ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় রেহমান সোবহান

স্বল্পসময়ের আমানত নিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

( ফাইল ছবি)

দেশ রাজনৈতিক অর্থনীতির কাঠামোগত এক সমস্যায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ‘এখানে আছে অদক্ষতা, আছে অবিচারও। এখানে স্বল্পসময়ের জন্য আমানত নিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। একশ্রেণীর গ্রাহক আবার ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। অর্থাৎ পদ্ধতিতেই গলদ রয়েছে।’

সমাজ গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে গতকাল ‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শিরোনামে ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে রেহমান সোবহান এ কথাগুলো বলেন। গতকাল রাত ৯টায় শুরু হয়ে আলোচনা সভা চলে প্রায় আড়াই ঘণ্টা।

ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোয়ও খেলাপি ঋণের সমস্যা, ৬ ও ৯ শতাংশ সুদহার নীতির উদ্ভবের কারণ ও অভিজ্ঞতা, ব্যাংক একত্রীকরণ নীতির উদ্ভবের কারণ ও অভিজ্ঞতা, বাজেট–ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার প্রতিফলন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এমএম আকাশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, কোর্টল্যান্ডের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল দুটি আলাদা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

সমাজ গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে এতে সঞ্চালক ছিলেন এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। রেহমান সোবহানের পাশাপাশি আলোচক ছিলেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশরুর রিয়াজ।

রেহমান সোবহানের মতে, ব্যাংক খাতের বিদ্যমান ঋণ দেয়ার পদ্ধতির বদল করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে ঋণের জন্য বেছে নিতে হবে মূলত পুঁজিবাজারকে।

এমএম আকাশের প্রবন্ধে বলা হয়, সরকারি তথ্যানুযায়ী, ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা এখন খেলাপি ঋণ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্যানুযায়ী, তা ৪ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হবে। আর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। এ হার ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অথচ খেলাপি ঋণের হার ভারতে ৯ দশমিক ২, ইন্দোনেশিয়ায় ২ দশমিক ৯, শ্রীলঙ্কায় ২ দশমিক ৬, নেপালে ২, ফিলিপাইনে ১ দশমিক ৯ এবং মালয়েশিয়ায় ১ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রবন্ধে আরো জানানো হয়, ঋণ অবলোপন শুরু হয় ২০০২ সালে। আওয়ামী লীগ সরকারের ১০ বছরে (২০০৯-১৯) এ ঋণ অবলোপন বেড়েছে ৩১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৯ সালে ঋণ অবলোপন ছিল ১৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এ অবলোপন ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাড়তে বাড়তে ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।

জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ছে, তার একটি চিত্রও তুলে ধরেন এমএম আকাশ। এক উপস্থাপনায় তিনি দেখান, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮ শতাংশ। এরপর ১৯৭৩ সালের সংসদে ২৪ শতাংশ, ১৯৯০ সালের সংসদে ৩৮, ১৯৯৬ সালের সংসদে ৪৩ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। ২০০১ সালে এ হার ৫৮ শতাংশে পৌঁছায়। ২০০৮ সালে তা ১ শতাংশ কমে ৫৭  হলেও ২০১৪ সালে দাঁড়ায় ৫৯ এবং ২০১৮ সালে ৬১ শতাংশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ‘বিনিয়োগের প্রতি দরদ দেখানোর কথা বলে সুদের হার ৯ শতাংশ ও আমানতের হার ৬ শতাংশ করা হয়েছিল। বাস্তবে ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলেছেন, সুদের হার কমালে বিনিয়োগ বাড়বে। এটা ছিল মূলত অজুহাত। বিনিয়োগ কিন্তু বাড়েনি।’

দেশের কোনো অর্থনীতিবিদ ৯ ও ৬-এর ব্যাপারে একমত হতে পারেননি বলে মন্তব্য করেন বিরূপাক্ষ পাল। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জর্জরিত হয়ে সুদের হার কমাচ্ছিল, বাংলাদেশ ছিল তখন ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ ব্যাংক বাড়ায়নি। এটা ছিল এক ধরনের যথাযথ নীতি পদক্ষেপ না দেয়ার দম্ভ (পলিসি অ্যারোগেন্স)। আইএমএফ বলার পর শেষ পর্যন্ত সুদের হার বাড়িয়েছে, যখন আবার বিশ্বের অন্য দেশগুলো তা কমাতে শুরু করেছে।’

৯-৬ সুদের হার নীতিই বাংলাদেশে অনেক সমস্যা শুরু হয়ে যায় বলে মনে করেন বিরূপাক্ষ পাল। তার মতে, ওই নীতির পর থেকে রিজার্ভে টান পড়ে। তখন আবার আমদানিও সংকুচিত করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগগুলো জ্ঞানভিত্তিক হওয়া উচিত। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পেছনের দরজা দিয়ে আসার পথ বন্ধ করতে হবে।

সাংবাদিকদের তাড়িয়ে দিয়ে তথ্যপ্রবাহের গতি বন্ধ করে দেয়ার কোনো যুক্তি ছিল না বলে মনে করেন বিরূপাক্ষ পাল। তিনি আরো বলেন, ‘দরকার রাজস্ব দায়িত্বশীলতাও। এজন্য আইন দরকার একটি। অর্থাৎ চাইলেই টাকা দিয়ে দেয়া যাবে না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন