ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর সামষ্টিক মূল্যায়ন

প্রতিদিনই উঠছে উত্তরসহ প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

প্রচলিত মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে প্রায়োগিক দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে গত বুধবার। নতুন নিয়মে মূল্যায়ন হচ্ছে কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তৈরি করা শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নের ভিত্তিতে। এরই মধ্যে এ পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে করা প্রশ্নের ভিত্তিতে ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণীর পরীক্ষাও শুরু হয়েছে। এনসিটিবি থেকে এ-সংক্রান্ত শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্ন তৈরি করে পরীক্ষার আগের দিন তা পাঠানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কাছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা এ প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করছেন। যদিও অভিযোগ উঠছে, এ প্রক্রিয়ার মধ্যে আগেই উত্তরসহ প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। 

এ সামষ্টিক মূল্যায়নের দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল। এদিন ষষ্ঠ শ্রেণীর ইংরেজি, সপ্তম শ্রেণীর শিল্প ও সংস্কৃতি, অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং নবম শ্রেণীর ডিজিটাল প্রযুক্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে সবগুলো পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর রাত থেকে ইউটিউব এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে বলে অভিযোগ তুলছেন অভিভাবকরা। 

জাকিয়া ইসলাম নামে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার এক অভিভাবক বলেন, ‘আমি সবসময় চাই আমার সন্তান প্রকৃতপক্ষেই শিখুক। নতুন কারিকুলামের কিছু বিষয় নিয়ে সংশয় থাকলেও মূল্যায়ন পদ্ধতি বেশ ভালো মনে হয়েছিল। মুখস্থনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে প্রশ্ন আগে থেকেই প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ইউটিউবে পাওয়া সব উত্তর আগে থেকেই ঠিক করে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন প্রথম পরীক্ষায় আমি আমার সন্তানকে ইউটিউব বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে কিছু পড়াইনি। পরে আমার সন্তান আমাকে অভিযোগ করেছে তার বন্ধুরা সব মুখস্থ করে গেছে এবং সে দলীয় কাজে অন্যদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। ফলে বাধ্য হয়েই আমার সন্তানকেও দ্বিতীয় পরীক্ষায় ইউটিউব থেকে উত্তর মুখস্থ করিয়ে হলে পাঠিয়েছি।’

প্রথাগত মুখস্থবিদ্যা থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জনে প্রাধান্য দিয়ে নতুন এ মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সার্বিক সহযোগিতা করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনেকেই এখনো বেশ ধোঁয়াশায় রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রচলিত মুখস্থবিদ্যার ধারা থেকে বেরিয়ে প্রায়োগিক দক্ষতায় প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও অভিভাবকরা বলছেন, তারা বিষয়টি এখনো ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। এরই সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করছে জড়িতরা। 

মো. ইমাম হোসেন নামে অন্য এক অভিভাবক বলেন, ‘নতুন কারিকুলাম ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া আমরা অভিভাবকরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। এমনকি শিক্ষকরাও সবকিছু বোঝাতে পারছেন না। ফলে সন্তান যখন কোনো বিষয়ে সহযোগিতা চাইছে, আমরা অনেকটা বাধ্য হয়েই ইউটিউব বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহযোগিতা নিচ্ছি। তবে একজন অভিভাবক হিসেবে আমি কখনই প্রশ্ন ফাঁসের পক্ষে নই। এর ফলে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখল সেটি যাচাই করা সম্ভব হবে না।’ 

এর আগে গত ৩ জুলাই মূল্যায়নের প্রথম দিনেও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে এনসিটিবির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের সচেতন করে নৈপুণ্য অ্যাপের মাধ্যমে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে কেউ প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা যে প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন করছি তাতে প্রশ্ন প্রকাশ পেলেও খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কিন্তু সমস্যা হলো প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরও দিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা বিষয়টি নিয়ে নিজে চিন্তা করছে না এবং ভাবছে তারা নিজেরা চিন্তা করে লিখলে হয়তো ভুল হতে পারে। এ কারণে আমরা এমন যাতে না ঘটে সে বিষয়ে শিক্ষকদের সতর্ক করেছি। প্রথম দিন আমরা বেলা ২টায় প্রশ্ন দিয়েছিলাম। যখন দেখলাম এটি আগেই প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই সন্ধ্যা ৭টায় প্রশ্ন দেয়ার। কিন্তু ৭টায় প্রশ্ন দেয়ার পরও দেখা গেল সোয়া ৭টার মধ্যেই তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে এসেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা প্রধান শিক্ষকের নিজস্ব আইডিতে পাঠানো নির্দেশিকাগুলো বাইরের যে কারো সঙ্গে শেয়ার করা শিক্ষকতার নৈতিকতাবিরোধী কার্যক্রম ও চরম অশিক্ষকসুলভ আচরণ। আমরা এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে এক ধরনের ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করেছি। কোন শিক্ষক কখন প্রশ্ন ডাউনলোড করছেন সেটি মূল্যায়ন অ্যাপের মাধ্যমে শনাক্ত করা যাচ্ছে। আমরা এরই মধ্যে এমন কিছু আইডি শনাক্ত করে সেসব প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে সুপারিশ করেছি।’


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন