টির বয়স পাঁচ বছরের বেশি। ৬-১০ বছর ধরে চলা প্রকল্পের সংখ্যা ৩৫৭। আর ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান প্রকল্প ৩৬টি। আর চলতি অর্থবছরে সময় বাড়ানো হয় ৫১৮টি প্রকল্পের। গত অর্থবছরে বাড়ানো হয়েছিল ৪২৯টির সময়। অর্থাৎ প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির প্রবণতাও আগের চেয়ে বাড়ছে। 

সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম একনেক সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন