পিত্তথলির রোগ

সচেতনতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় পিত্তথলির রোগ এড়ানো সম্ভব

ডা. এমএম মাহবুবুর রহমান

ছবি : বণিক বার্তা

পিত্তথলি (গল ব্লাডার) হচ্ছে ছোট নাশপাতি আকৃতির, গাঢ় সবুজ বর্ণের অঙ্গ, যা লিভারের নিচে থাকে। এর প্রধান কাজ হলো লিভার থেকে নিঃসৃত পিত্তরস সঞ্চয় ও ঘন করা, যা চর্বি হজমে সাহায্য করে।

পিত্তথলির রোগ

পিত্তথলির প্রদাহ

পিত্তথলির প্রদাহের মূল কারণ পিত্তথলির পাথর। তবে পাথর ছাড়াও প্রদাহ হতে পারে।

পিত্তথলির পাথর

পিত্তথলির পাথর আমাদের দেশে অন্যতম একটি রোগ। 

পিত্তনালির সংক্রমণ

ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ পিত্তথলির প্রদাহের কারণ হতে পারে। এ সংক্রমণ পাথর থেকে কিংবা সরাসরি ঘটতে পারে।

ক্যান্সার

পিত্তথলিতে ক্যান্সারও হতে পারে। তবে এ ক্যান্সারের ঘটনা খুবই বিরল।

পাথরবিহীন প্রদাহ

মাঝে মাঝে পাথর ছাড়াও প্রদাহ হতে পারে। সাধারণত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের মধ্যে এমনটা দেখা যায়।

পিত্তথলির পাথরের কারণ: পিত্তথলিতে পাথর নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। সাধারণত একেকটি পিত্তথলির পাথর বালুকণা থেকে শুরু করে টেবিল টেনিস বলের আকৃতির হতে পারে।

ঝুঁকি বেশি যাদের 

ফিমেল (নারী), ফোরটি (বয়স চল্লিশোর্ধ্ব), ফার্টিলিটি বা প্রজননক্ষম: প্রজননক্ষম মহিলাদের মধ্যে পিত্তথলির পাথর গঠনের ঝুঁকি বেশি। কেননা প্রজনন হরমোন (যেমন ইস্ট্রোজেন) পিত্তরসে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়, যা পাথর গঠনে ভূমিকা রাখে। 

ফ্যাটি (স্থূলতা): স্থূল ব্যক্তিদের মধ্যে কোলেস্টেরল সংশ্লেষণ বেশি থাকে, যা পাথর গঠনের কারণ হয়। 

ফেয়ার বা ফর্সা ত্বকের অধিকারী: ফর্সা ত্বকের অধিকারী ব্যক্তিদের মধ্যে পিত্ত পাথর গঠনের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। বংশগত কিংবা খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গেও সম্পর্কিত হতে পারে। 

এছাড়া দ্রুত ওজন কমানো, ডায়াবেটিস, কিছু ওষুধ, যেমন অনিয়ন্ত্রিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল, অতিরিক্ত ক্যালরি এবং ফ্যাট গ্রহণ, অ্যালকোহল, অলস জীবনধারা অর্থাৎ কম শারীরিক কার্যকলাপ বা দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকার প্রবণতা পিত্তথলির পাথর গঠনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। 

পিত্তথলির রোগের লক্ষণ

পেটের উপরিভাগের ডান দিকে তীব্র ব্যথা, যা চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণে বৃদ্ধি পায় এবং এ ব্যথা ডান কাঁধেও অনুভূত হতে পারে। এছাড়া বমি কিংবা বমি বমি ভাব, জ্বর, পেট ফাঁপা, হজমের সমস্যা, ত্বক ও চোখের সাদা অংশে হলদেটে ভাব বা জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এগুলো দেখা দিলে দ্রুত রেজিস্টার্ড ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। কেননা পিত্তথলির প্রদাহ জটিল আকার ধারণ করতে পারে, যেমন পিত্তথলি পচে যাওয়া, পুঁজ হয়ে যাওয়া কিংবা ফেটে যাওয়া এবং পিত্তনালিতে বাধা প্রদান, যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। 

পিত্তথলির রোগের চিকিৎসা

পিত্তথলির প্রদাহের চিকিৎসা রোগীর উপসর্গের তীব্রতা ও প্রদাহের কারণের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত এর চিকিৎসা দুটি ধাপে করা হয়। প্রথমত প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করা এবং দ্বিতীয়ত পিত্তথলি অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করা। 

প্রাথমিক চিকিৎসা: দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। যেমন খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করা (এনপিও), ইন্ট্রাভেনাস (আইভি) ফ্লইড, ব্যথানাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক।

পিত্তথলিতে অস্ত্রোপচার: যদি উপসর্গ দেখা দেয় তবে পিত্তথলির পাথর ও পিত্তথলির অন্যান্য রোগের প্রধানতম চিকিৎসা হলো সার্জারির মাধ্যমে পিত্তথলি অপসারণ। এ অস্ত্রোপচার জেনারেল সার্জন, ল্যাপারোস্কপিক সার্জন ও হেপটোবিলিয়ারি সার্জন করে থাকেন।

বর্তমানে উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও পিত্তথলি পাথরের আধুনিক ও জনপ্রিয় চিকিৎসা প্রচলিত রয়েছে। ল্যাপারোস্কপিক কোলেসিস্টেকটমি, যা ল্যাপারোস্কপিক মেশিনের সাহায্যে ছোট ছিদ্র করে করা হয়। বর্তমানে এ পদ্ধতিকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। এ ব্যবস্থা শহর থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ে করা হচ্ছে। যেখানে এ আধুনিক পদ্ধতি নেই, সেক্ষেত্রে সরাসরি অস্ত্রোপচার করে করা হয়। এক্ষেত্রে রোগীদের অপেক্ষাকৃত কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। 

ল্যাপারোস্কপিক কোলেসিস্টেকটমির উপকারিতা

ক্ষুদ্র কাটা, দ্রুত সুস্থ হওয়া, হাসপাতালে অবস্থানে সময়সীমা কম হওয়া, কম ব্যথা, ছোট দাগ, দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা। এ অপারেশনের পর সাধারণত রোগীকে মাত্র ২৪ ঘণ্টা বা তার কম সময়ের জন্য হাসপাতালে থাকতে হয়, কিন্তু কেটে অপারেশন করলে তা কয়েক দিন পর্যন্ত বাড়তে পারে। 

পিত্তথলির রোগ প্রতিরোধের উপায়

সুষম খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ ফাইবারযুক্ত ও কম চর্বিযুক্ত খাবার যেমন ফলমূল, শাকসবজি গ্রহণ করা। তৈলাক্ত ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার যেমন ফাস্টফুড, ভাজা খাবার ও রেড মিট এড়িয়ে চলা উচিত।

নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম: নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, যেমন প্রতিদিন হাঁটা, সাঁতার কাটা, শরীরে চর্বির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।

ওজন নিয়ন্ত্রণ: ওজন ধীরে ধীরে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে কমানো উচিত, কারণ দ্রুত ওজন হ্রাস পিত্তথলির পাথর গঠনের ঝুঁকি বাড়ায়। 

পর্যাপ্ত পানি পান: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা পিত্তরসের ঘনত্ব স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে।

এছাড়া জনসচেতনতা ও চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় পিত্তথলির রোগের জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

লেখক: আবাসিক সার্জন, জেনারেল সার্জারি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন