লক্ষ্মীপুরে এখনো পানিবন্দি সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ

পাঠদান শুরু করা যায়নি বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

রাকিব হোসাইন রনি, লক্ষ্মীপুর

তাসলিমা বেগমের ঘরে হাঁটু পানি। নেই রান্নার ব্যবস্থা। স্বামীর অসুস্থতার কারণে উপার্জনও বন্ধ। তিন সন্তান নিয়ে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা গ্রামের এ নারীর জীবন কাটছে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে প্রায় দেড় মাস আগে লক্ষ্মীপুরে বন্যা দেখা দেয়। এখনো জেলার পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ বাসিন্দা বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কারণ হিসেবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, বন্যার পানি ভুলুয়া নদীসহ খাল ও নালা দিয়ে নিষ্কাশন হতো। তবে খাল দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার ও দখলমুক্ত না করায় পানি নামতে পারছে না। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতিও হচ্ছে না। এখনো সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি রয়েছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ। কিছু স্থানে ঘরবাড়ি তলিয়ে থাকায় অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে পারেনি। এ অবস্থায় বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরু করা যায়নি।

রামগতি-কমলনগর নদীভাঙন প্রতিরোধ আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পলোয়ান জানান, ভুলুয়া নদীসহ অধিকাংশ খাল ও নালা দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার ও দখলমুক্ত না করায় পানি নামতে পারছে না। ফলে বন্যা দীর্ঘ স্থায়ী হচ্ছে। ভুলুয়া নদীসহ জেলার খালগুলো দখলমুক্ত করতে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনকে নদী ও খালগুলো দখলমুক্ত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

এদিকে গত রোববার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি চালুর উদ্যোগ নেয় শিক্ষা অধিদপ্তর। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়া মানুষ এখনো বাড়ি ফিরতে পারেনি। অধিকাংশ রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়ের মাঠ পানির নিচে তলিয়ে থাকায় পাঠদান করা সম্ভব হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে ৭৩২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি বিদ্যালয় এখনো পানিবন্দি। ৮৯টিতে বন্যাকবলিত মানুষ বসবাস করছে। বিদ্যালয়ের মাঠ, শ্রেণীকক্ষ, পার্শ্ববর্তী রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে থাকায় জেলার অর্ধেকেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু করা যায়নি। কবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি চালু করা যাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ মজুমদার।

লক্ষ্মীপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ইউনূস মিয়া জানান, বন্যার পানি কমলেও পরবর্তী বৃষ্টিপাতের কারণে পানি আবার বেড়েছে। বর্তমানে ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ পানিবন্দি জীবন যাপন করছে। এখনো ৫ হাজার ৩০০ মানুষ অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাস করছে। আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাসকারীদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা দেয়া হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, সদর উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও কমলনগর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মানুষ এখনো পানিবন্দি। পানি ধীরে নামার কারণে বন্যা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মনোহরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া মোহাম্মদ আলী আকবর জানান, তিনি পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। তবে শুক্র ও শনিবারের বৃষ্টিতে আবারো তার ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। পরে তিনি আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তার মতো আরো কয়েকজন আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে এসেছে।

তিন সন্তান নিয়ে জীর্ণ ঘরে পানিবন্দি জীবন যাপন করছেন কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের চরকাদিরা গ্রামের তাসলিমা বেগম। ঘরের ভেতর হাঁটুসমান পানি। ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে ঘরের জিনিসপত্র। নেই রান্না করার ব্যবস্থা।

তাসলিমা বেগম বলেন, ‘১৮ দিন ফজুমিয়ার হাট কেএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিলাম। সেখান থেকে আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন তিন সন্তান নিয়ে কোথায় যাব, কী করে থাকব, কেউ কি আছে আমাকে একটি ঘর সাহায্য করবে? আমার স্বামী অসুস্থতার কারণে কোনো কাজ করতে পারছেন না। তিন সন্তান নিয়ে বড়ই কষ্টে আছি। দেখার মতো কেউ নেই। কোনো জনপ্রতিনিধি বিগত দিনে সাহায্য-সহযোগিতা করেননি।’

সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের পাঁচপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. হাফিজ জানান, দেড় মাস ধরে তিনি পরিবার নিয়ে পানিবন্দি। ঘরের জিনিসপত্র চুরির ভয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারেননি। সাত সদস্যের পরিবার তার। অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের। একসময় তিনি মাছের ব্যবসা করলেও দেড় মাস ধরে বেকার। তার মতো একই অবস্থা প্রতিবেশী অনেকেরই।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেলায় এখনো ৩০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দি। মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষতির প্রতিবেদন চেয়েছে। এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। পানিবন্দিদের ত্রাণসহ বিভিন্ন সহায়তায় মাঠ পর্যায়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন