মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর

রাজনীতি, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গতকাল মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছবি: পিআইডি

এক সংক্ষিপ্ত সফরে গতকাল ঢাকায় এসেছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গতকাল বেলা ২টায় পৌঁছলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে আনোয়ার ইব্রাহিমকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এ সময় বিমানবন্দরে একান্তে কিছুক্ষণ আলোচনা করেন দুই দেশের সরকারপ্রধান। 

বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা—৪ ঘণ্টার এ সফরে দুই দেশের রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই সরকারপ্রধান একমত হয়েছেন। আনোয়ার ইব্রাহিম তার এ সফরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। 

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, বিমানবন্দরে দুই নেতা কিছুক্ষণের জন্য বসে কথা বলেন। সেখানে অধ্যাপক ইউনূস ছাত্র-জনতার বিপ্লব, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ এবং আগের সরকারের নৃশংসতার কথা সংক্ষেপে তুলে ধরেন। এ সময় ‘পুরনো বন্ধুকে’ স্বাগত জানাতে পেরে নিজের আনন্দের কথাও জানান ড. ইউনূস। মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের আন্তরিক সম্পর্কের বিষয়টি এ সময় উল্লেখ করেন তিনি। 

বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক মোটর শোভাযাত্রাসহ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। পরবর্তী সময়ে দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে আলোচনা করেন। এ আলোচনায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শ্রম অভিবাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলো উঠে আসে। 

দ্বিপক্ষীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে অধ্যাপক ইউনূস ও আনোয়ার ইব্রাহিম যৌথভাবে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের চেয়ারম্যান হতে যাওয়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে অভিনন্দন জানান ইউনূস। সেই সঙ্গে আসিয়ানের খাতভিত্তিক আলোচনায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তীকরণের প্রস্তাব করেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিষয়টি নিয়ে সচেষ্ট হবেন বলে জানান ইব্রাহিম।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আলোচনায় আমরা দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো আরো সক্রিয় (ভাইব্রেন্ট) করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমি তাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘটনাটি বর্ণনা করেছি। এ দ্বিতীয় স্বাধীনতার অন্বেষায় তরুণদের আত্মদানের বিষয়টি স্মরণীয়। তারা বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশের জন্য লড়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকার কাজে হাত দিয়েছে। ঐতিহাসিক এমন মুহূর্তে ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার অবিরাম সমর্থনের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সহযোগিতার তিনটি প্রধান ক্ষেত্র—রাজনীতি, ব্যবসা-বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও মানবিক সহায়তা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। জোর করে বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের নিরাপদে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আমরা আলোচনা করেছি। আসিয়ানের ফোরামে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জোর গলায় আলোচনা তোলার জন্য মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছি।’

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায় এবং পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার গুরুত্বের বিষয়টি নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট সম্পাদনের জন্য ট্রেড নেগোসিয়েশন কমিটির বৈঠক শুরু করার আশা করছি। কৃষি, জ্বালানি, শিক্ষা, হালাল অর্থনীতি, সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি, কানেক্টিভিটি, ব্লু ইকোনমি, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রতিরক্ষা ও যুব উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার নতুন নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেছি।’

সেবা খাতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সেবা খাতও দুই দেশের জন্য সম্ভাবনাময় একটি খাত। এ খাতে দুই দেশের জন্যই লাভজনক বিষয়গুলো নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারি। ভবিষ্যতে সহযোগিতার আরো দুটি খাত হতে পারে মোবিলিটি ও ফাইন্যান্সিং।’

তিনি বলেন, ‘দুই দেশের অর্থনীতিতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে বাংলাদেশী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিয়ে করা এমওইউর বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বাংলাদেশ থেকে পেশাদার ও শ্রমিক নেয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বিনিময়, ফ্যাকাল্টি এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। গভীর সমুদ্রের মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাংয়ের মধ্যে কৌশলগত কানেক্টিভিটির বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছিল।’ দুই নেতার বৈঠকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়ার চলমান কর্মসূচিগুলো কার্যকর করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়।

নতুন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে ভাই সম্বোধন করে ‘বিপ্লব’ ও ‘সংগ্রাম’ বাংলা শব্দগুলো উচ্চারণ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে আগে ফোন করে সমর্থন জানানোর কথাটিও তিনি পুনরায় উল্লেখ করেন। জেলজীবনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথাও বলেন তিনি। আর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চার দশক ধরে পরিচয়ের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

সরকার পরিচালনায় নিজেকে অনভিজ্ঞ হিসেবে ইউনূস উল্লেখ করলেও এটা কোনো বিষয় নয় মন্তব্য করে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘আপনার সক্ষমতা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আপনার দীর্ঘ প্রচেষ্টার কাছে এ অনভিজ্ঞতা ব্যাপার না।’ 

ব্যবসা ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘এখানে মালয়েশিয়ার কোম্পানি আছে, সেখানেও বাংলাদেশীর বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে। এখানে আরো কার্যকর অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব প্রয়োজন। কোম্পানিগুলোর দিকে আরো বেশি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে যেন দ্রুত তা সমাধান হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারের বিশেষ গুরুত্বের বিষয়টি কোম্পানিগুলো দেখছে। দুর্নীতির বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দেব না। শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়েও আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারি। এ বিষয়ে আরো আলোচনা হতে পারে।’ আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হবেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আপনার প্রচেষ্টার বিষয়ে আমার আস্থা আছে। নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে আপনার প্রচেষ্টাও আমি বিশ্বাস করি।’ 

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৫৮ সদস্যের প্রতিনিধি দলে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্য ও বিনিয়োগমন্ত্রী, পরিবহন উপমন্ত্রী, ধর্মবিষয়ক উপমন্ত্রী, দুজন সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ আরো কিছু প্রতিনিধি ছিলেন।

ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যাতে আরো জনশক্তি যেতে পারে সে ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ‘অর্থনীতি সংস্কার’ কর্মসূচিতেও মালয়েশিয়া সরকারের সহযোগিতার অনুরোধ জানান।

রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের জানান, সাক্ষাৎকালে তারা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক, কারিগরি সহযোগিতা, রোহিঙ্গা ইস্যু ও শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মতবিনিময় করেন। 

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘মালয়েশিয়া বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্যস্থল। বাংলাদেশের জনশক্তি মালয়েশিয়ার ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’

আনোয়ার ইব্রাহিমই প্রথম সরকারপ্রধান যিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত সফর শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন