বীমা খাত ডিজিটালাইজেশনে আগ্রহ বাড়ছে গ্রাহকের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

ধুঁকতে থাকা বীমা খাতে আগ্রহ বাড়িয়েছে ডিজিটালাইজেশন। গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষায় জাতীয় বীমা নীতি ২০১৪-তে উল্লেখিত ‘ইলেকট্রনিক ডাটা ও তথ্যের বিনিময় চালুকরণ’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৯ সালে ইউনিফায়েড মেসেজিং প্লাটফর্মের (ইউএমপি) যাত্রা শুরু হয়, যা বর্তমানে বীমা খাতের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে এবং এর সুফল সর্বস্তরে প্রতিফলিত হচ্ছে। ইউএমপির মাধ্যমে প্রতিটি বীমা প্রতিষ্ঠানের বাস্তবিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল পলিসি রিপোজিটরি বা সেন্ট্রাল সিস্টেম গড়ে তোলা হয়। এতে তথ্যের সরবরাহ দ্রুত ও সহজ হওয়ায় প্রক্রিয়াগত কারণে গ্রাহক হয়রানি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অটোমেশন, প্রযুক্তিগত অবকাঠামো, স্বচ্ছ জবাবদিহিতা ও গ্রাহক পর্যায়ে বীমাকারী ও কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ না থাকায় গ্রাহককে প্রায়ই ভোগান্তিতে পড়তে হতো। লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি কর্তৃক শত কোটি টাকার বীমা দাবি পরিশোধ না করার প্রমাণও উঠে এসেছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।

আশার কথা বীমা খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম (ইউএমপি)। গ্রাহকের পরিচয় যাচাই, জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লেখিত নাম, ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য সঠিকভাবে পলিসি ডকুমেন্টে আনা ও বীমা গ্রাহককে ট্র্যাক করতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এপিআই কানেক্টিভিটি স্থাপন করে ই-কেওয়াইসি সেবা চালু করা হয়েছে। ফলে গ্রাহক যাচাইসহ মেয়াদান্তে বীমা দাবি পরিশোধে হয়রানি ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। 

গ্রাহক কর্তৃক জমাকৃত প্রিমিয়ামের বিপরীতে ইউএমপি থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ই-রিসিপ্ট প্রস্তুত হচ্ছে এবং তা গ্রাহক পর্যায়ে ডিজিটালি সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া ডাক ও কুরিয়ার বাবদ বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর পলিসিপ্রতি কমপক্ষে ২০ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। একই সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে গ্রাহক তার কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন।

টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ আলমগীর রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। জীবন বীমার একটি পলিসি নিয়েছেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমার বীমার সব কার্যক্রম মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে করি। সব কিছুই সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই অ্যাপসে। যেকোনো তথ্য, টাকা জমা দেয়া ও রিসিটও অনলাইনে পেয়ে যাই। কখন বীমার টাকা জমা দিলাম, কয়টা কিস্তি জমা দিলাম সব অ্যাপের মাধ্যমে দেখা যায়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা জমা দেয়ার সুবিধা থাকায় অন্য কোথাও যেতে হয় না। আবার কোম্পানির লোকেরা এসে আমাকে খুঁজতেও হয় না। ফোনে যোগাযোগ হয় আর অ্যাপসে লেনদেন হয়।’

বীমা খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে রুগ্‌ণ ও অবিকশিত বীমাশিল্পের সংস্কারে প্রয়োজন উদ্ভাবনী বীমা পণ্য এবং বিক্রয় মাধ্যমের আধুনিকায়ন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জন্মের পর পরই একটি শিশু বীমার আওতায় থেকেই আসতে পারে। এছাড়া বীমা খাত আধুনিকায়নের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার কমানো সম্ভব, বাড়ানো সম্ভব স্বাস্থ্যসেবার মান। তবে করপোরেট সুশাসনের অভাব, অদক্ষ ও অপর্যাপ্ত মানবসম্পদ, বীমা পণ্য প্রণয়ন ও বিপণন, সম্পদ ও দায়ের ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে পর্যায়ক্রমে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে বিদ্যমান প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার। বাংলাদেশ দেরিতে হলেও এ পথে যাত্রা শুরু করেছে। এ খাতে ইউএমপির মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বীমা খাতকে দ্রুত এগিয়ে নেয়া।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন আহমেদ পাভেল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বীমাখাতের ডিজিটালাইজেশন এখনো গ্রাহক পর্যায়ে রয়েছে, যা বীমা কোম্পানিগুলোর সব স্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পেপারলেস করার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহক তার পলিসির লেনদেন করতে পারছে, যা এ খাতকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। তবে পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশনের মধ্যে আসতে আরো এক বছরের মতো লাগতে পারে।’

জানা যায়, বর্তমানে বীমা গ্রাহক তার পলিসির বিপরীতে প্রিমিয়াম জমা প্রদানের পর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে এসএমএস ও ই-মেইলের মাধ্যমে জমাসংক্রান্ত তথ্য সহজেই জানতে পারছে। এছাড়া রিমাইন্ডার এসএমএসের মাধ্যমে প্রিমিয়াম জমাদানের পরবর্তী তারিখ জানিয়ে দেয়া হয়।

ইউএমপির মাধ্যমে পরিচালিত ডিজিটাল সার্ভিসগুলো বাস্তবায়নের ফলে বীমা খাতে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ডিজিটাল কার্যক্রমের ফলে এ খাতে অনৈতিক অর্থ পাচার রোধ পেয়েছে। ফলে একটি মহল ক্রমাগত এ ডিজিটাল কার্যক্রমকে ব্যাহত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। অন্তত ১০টি ডিজিটাল সার্ভিস সমৃদ্ধ প্লাটফর্মকে শুধু এসএমএস সার্ভিস হিসেবে অপপ্রচারের মাধ্যমে সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে আসছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কিছু বীমা প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ইউএমপিতে বীমা গ্রাহকের পলিসি ও বীমা দাবিসংক্রান্ত তথ্য প্রেরণ বন্ধ রেখেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা খাতের উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো অব্যাহত রাখতে খাতসংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। পুঁজিবাজারের বিও একাউন্টের ন্যায় বীমা খাতে ইউনিক ইন্স্যুরেন্স অ্যাকাউন্ট চালু করা এখন সময়ের দাবি। সব বীমা প্রতিষ্ঠান হতে সঠিক সময়ে নির্ভুল তথ্য জোগানের মাধ্যমেই তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন